হলিউড অভিনেতা অ্যালেক বল্ডউইনকে অনিচ্ছাকৃতভাবে নরহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন নিউ মেক্সিকোর স্যান্টা ফে প্রদেশের ডিসট্রিক্ট-অ্যাটর্নি। বর্তমানে হলিউড গরম করে রাখা কতিপয় বিষয়ের মধ্যে বল্ডউইনের বিরুদ্ধে দায়ের করা এই মামলা অন্যতম। মামলার রায়ের সাথে যুক্ত রয়েছে দেড় বছর থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের অধিক সময় কারাগার যাপন! কী সেই ঘটনা যার ভিত্তিতে কোর্ট-কাচারি পৌঁছে গেছে হলিউডের একদম অভ্যন্তরে?
‘রাস্ট’ এবং মর্মান্তিক এক ট্র্যাজেডি
২০২১ সালের অক্টোবরে নিউ মেক্সিকো রাজ্যের স্যান্টা ফে প্রদেশে শুটিং চলছিল অ্যালেক বল্ডউইনের নতুন ওয়েস্টার্ন মুভি ‘রাস্ট’-এর। ২১ অক্টোবর শুটিং চলাকালে একটা দৃশ্যের প্রয়োজনে বল্ডউইন ‘প্রপ’ হিসেবে ব্যবহার করা এক রিভলভার পিস্তলের ট্রিগার চালান। সেই ট্রিগার থেকে ছুটে আসা বুলেট নিঃশেষ করে দেয় ক্যামেরার পেছনে থাকা মুভির সিনেম্যাটোগ্রাফারের প্রাণ!
এখানে বলে রাখা ভালো, ‘প্রপ’ হিসেবে যেসব পিস্তল, বন্দুক ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়, সেসব আগ্নেয়াস্ত্রে কখনোই আসল বুলেট থাকে না। সেটে সবসময় একজন ‘আর্মারার’ থাকেন, যার একমাত্র দায়িত্ব সেটের সকল আগ্নেয়াস্ত্র পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। রাস্টের সেটে এই দায়িত্বে ছিলেন হ্যানাহ গুটিয়েরেজ-রীড নামক একেবারেই নতুন, অনভিজ্ঞ এক আর্মারার। তো, গুটিয়েরেজ-রীডের সেট-আপ করা অস্ত্র থেকে আলোচিত রিভলভারটা মুভির সহকারী পরিচালক বল্ডউইনের হাতে দেন একটা দৃশ্যে ব্যবহার করতে। বল্ডউইন পিস্তলের ট্রিগার টানলে পিস্তল থেকে আসল বুলেট বের হয়ে সিনেম্যাটোগ্রাফার হেলেইনা হাচিন্সের বুকে বিদ্ধ হয়, এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য, বুলেটটি মিস হাচিন্সের পেছনে দাঁড়ানো মুভির পরিচালক, জোয়েল সুজার কাঁধে লেগে তাকেও আহত করে। এই মর্মান্তিক ঘটনার সূত্র ধরেই শুরু হয়েছে লম্বা ও বিস্তারিত এক মামলার ঘটনা।
অভিযোগনামা ও মামলার ভিত্তি
বিস্তারিত তদন্ত, অভিযোগ, পাল্টা-অভিযোগ ইত্যাদি শেষে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি স্যান্টা ফে প্রদেশের ডিসট্রিক্ট-অ্যাটর্নির অফিস অ্যালেক বল্ডউইন ও হ্যানাহ গুটিয়েরেজ-রীডকে দুই ধারায় অনিচ্ছাকৃত নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেন। মুভি সেটের বন্দুক দ্বারা হেলেইনা হাচিন্সের মৃত্যুর সাথে দায়িত্বহীনতার সাথে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার চার্জ যুক্ত হয়েছে।
ডিসট্রিক্ট-অ্যাটর্নি ম্যারি কারম্যাক-অল্টউইজের মতে, বল্ডউইন ও গুটিয়েরেজ-রীড দুজনই উক্ত দুই ধারায় দোষী। মুখ্য অভিনেতা হওয়ার পাশাপাশি মুভির প্রযোজক থাকাকে মামলায় বল্ডউইনের বিরুদ্ধে যুক্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। মুভি সেটের পরিষ্কার নিয়ম রয়েছে- কোনো পরিস্থিতিতেই কোনো ব্যক্তির দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করা যাবে না। ডিসট্রিক্ট-অ্যাটর্নির স্পেশাল ইনভেস্টিগেটরের ভাষ্যমতে, বল্ডউইন রিভলভারের ট্রিগারে আঙ্গুল দিয়ে অস্ত্রটি হাচিন্স ও সুজার দিকে তাক করে সেটের পরিষ্কার ওই নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। আর্মারার হ্যানাহ গুটিয়েরেজ-রীডের বিরুদ্ধে অভিযোগের যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে- আগ্নেয়াস্ত্রে বুলেট লোড করার সময় বুলেটের রাউন্ড পরীক্ষা করে না দেখা, সেটে আসল বুলেট এবং অনিরাপদ গোলাবারুদ অনুমোদন করা। রাস্টের আকারের মুভি সেটের জন্য আবশ্যক অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ গুটিয়েরেজ-রীডের না থাকাও অভিযোগের আরেকটি অংশ।
মামলার খুঁটিনাটি
সন্দেহজনক মৃত্যুর ক্ষেত্রে সাধারণত দুই ধরনের মামলা হতে পারে- মার্ডার বা হত্যাকাণ্ড, এবং ম্যানস্লটার বা অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা। ‘রাস্ট’ মুভির সেটের এই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নরহত্যার দায়ে মামলা করা হয়েছে। আমেরিকান আইন মতে, কোনো হত্যাকাণ্ড উদ্দেশ্যমূলক না হওয়া সত্ত্বেও যদি আইনের চোখে বেআইনি বা অবৈধ হয়, তবে সেই হত্যাকাণ্ডকে Involuntary Manslaughter বা অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা বলা হয়। বর্তমান আলোচিত কেসে অভিযুক্তদের দণ্ডাদেশ দেয়া বা দোষী সাব্যস্ত করার জন্য প্রসিকিউশনকে প্রমাণ করতে হবে- অ্যালেক বল্ডউইন অথবা হ্যানাহ গুটিয়েরেজ-রীডের আচরণে বেআইনি কিছু ছিল।
এই কেইস নিয়ে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের এর প্রফেসরের বিশ্লেষণের একাংশ নিচে তুলে ধরা হলো,
কাউকে অনিচ্ছাকৃত নরহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য একজন প্রসিকিউটরকে প্রমাণ করতে হয় যে অভিযুক্ত বেপরোয়াভাবে কাজটি করেছিল অথবা কাজটির প্রতি তার অবহেলা বেআইনি পর্যায়ে পড়ে…। সম্ভাব্য জুরির সামনে প্রশ্ন থাকবে ‘রাস্ট’ সিনেমার সেটে সিনেম্যাটোগ্রাফার হেলেইনা হাচিন্সের মৃত্যুতে বল্ডউইন বেপরোয়া অথবা বেআইনি কার্যকলাপের দোষে দোষী কিনা। প্রসিকিউটর দাবি করছে- নিজের ব্যবহার করা বন্দুক আর বারুদ সঠিকভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা বল্ডউইনের দায়িত্ব ছিল, এবং নিজে পরীক্ষা না করে বন্দুকটা অন্য কারো দিকে তাক করা উচিত ছিল না। প্রসিকিউটর এটা দাবি করা সত্ত্বেও পরিস্থিতি জটিল করে দেয় আরেকটা বিষয়- সেটে আরেকজন ব্যক্তির দায়িত্ব ছিল সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ, অন-সেট সেফটি পারসনের।
বল্ডউইনকে অনিচ্ছাকৃত নরহত্যায় দণ্ডাদেশ দেয়ার জন্য- ধরে নিয়ে যে মামলাটা আদালতে পৌঁছাবে- প্রসিকিউটরকে দুটি বিষয় বোঝাতে হবে জুরিকে। প্রথমত, বন্দুকে লাইভ বুলেট থাকার ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য গুটিয়েরেজ-রীডের উপর নির্ভর না করার যুক্তিসংগত কারণ ছিল বল্ডউইনের। এবং দ্বিতীয়ত, একজনের দিকে বন্দুক তাক করে তাকে মেরে ফেলার আগে নিজে বন্দুক ও বন্দুকের বারুদ পরীক্ষা না করে বল্ডউইন বেপরোয়া আচরণ করেছেন, বা অন্ততপক্ষে আচরণে চূড়ান্ত অবহেলা প্রকাশ পেয়েছে।“ (Joy, 2023)
প্রফেসরের উক্ত বিশ্লেষণ থেকে আমরা বুঝতেই পারছি- কেসটি বেশ জটিল এবং গতিশীল। হ্যানাহ গুটিয়েরেজ-রীডের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অনেকটাই যুক্তিযুক্ত লাগছে বিশেষজ্ঞদের, যেহেতু তিনি সরাসরি সেটের অস্ত্র পরীক্ষা করার দায়িত্বে ছিলেন। এই দুঃখজনক ঘটনার পেছনে তার কাজে অবহেলাকেই দায়ী করছেন অনেকে। আবার অনেকের ভাষ্যমতে, মুভির প্রযোজক হওয়ার কারণে অ্যালেক বল্ডউইনও সমান দোষে দোষী। মুভি সেটের নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক দায়িত্ব প্রযোজকের ঘাড়েই বর্তায়। এই যুক্তিতে বল্ডউইনকে অপরাধের আসন থেকে সরাতে নারাজ তারা।
উকিলদের মতামত
অভিযোগনামা প্রকাশের আগে বল্ডউইনের পক্ষের এক উকিলের মন্তব্য ছিল এরকম,
… ঐ বন্দুকে অথবা মুভি সেটের কোথাও যে লাইভ বুলেট থাকতে পারে এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না মি. বল্ডউইনের। যাদের সাথে কাজ করছিলেন, সেই পেশাদারদের উপর তিনি আস্থা রেখেছিলেন, যারা তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে বন্দুকে আসল বুলেট ছিল না।
একই বিষয়ে গুটিয়েরেজ-রীডের পক্ষের এক উকিলের মতে, প্রসিকিউটরদের বিবৃতি প্রকাশ করে তারা ঘটনার প্রকৃত সত্য সম্পূর্ণভাবে ভুল বুঝেছেন, এবং ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
বর্তমান পরিস্থিতি
হলিউড থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া সর্বত্রই এই কেস এখন একটা হট টপিকে পরিণত হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা অভিনেতা, প্রযোজক, সেটে কাজ করা টেকনিশিয়ান সবাই নিজেদের প্রেক্ষাপট থেকে মতামত বিনিময় করার পাশাপাশি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে মামলার অগ্রগতি দেখতে।
এই কেসের ফলাফল অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে পারে মুভি সেটের পরিবেশে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দুর্ঘটনার তদন্ত করা স্পেশাল প্রসিকিউটর এন্ড্রিয়া রীবকে কেইস থেকে অপসারণ করার জন্য ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে অ্যালেক বল্ডউইনের অ্যাটর্নি আবেদন করেছেন। এন্ড্রিয়া রীব নিউ মেক্সিকোর কংগ্রেসমেম্বার হওয়ার কারণে তিনি প্রদেশটির Legislative বা আইন-প্রণয়নকারী ক্ষমতার অধিকারী। বল্ডউইনের অ্যাটর্নির মতে, একই প্রসিকিউটর কেসে নিযুক্ত থেকে তিনি Judicial বা বিচারসংক্রান্ত ক্ষমতাও প্রয়োগ করছেন, যা নিউ মেক্সিকোর সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। আবেদনটি এখনও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
‘রাস্ট’ মুভি সেট থেকে সৃষ্টি হওয়া এই মামলা চলতে থাকবে আরো বহুদিন। সামনে আমরা দেখতে পাব বাদী-বিবাদী পক্ষ থেকে একের পর এক যুক্তিতর্ক। সকল প্রক্রিয়া শেষে নিউ মেক্সিকোর আদালত পৌঁছবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে। তবে সকল যুক্তিতর্কের মাঝে ভুলে গেলে চলবে না হেলেইনা হাচিন্সের কথা। নিজের প্যাশনের পেছনে জীবন উৎসর্গ করা সিনেম্যাটোগ্রাফার হেলেইনা হাচিন্সের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখা শেষ করছি।