পৃথিবীবাসীর সামনে এখন ঘোর বিপদ। এমনিতে চিরশত্রু হলেও স্বর্গবাসী ফেরেশতা আর নরকবাসী শয়তানেরা হাত মিলিয়েছে এই বিশ্বজগতকে ধ্বংস করার জন্য। নরক থেকে পাঠানো হয়েছে লুসিফারপুত্র অ্যান্টিক্রাইস্টকে, তার এগারোতম জন্মদিনেই প্রলয়ঙ্করী বিপর্যয়ে শেষ হয়ে যাবে গোটা বিশ্ব।
বইয়ের পোকা আজিরাফেল আর সদাচঞ্চল ক্রাউলি সবাইকে অবাক করে হাত মেলালো বিবলিকাল এই অ্যাপোক্যালিপ্স ঠেকানোর উদ্দেশ্যে। সৃষ্টির শুরু থেকেই একসঙ্গে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছে তারা। এই দেবদূত আর পিশাচের মধ্যে তাই গড়ে উঠেছে বিচিত্র ধরনের এক বন্ধুত্ব। একঘেয়ে স্বর্গ কিংবা বিদুঘুটে নরকের থেকে পৃথিবীতে কাটানো সময়গুলোই তাদের কাছে বেশি উপভোগ্য। এই মহাজগতে আবাস গেঁড়ে বসার কারণে এর ওপরে মায়াও বসে গেছে তাদের। আসন্ন অ্যাপোক্যালিপ্সকে মেনে নিতে না পেরে তাই জোট বাঁধে তারা। কিন্তু আসল সময়ে শিশু অ্যান্টিক্রাইস্টের হদিস না পেয়ে বিপাকে পড়ে দুজনেই। এদিকে উপরের মহল আর নিচের মহল থেকে আদেশ আসছে সমানে, অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাই দিশেহারা হয়ে পড়ে এই অ্যাঞ্জেল-ডেমন জুটি।
সপ্তদশ শতকের একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হলেন অ্যাগনেস নাটার। ডাইনি হবার অভিযোগে তাকে পুড়িয়ে মারার আগেই তিনি নিজের উত্তরাধিকারীদের জন্য লিখে রেখে যান হাজারো ভবিষ্যদ্বাণী। সেগুলো কাজে লাগিয়ে তারা ব্যাপক উন্নতি করে নিজেদের জীবনে। অ্যান্টিক্রাইস্টকে হত্যা করে পৃথিবীকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব পড়ে তারই উত্তরাধিকারীদের একজন, অ্যানাথেমার ঘাড়ে। এদিকে অ্যাগনেসের হত্যাকারীর বংশধর, সাদাসিধে তরুণ নিউটন পালসিফার কিছু না বুঝেই জড়িয়ে পড়ে এক উইচফাইন্ডারের সাথে।
নিল গাইম্যান আর টেরি প্র্যাচেট রচিত বই ‘গুড ওমেনস: দ্য নাইস অ্যান্ড অ্যাকুরেট প্রফেসিস অফ অ্যাগনেস নাটার, উইচ’ থেকে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে ৬ এপিসোডের মিনিসিরিজ ‘গুড ওমেনস’। সিরিজের চিত্রনাট্য লিখেছেন স্বয়ং নিল গাইম্যান নিজেই। গাইম্যান আর প্র্যাচেটের মাথায় এই ভিন্নধর্মী অ্যাপোক্যালিপ্টিক ফ্যান্টাসি কাহিনী এসেছিল প্রায় ত্রিশ বছর আগে। ৪০০ পৃষ্ঠার বইটি কাল্ট হিট হলেও এর ওপর ভিত্তি করে মুভি বানাতে উৎসাহী হননি কেউই। হাস্যকর হলেও সত্য, উইচ অ্যানাথেমা আর উইচফাইন্ডার নিউটনের প্রেমকে কেন্দ্র করে গল্পকে এগোতে চেয়েছিলেন নির্মাতারা। ২০০২ সালে খ্যাতনামা পরিচালক টেরি গিলিয়াম একবার মুভি নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছিলেন। আজিরাফেল আর ক্রাউলির ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিল রবিন উইলিয়ামস আর জনি ডেপের।
কিন্তু ব্যাটে বলে সবকিছু মেলেনি। ২০০৭ থেকে আলঝেইমারে ভোগা টেরি প্র্যাচেট পরপারে চলে যান ২০১৫ সালে। মৃত্যুর আগে নিজেদের প্রিয় সাহিত্যকর্মটি অ্যাডাপ্টেশনের ভার দিয়ে যান প্রিয় বন্ধু গাইম্যানের হাতে। তার অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া থেকে ফিরেই প্রথম এপিসোডের স্ক্রিনপ্লে লিখতে বসেন গাইম্যান। ডেভিড টেন্যান্ট বলেছেন, “এর পেছনে যে সময় দিয়েছেন, সেই সময়ে গাইম্যান চাইলে আরো গোটা চারেক বেস্ট সেলিং উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতেন“। কিন্তু এই প্রজেক্টটি তার কাছে ব্যক্তিগত একটা বিষয়। ‘ডক্টর হু’, ‘বিবিসি শার্লক’ এর কিছু এপিসোড পরিচালনা করা ডগলাস ম্যাককিননের ওপর পরিচালনার ভার পড়ে এবার।
বিরক্তিকর রকমের নীতিবান অ্যাঞ্জেল গ্যাব্রিয়েলের চরিত্রকে বাড়ানো ছাড়া পুরো কাহিনীতে তেমন একটা পরিবর্তন আনেননি গাইম্যান। তবে ক্রাউলি আর আজিরাফেলের বন্ধুত্বটা আরো প্রাণ পেয়েছে তার স্বতস্ফূর্ত স্ক্রিনপ্লের কারণে। অবশ্য নতুন কোনো চমক নেই বলে বইপড়ুয়াদের হতাশ হবার কারণ নেই, কারণ এই মিনি সিরিজের এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালু কেবল এর কাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে আছে, এমনটা না। প্রিয় চরিত্রগুলোর যথাযথ অ্যাডাপ্টেশন হওয়া যে কতটা স্বস্তিদায়ক, তা পাঠকমাত্রই বুঝবেন। নিল গাইম্যানেরই বই অনুসারে নির্মিত আরেক সিরিজ ‘আমেরিকান গডস’ উপভোগ্য হলেও যথাযথ অ্যাডাপ্টেশনের ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
আর গুড ওমেনস একবার দেখলেই মজা ফুরোবে, এমন না। কারণ, সূক্ষ্ণভাবে বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় এবং সংলাপ এমনভাবে ছড়িয়ে আছে, যেগুলো প্রথম দেখায় অর্থহীন মনে হবে। কিন্তু কাহিনীর সাথে একবার পরিচিত হবার পরে ভালোভাবেই বিনোদন পাওয়া যাবে।
কাহিনীর মারপ্যাঁচ কিংবা ভিজুয়াল ইফেক্ট নয়, এই মিনি সিরিজের মূল আকর্ষণ ছিলেন এর অভিনেতারা। সবকিছুকে থোড়াই কেয়ার করা ডেমন ক্রাউলির ভূমিকায় ডেভিড টেন্যান্ট ছিলেন অনবদ্য। এর আগে ‘ডক্টর হু’ সিরিজে টেনথ ডক্টর কিংবা ‘মার্ভেল’স জেসিকা জোন্স’ এ কিলগ্রেভের ভূমিকায় অভিনয় করে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পাওয়া এই ব্রিটিশ অভিনেতা ছাড়া অন্য কেউ ক্রাউলির বহুমাত্রিক চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে পারত বলে মনে হয় না। একই কথা খাটে মাইকেল শিনের ক্ষেত্রে। বিভিন্ন সময়ে ক্রাউলির কাজে খুশি হয়েও সেটা ঢাকার চেষ্টা করতে থাকা দেবদূত আজিরাফেলের নিষ্পাপ ভাবভঙ্গী একদম নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই ভেটেরান অভিনেতা। মহাজাগতিক সত্ত্বা হলেও তাদের রূপ প্রকাশের জন্য খুব বেশি ভিজুয়াল ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়নি, নিজেদের অভিনয় দিয়েই কাল্পনিক চরিত্রগুলোতে প্রাণ দিয়েছেন তারা।
‘গুড ওমেনস’ এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র আরক্যাঞ্জেল গ্যব্রিয়েলের ভূমিকায় ছিলেন ‘ম্যাড মেন’ খ্যাত জনপ্রিয় অভিনেতা জন হ্যাম। বইয়ের তুলনায় তার চরিত্র বেশ ভালোভাবেই বিকশিত হয়েছে এখানে। একইভাবে ক্রাউলির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা ডিউক অফ হেল হাস্তার ছিল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র। অ্যাডাম, ইভ, আরক্যাঞ্জেল মাইকেল, অ্যাঞ্জেল ইউরিয়েল, ডেমন ড্যাগন– বাইবেলের এরকম সব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকেও দেখানো হয়েছে এখানে। মোটরবাইক চড়ে আসা অ্যাপোক্যালিপ্সের চার হর্সমেন কাহিনীতে খুব একটা প্রভাব না ফেললেও স্বল্প সময়ের স্ক্রিনটাইমে ভালোভাবেই নজর কেড়েছেন। বিশেষ করে ওয়ারের ভূমিকায় মিরেইল এনোস আর ফ্যামিনের ভূমিকায় ইউসুফ গেটউডের কথা আলাদা করে বলতেই হয়।
এত সব অপার্থিব চরিত্রের ভিড়ে মানবজাতির প্রতিনিধিদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। হতভাগ্য ইঞ্জিনিয়ার ওরফে উইচফাইন্ডার নিউটন পালসিফারের ভূমিকায় ছিলেন ব্রিটিশ কমেডিয়ান জ্যাক হোয়াইটহল। রহস্য সমাধানে উদগ্রীব উইচ অ্যানাথেমার সাথে তার রসায়ন জমলেও তা ক্রাউলি আর আজিরাফেলকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। তবে সিরিজের সবচেয়ে মজার সংলাপগুলো কিন্তু অ্যানাথেমা আর ক্রাউলির কাছ থেকেই এসেছে। এছাড়াও অ্যান্টিক্রাইস্ট এবং তার বন্ধুরা কাহিনীতে কিশোর অ্যাডভেঞ্চারের ভাইব এনে দিয়েছে। ঈশ্বরের কণ্ঠ দেবার জন্য ফ্রান্সেস ম্যাকডরম্যান্ড আর লুসিফারের কণ্ঠ দেবার জন্য বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচের মতো অভিনেতাদেরকে নেয়া হলেও বইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মহাশক্তিরধর এই দুই চরিত্র তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি, কাহিনী এগোনোর নিমিত্ত ছিল কেবল।
ফ্যান্টাসি সিরিজ যেহেতু, ভিজুয়াল ইফেক্টের উপস্থিতি থাকবেই, তবে তার ব্যবহার ছিল কখনোই কাহিনীকে ছাপিয়ে যায়নি। সেই গার্ডেন অফ ইডেন, নোয়ার আর্ক, যিশুর ক্রুসিফিকেশন থেকে শুরু করে শেক্সপিয়ারিয়ান যুগ, ফরাসি বিপ্লব, এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও উঠে এসেছে কাহিনীতে। এরকম জটিল প্রোডাকশন আর কস্টিউম ডিজাইনকেও ভালোভাবেই সামলেছেন নির্মাতারা। ইংল্যান্ডের নিরিবিলি গ্রাম ট্যাডফিল্ডের মনোরম দৃশ্য এরকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতেও মনকে শান্ত করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ঝাঁ চকচকে স্বর্গ আর পঙ্কিল নরকের দৃশ্যায়ন আরেক বিখ্যাত সিরিজ ‘সুপারন্যাচারাল’কে মনে করিয়ে দিয়েছে। দুটোই খ্রিস্টান মিথলজিনির্ভর স্যাটায়ার বলে সুপারন্যাচারালের অনেক প্লট এলিমেন্টের ওপরেই গুড ওমেনসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। হেলহাউন্ড, চার হর্সম্যান, ডেমন পজেশন কিংবা হোলি ওয়াটা্রের ব্যাপারগুলো অবশ্য অনেক ফ্যান্টাসি সিরিজেই দেখা যায়। তবে অ্যাপোক্যালিপ্স ঘটাতে স্বর্গ-নরকের যৌথ চক্রান্তের ব্যাপারগুলো সুপারন্যাচারালে বিস্তারিতভাবে এবং সিরিয়াস টোনে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আবহ সঙ্গীত হিসেবে এতে ব্যবহার করা হয়েছে চমৎকার সব সাউন্ডট্র্যাক। বিশেষ করে ক্রাউলি, তার বেন্টলি গাড়ি আর কুইন ব্যান্ডের গানগুলো ছিল একেবারে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ‘বোহেমিয়ান র্যাপসডি’, ‘উই উইল রক ইউ’, ‘ইউ আর মাই বেস্টফ্রেন্ড’ কিংবা ‘বাইসাইকেল রেস’ সবগুল গানই পরিস্থিতির সাথে দারুণভাবে খাপ খেয়ে গেছে। সিরিজের পিয়ানোনির্ভর থিম সং শুনে অবশ্য বিটোফেনের ফার এলিসের কথা মনে পড়ে যেতে পারে। বেগুনি হয়ে আসা আকাশের পটভূমিতে হার্ড রক মিউজিকের তালে তালে বাইক হাঁকিয়ে চার হর্সম্যান আসার দৃশ্যটিও দারুণ ছিল।
সিরিজটি কি কোনোদিক দিয়ে হতাশ করেছে? না বললেই চলে। তবে আজিরাফেল আর ক্রাউলির অংশ বাদ দিয়ে অন্য চরিত্রগুলো আসার সময়ে কাহিনী যেন একটু হলেও প্রাণ হারাচ্ছিল। লেখকের ইচ্ছার ওপর কথা নেই। তবে গাইম্যান যদি একটু ঝুঁকি নিয়ে কাহিনীকে আরেকটু সমৃদ্ধ করতেন, তাহলে হয়তো কিছু অ্যান্টিক্লাইম্যাটিক মুহূর্ত কমত। তারপরেও ফ্যান্টাসি কিংবা ব্ল্যাক কমেডির মিশেলে অ্যামাজন প্রাইমের দুর্দান্ত এই অ্যাপোক্যালিপ্টিক সিরিজটিকে মাস্ট ওয়াচ সিরিজের তালিকায় রাখতেই হবে।