গণমাধ্যমের অতিরিক্ত উৎসাহের কারণে লিবিয়ার ২০১১ সালের ইতিহাসটা আমরা মোটামুটি সবাই জানি- কীভাবে গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, কীভাবে সেটা গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল এবং শেষপর্যন্ত কীভাবে বিদ্রোহীরা গাদ্দাফীকে কালভার্টের ভেতর থেকে টেনে এনে হত্যা করেছিল। কিন্তু গাদ্দাফীর মৃত্যুর পর দেশটির ভাগ্যে কী ঘটেছে, কীভাবে দেশটি কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে, সেই ইতিহাস প্রায় কোনো মিডিয়াতেই আলোচিত হয় না।
অনেকেই হয়তো জানেন না, ২০১১ সালের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ২০১২ এবং ২০১৩ সালে লিবিয়ার পরিস্থিতি বেশ ভালো ছিল। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মাত্র আট মাসের মাথায়ই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। খুবই সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল। পরাজিত দলগুলোও বিনা প্রশ্নে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছিল। তেলের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল, লিবিয়ান দিনারের মান গাদ্দাফীর সময়ের মানকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও বেশ ভালো ছিল, মানুষ মোটামুটি নির্ভয়ে মত প্রকাশ করতে পারছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, লিবিয়া আসলেই গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা করছে।
কিন্তু আট বছর পর এখন পেছনের দিকে ফিরে তাকালে মনে হয়, ঐ সময়টুকু ছিল কেবলই মরিচীকা। ২০১৩ সালের শেষভাগ থেকেই সবকিছু ভেঙে পড়তে শুরু করে। ২০১৪ সালে নতুন করে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। লিবিয়া পরিণত হয় আল-কায়েদা, আইএস-সহ জিহাদী সংগঠনগুলোর অভয়ারণ্যে। ধীরে ধীরে বিদেশি পরাশক্তিগুলোরও হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। কাতার, তুরস্ক, মিসর, আরব আবিরাত, ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া- প্রতিটি দেশ নিজের পছন্দের মিলিশিয়া গ্রুপকে সাহায্য করতে শুরু করে। লিবিয়া পরিণত হয় আন্তর্জাতিক ছায়াযুদ্ধের দাবার ঘুঁটিতে।
কীভাবে লিবিয়া এই অবস্থায় এলো? লিবিয়ানদের কোন কোন ভুল সিদ্ধান্ত, কিংবা আত্মঘাতী পদক্ষেপ তাদেরকে আজকের এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে? ফ্রেডরিক ওয়েরি তার The Burning Shores: Inside the Battle for the New Libya বইয়ে সেই ইতিহাসই তুলে ধরেছেন।
ফ্রেডেরিক ওয়েরি একজন সাবেক মার্কিন মিলিটারি অফিসার, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, অক্সফোর্ডের ডক্টরেট ডিগ্রিধারী অধ্যাপক। বর্তমানে কার্নেগি এন্ডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের মিডলইস্ট প্রোগ্রামের একজন সিনিয়র ফেলো। লিবিয়ার রাজনীতি এবং ইতিহাসের উপর তার অগাধ জ্ঞান প্রশংসনীয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস, ফরেন অ্যাফেয়ার্সসহ বিভিন্ন পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে লিবিয়ার উপর তার মতামত, বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন সিনেট তাকে একাধিকবার লিবিয়ার উপর মতামত দেয়ার জন্য ডেকেছে।
ফ্রেডরিক ওয়েরি প্রথম লিবিয়াতে আসেন ২০০৯ সালে। সে সময় মার্কিন সেনাবাহনীর একটি দল লিবিয়ান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল লিবিয়ার দক্ষিণে আল-কায়েদার হুমকি মোকাবেলা করার জন্য। ওয়েরি ছিলেন সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে মার্কিন দূতাবাসের মিলিটারি অ্যাটাশে।
২০১১ সালের যুদ্ধের পর থেকে ওয়েরি অনেকবার লিবিয়াতে এসেছেন, গবেষক হিসেবে লিবিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে। গত ছয়-সাত বছর ধরে তিনি লিবিয়া চষে বেড়িয়েছেন। লিবিয়ার প্রায় প্রতিটি প্রধান প্রধান মিলিশিয়া গ্রুপের নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। একদিকে তিনি পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর প্রধান জেনারেল হাফতারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, অন্যদিকে মিসরাতা এবং জিনতানের মিলিশিয়া ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেছেন, ত্রিপলির সালাফি আদর্শের নিরাপত্তাবাহিনী রাদার হেডকোয়ার্টারে রাত কাটিয়েছেন, বিভিন্ন জিহাদী নেতা, এমনকি আইএস বন্দীদেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তার এসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা দিয়ে তার বইটিকেই সমৃদ্ধ করেছে।
অনেক পশ্চিমা লেখক বা সাংবাদিকই ২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া লিবিয়ার দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধকে ইসলামপন্থী এবং ইসলামবিরোধী শক্তির সংঘর্ষ হিসেবে সরলীকরণ করেন। কিন্তু ওয়েরি তাদের সাথে একমত না। তার বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন, সংঘর্ষটা মূলত সংস্কারপন্থী বা গণতন্ত্রপন্থীদের সাথে স্বৈরতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে চাওয়া শক্তির সংঘর্ষ। বিভিন্ন কারণে ইসলামপন্থীদের অনেকেই সংস্কারপন্থীদের সাথে যোগ দিয়েছে, আর তাদেরকে দমন করতে গিয়ে সামরিকতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাওয়া শক্তি ইসলামবিরোধীদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু মূল সংঘর্ষটা ধর্মকেন্দ্রিক না, ধর্ম এখানে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেরই একটি অনুষঙ্গ।
বইয়ের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে ২০১২ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর বেনগাজির মার্কিন কন্স্যুলেট এবং সিআইএ অ্যানেক্সে ইসলামপন্থীদের আক্রমণে রাষ্ট্রদূত ক্রিস স্টিভেন্স-সহ চারজন আমেরিকানের মৃত্যুর ঘটনাটি। ওয়েরি দেখিয়েছেন, কীভাবে আমেরিকা সেখানে শুধুমাত্র আল-কায়েদার উপর মনোযোগ দিতে গিয়ে স্থানীয় জিহাদীদের হুমকিকে অগ্রাহ্য করার মূল্য দিয়েছিল, যেসব ‘মডারেট’ ইসলামপন্থী মিলিশিয়ার উপর আমেরিকা নির্ভর করেছিল, তারাই কীভাবে আক্রমণকারীদের সাথে সহযোগিতা করে স্টিভেন্সের মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল।
কিন্তু আমেরিকার মিত্ররা সবাই চরমপন্থী ছিল না। অনেক মডারেট ইসলামপন্থী নেতা সত্যি সত্যিই সে রাতে স্টিভেন্সকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। তাদের অনেককে আমেরিকার পক্ষ থেকে সার্টিফিকেট দিয়েও পুরস্কৃত করা হয়েছিল। কিন্তু ওয়েরি দেখিয়েছেন, ২০১৪ সালের গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমেরিকার একসময়ের মিত্র জেনারেল খালিফা হাফতার যখন তার বিরুদ্ধে থাকা সব ধরনের ইসলামপন্থীকেই চরমপন্থী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন, তখন স্টিভেন্সকে বাঁচাতে চেষ্টা করা সেই ইসলামপন্থীরাও আমেরিকার সাহায্য না পেয়ে ধীরে ধীরে চরমপন্থাকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য হয়।
ফ্রেডরিক ওয়েরি তার বইটি শুরু করেছেন গাদ্দাফীর শাসনামলের সময় থেকে। কিন্তু তার বইয়ের মূল আকর্ষণ গাদ্দাফীর মৃত্যুর পরের অংশগুলো। তার লেখা শুধু যে সাক্ষাৎকার থেকে পাওয়া দারুণ সব তথ্যে ঠাঁসা, তা-ই নয়, তার বর্ণনাভঙ্গিও অসাধারণ। উপন্যাসের মতোই বাস্তব চরিত্রগুলোকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে থাকে তার লেখাগুলো। তার শব্দচয়ন এবং উপমাও অনেক সময় ভুলিয়ে দেয়, সাহিত্য পড়ছি, নাকি ইতিহাস।
ওয়েরির লেখায় একটাই ত্রুটি, তার মধ্যে কিছুটা আমেরিকাপন্থী বায়াস লক্ষ্য করা যায়। তিনি আমেরিকার আগ্রাসী নীতির তেমন সমালোচনা করেন না। যদিও গাদ্দাফীর পতনের পর থেকে লিবিয়াতে আমেরিকার হস্তক্ষেপ একেবারেই কম, এবং ২০১১ সালেও ফ্রান্স ও কাতারের তুলনায় আমেরিকার ভূমিকা কম ছিল, কিন্তু তারপরেও যেটুকু ছিল, সেটুকুর সমালোচনাও তার লেখায় পাওয়া যায় না। কিন্তু লিবিয়ার বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বা তাদের আন্তর্জাতিক প্রভুদের মধ্যে তিনি খুবই কম পক্ষপাতিত্ব করের। জেনারেল হাফতার, মিসরাতাভিত্তিক মিলিশিয়া, কাতার, তুরস্ক, আরব আমিরাত, মিসর – সব পক্ষেরই উপযুক্ত সমালোচনা তার লেখায় পাওয়া যায়।
৩৫২ পৃষ্ঠার বইটি লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের পূর্বাপরের পরিস্থিতি নিয়ে সম্ভবত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পরিপূর্ণ কাজ। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে যারা আগ্রহী, কিংবা অপ্রস্তুত বিপ্লব কীভাবে একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে, সেটা যারা বুঝতে চান, তাদের জন্য এই বইটি একটি অবশ্যপাঠ্য। বইটি ২০১৮ সালে Farrar, Straus and Giroux থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
পাঠকদের ভোটে আমাজনে এর রেটিং ৪.৮/৫ এবং গুডরিডসে ৪.১৪/৫।