ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু গেরিলা যোদ্ধার গল্প

১৯৪১ সাল; বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ চলছে। নাৎসি অধ্যুষিত ফ্রান্সের এক গ্রামের মধ্যে ছোট একটি বাড়ি। বাড়ির কর্তা লাপাদিত দরজার ঠিক বাইরেই কাজে ব্যস্ত। এমন সময় কয়েকজন নাৎসি সৈন্যসহ সেখানে আগমন কর্নেল হান্স লান্ডার। লাপাদিতের অনুমতি নিয়ে তার বাড়িতে কিছুক্ষণ বন্ধুসুলভ আড্ডা দিলেন তার সঙ্গে। একসময় কর্নেল তাকে জানালেন তার আগমনের কারণ। এই বাড়িতে কোনো ইহুদি পরিবার আছে বলে তার ধারণা। ধারণা ঠিকই ছিল। বাড়ির কাঠের মেঝের নিচেই ড্রাইফাস পরিবার ইহুদি বিদ্বেষী নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য লুকিয়ে ছিল। মেঝের উপর থেকে সৈনিকেরা গুলি চালালো মেঝে বরাবর। শেষ হয়ে গেল পুরো পরিবার। শুধুমাত্র তাদের ছোট মেয়ে শশানা জীবিত অবস্থায় পালাতে পারল।

এভাবেই শুরু হয় ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস  ছবিটি। জনপ্রিয় পরিচালক কোয়েন্টিন টারান্টিনোর লেখা ও পরিচালনায় এ সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০০৯ সালে। টারান্টিনো তার এই ছবির নামটি নিয়েছেন ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ইতালিয়ান চলচ্চিত্র থেকে, যার পরিচালনায় ছিলেন এনজো জি কাস্তিয়ারি। মুভিটি সর্বপ্রথম পর্দায় আসে ২০০৯ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে। মুভিটি মূলত একদল ইহুদি সৈন্যকে নিয়ে, যারা নিজেদের বাস্টার্ডস বলে দাবি করে। এই বাস্টার্ডদের লক্ষ্য ফ্রান্সে জার্মান নাৎসি সৈন্যদের নির্মমভাবে মারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের উপর জার্মানদের অত্যাচারের কথা কারোই অজানা নয়। দলটি এই নির্মমতার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই আগাতে থাকে। এ দলটির মধ্যে ১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্তডার্টি ডজনস  মুভির সৈনিক দলের ছায়া খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’ মুভির পোস্টার; Image Source:IMDB

 

যদি বলা হয় মুভির মূল চরিত্রের কথা, তবে বলতে হবে তিনজনের কথা। প্রথমজন বাস্টার্ড দলের নেতা লেফটেনেন্ট আল্ডো রেইন। এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন ব্র্যাড পিট। এই আল্ডো রেইন চরিত্রটি আসলে ষাটের দশকের হলিউড অভিনেতা আল্ডো রে এর ছায়া অবলম্বনে সৃষ্ট বলা যায়, যিনি বলিউডে যুদ্ধ-বিগ্রহবিষয়ক মুভির জন্যই বেশি পরিচিত। মুভির লেফটেনেন্ট আল্ডো রেইন কয়েকজন ইহুদি যুবক নিয়ে ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস দল গঠন করে যাদের উদ্দেশ্য জার্মানদের মনে তাদের নির্মমতা যেন দাগ কাটে। আর এই দলকে আল্ডো জানিয়ে দেয় যেন দলের প্রত্যেক সদস্য তাকে ১০০ জন জার্মানের খুলির চামড়া কেটে এনে দেয়।

এই জার্মানরা রাতে যখন ঘুমাবে, তখন তাদের মনের মধ্যে যখন অত্যাচারের ভয় তাদের তাড়িয়ে বেড়াবে, ঐ ভয়ের উৎস যেন আমরা হই।
– লেফটেনেন্ট আল্ডো রেইন

দল গড়ছে আল্ডো রেইন; Image Source: Taskandpurpose,com

 

মুভির দ্বিতীয় চরিত্র হিসেবে বলতে হবে শশানার কথা। অভিনয় করেছেন মেলানি লরা। এই শশানাই সেই ছোট মেয়ে যে কর্নেল হান্স লান্ডার আক্রমণ থেকে বেঁচে ফিরেছিল। পরিচয় বদলে শশানা এখন ফ্রান্সে এক থিয়েটারের মালিক। এখানে ফ্রেডরিক জোলার নামের একজন সৈন্য শশানার সাথে প্রেমে জড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে যে কি না নাৎসি সৈন্যদলের হয়ে লড়াই করেছে। যুদ্ধে তার বীরত্বের কাহিনী এতই ছড়িয়ে পড়ে যে একজন পরিচালক তার বীরত্বগাঁথা নিয়ে সিনেমা বানাতে চায় এবং মূল চরিত্রেও এই সৈনিকই অভিনয় করে। যেহেতু জার্মানির বীরত্বগাঁথা নিয়ে ছবি তাই হিটলারকেও আমন্ত্রণ জানানো হয় এখানে। শশানা তাই তার পরিবার হারানোর ক্ষোভ থেকে হিটলার আর তার কর্নেল হান্স লান্ডাকে মারার পরিকল্পনা করতে থাকে।

হিটলারের আগমনের প্রাক্কালে শশানা নিজের থিয়েটার প্রস্তুত করছে
হিটলারের আগমনে থিয়েটার প্রস্তুত করছে শশানা Image Source:Fanpop.com

আরেকটি চরিত্র, যার কথা না বললেই নয়, সেটি কর্নেল হান্স লান্ডা। একই সঙ্গে সদাহাস্য, ভদ্র, বন্ধুসুলভ কিন্তু নির্মম, চতুর, পাশবিক এই চরিত্রটি এই ছবির অন্যতম মূল চরিত্র বললেও ভুল হবে না। তার ডাকনাম দ্য জিউ হান্টার  অর্থাৎ ইহুদি শিকারি। হিটলারের নির্মমতা নিয়ে বলার কিছু নেই। এই ছবিতে কর্নেল হান্স লান্ডার নির্মমতা হিটলারকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন ক্রিস্টফ ওয়াল্টজ। এই চরিত্রের জন্য ২০১০ সালে অস্কার পেয়েছেন এই অভিনেতা।

ইহুদি শিকারি হিসেবে জার্মান অন্য সৈনিকদের সাথে আমার পার্থক্য হলো আমি একজন ইহুদি যেভাবে চিন্তা করে সেভাবে চিন্তা করতে পারি, কিন্তু বাকি সৈনিকরা কেবল জার্মানদের মতোই ভাবতে পারে।
– কর্নেল হান্স লান্ডা

ছবির প্রথম দৃশ্যে লাপাদিতের ঘরে কর্নেল লান্ডা; Image Source: viewfromsofa.com

টারান্টিনোর সিনেমা মানেই অন্য রকম কিছু। একটি যুদ্ধবিষয়ক ছবিতে আমরা যেমন দেখে থাকি গোলাগুলি হচ্ছে, যুদ্ধবিমান বোমা হামলা করছে, সৈন্য মারা যাচ্ছে, এই মুভিতে সেই তুলনায় তেমন গোলাগুলির দৃশ্য খুবই কম। বেশিরভাগ সময়ই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সংলাপগুলোকে। ছোটখাট বিবরণের দিকে বেশি লক্ষ্য করা হয়েছে মুভিটিতে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রথম দৃশ্যে কাজে ব্যস্ত লাপাদিত যখন কাজে ব্যস্ত তখন দূরে সৈন্য বহর দেখে কিছুটা ভীত হয়ে নিজেকে আসন্ন বিপদের জন্য তৈরি করে নেয়া, কিংবা জার্মানদের প্রতি, বিশেষ করে কর্নেলের প্রতি, তীব্র ঘৃণা থাকা সত্ত্বেও শশানার তার সাথে স্বাভাবিক কথা বলে যাওয়া। কর্নেলের মধ্যে তীব্র নিষ্ঠুরতা থাকা সত্ত্বেও সে যেভাবে মানুষকে হাস্যরস বা গল্পের মাধ্যমে আসর মাতিয়ে তোলে আবার প্রয়োজনে সে যেভাবে ঠান্ডা মাথায় হাসিমুখে হত্যাযজ্ঞের নির্দেশ দেয় এ ব্যাপারগুলোর জন্য ওয়াল্টজ এবং তাকে এভাবে তৈরি করার জন্য টারান্টিনো দুজনই অসাধারণ ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে।

সেটে কোয়েন্টিন টারান্টিনো; Image Source: New York Times

গল্প যতই এগিয়েছে, সময়ের সাথে চরিত্রগুলো গড়ে উঠেছে এবং গল্প এগোনোর সাথে তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হচ্ছিলো। তবে কিছু কিছু চরিত্র অপ্রয়োজনীয় ছিল। গল্পে তাদের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না, শুধুমাত্র পর্দায় উপস্থিতি বাড়ানো ছাড়া। এছাড়া ছবির সিনেমাটোগ্রাফি ছিল অসাধারণ। দৃশ্যগুলোর আলোকসজ্জা, প্রয়োজনীয় ফ্রেম পরিবর্তন, এঙ্গেল ধারণ- সবকিছুই ছিল অনেক বেশি ভালো।

This is bengali movie review article on 'Inglorious Bastards'.

Related Articles

Exit mobile version