– লুক অ্যাট দ্য স্কাই! ইজ ইট অ্যা বার্ড?
– ইজ ইট অ্যা প্লেইন?
– নো, ইটস সুপারম্যান।
মেট্রোপলিসের আকাশে, লাল-নীল কস্টিউমে সুপারম্যানকে উড়তে দেখে সবাই এভাবেই বিস্মিত হয়েছিল। সেই বিস্ময় এখনো ম্লান হয়ে যায়নি। শৈশবের একটা সময়ে আমরা অনেকেই হতে চেয়েছি সুপারম্যান, কাঁধে কাপড় জড়িয়ে করেছি তার মতো করে আকাশের উড়ার অভিনয়।
১৯৩৮ সালে অ্যাকশন কমিকসের প্রথম ইস্যুর রঙিন পাতায় সুপারম্যানের প্রথম আবির্ভাবের পর থেকে কেবল কমিকস পড়ুয়াদের মনেই জায়গা করে নেয়নি বরং সুপারহিরো নামের ভিন্ন এক ধারার জন্ম দিয়েছে। সুপারম্যান না থাকলে, হয়তো আজকে আমরা এত সুন্দরভাবে সুপারহিরোদের পেতাম না। প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে সুপারম্যান টিকে আছে আশা, সততা এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে। তাইতো সৃষ্টির ৮০ বছর পরেও চরিত্রটি এখনো সমান জনপ্রিয় সবার মাঝেই।
চরিত্রটির সৃষ্টির গল্প
পপ কালচারের জগতে আজ তুমুল জনপ্রিয় এই সুপারহিরোদের পথিকৃৎ সুপারম্যানের স্রষ্টা ক্লিভল্যান্ডের জেরি সিগাল ও জোয়ি শাস্টার। জেরোম এবং জোয়ি দুজনের জন্মই ১৯১৪ সালে। সিগালের জন্ম ক্লিভল্যান্ডে হলেও তার পরিবার রাশিয়া থেকে অভিবাসিত। ডাচ-ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত শাস্টার পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন কানাডার টরন্টোতে। তার পরিবার যখন ক্লিভল্যান্ডে চলে আসেন, তখন তিনি ভর্তি হন গ্লেনভাইল হাই স্কুলে। সেখানেই তার পরিচয় জেরি সিগালের সাথে। দুইজনই ছিলেন লাজুক স্বভাবের এবং দুজনেরই আগ্রহ ছিল অ্যাডভেঞ্চার আর সায়েন্স ফিকশন সম্বলিত পাল্প ম্যাগাজিন যেমন- অ্যামেজিং স্টোরিজ, উইয়ার্ড টেলস এবং পত্রিকায় প্রকাশিত কমিকে; বিশেষ করে বাক রজার্স, টারজান ও পাপাই। তাই বন্ধুত্ব সৃষ্টি হতে সময় লাগেনি। তারা প্রথম একসাথে কাজ করেন স্কুলের নিউজপেপারে, যেখানে জেরি গল্প লিখেছিলেন এবং জোয়ি ছবি এঁকেছিলেন। সেখান থেকেই শুরু দুজনের কমিকস নিয়ে স্বপ্ন দেখা। তবে সেই স্বপ্নে কিছুদূর আগানোর আগেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় ১৯২৯ সালের মহামন্দা।
জীবিকার তাগিদে জেরি ও জোয়ি দুজনেই ঠিক করলেন সায়েন্স ফিকশন লিখবেন। কিন্তু তাদের গল্প কোন প্রকাশনীই ছাপাতে রাজি হয়নি। শেষে ১৯৩২ সালের অক্টোবরে তারা নিজেরাই একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন নাম- সায়েন্স ফিকশন। সেই ম্যাগাজিনের তৃতীয় ইস্যুতে তারা একটি গল্প প্রকাশ করেন, দ্য রেইন অফ দ্য সুপার-ম্যান নামে।
তবে এই সুপার-ম্যান আমাদের চিরপরিচিত সুপারম্যান ছিল না। প্রথম সংস্করণটি টাক মাথার এক উন্মাদ, যে তার টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা দিয়ে পুরো বিশ্বে রাজত্ব করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভিলেন এই সুপার-ম্যান কোন সাড়াই ফেলতে পারেনি, কারণ তখনও পাঠকরা এমন একটি চরিত্রের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
এরপর জেরি চরিত্রটিকে নিয়ে আরো ভাবতে লাগলেন, কেমন হতো যদি তাদের সুপারম্যানের ক্ষমতাগুলো টেলিপ্যাথির পরিবর্তে হারকিউলস বা স্যামসনের মত শারীরিক হত এবং সে তার এসব ক্ষমতাগুলো মানুষের উপকারে ব্যবহার করত। দুজনে মিলে পুরো চরিত্রটিকেই পুরাণ এবং পপকালচারের সংমিশ্রণে নতুনভাবে সাজিয়ে নিলেন। জোয়ি তাকে সার্কাস অ্যাক্রোব্যাটদের মত কস্টিউম দিলেন। সুপারম্যান পরিণত হলো পৃথিবীতে আশ্রয় নেয়া এক শরণার্থী, যে বহুদূরের এক গ্রহ থেকে এসেছে। সে তার সুপারম্যান পরিচয় সবসময় গোপন রাখে। তাই তার আরেকটি পরিচয় ছিল, ক্লার্ক কেন্ট। যে একজন নম্র স্বভাবের রিপোর্টার। সে মেট্রোপলিস (ফ্রিৎস ল্যাং পরিচালিত মেট্রোপলিস সিনেমা অবলম্বনে এই শহরের নাম নেয়া হয়) শহরের ডেইলি স্টার (যেটা পরবর্তীতে পরিবর্তন করে ডেইলি প্ল্যানেট করা হয়) পত্রিকায় কাজ করে। অবশেষে জেরি ও জোয়ি মৌলিক একটি চরিত্র সৃষ্টি করতে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও কোন প্রকাশনীই সুপারম্যানের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি। তাদের বেশিরভাগের মন্তব্যই ছিল সুপারম্যান কাঁচা হাতের কাজ; কেউই এমন কারো গল্প পড়তে চাইবে না যে, কেইপ পরে এক দালান থেকে আরেক দালানে লাফিয়ে বেড়ায়।
১৯৩৫ সালে জেরি এবং জোয়ি কমিকবুক রাইটার এবং আর্টিস্ট হিসেবে জায়গা করে নেন ন্যাশনাল এলাইড পাবলিশিংয়ে, যা তাদের ডিটেকটিভ কমিকসের সফলতার পর, পরবর্তীতে পরিণত হয় ডিসি কমিকসে। ১৯৩৮ সালে ডিসি কমিকস সিদ্ধান্ত নেয় তারা অ্যাকশন কমিকস নামে নতুন কমিকবুক সিরিজ প্রকাশ করবে। সেই সিরিজের জন্য তাদের একজন প্রধান চরিত্রের প্রয়োজন ছিল। সৌভাগ্যবশত, তারা সেই চরিত্রটির জন্য সুপারম্যানকে বেছে নেয়। সেই বছরের জুন মাসেই নিউজস্ট্যান্ডে আসলো অ্যাকশন কমিকসের প্রথম ইস্যু, জেরি আর জোইয়ের অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণ করে কমিকসের রঙিন পাতায় আবির্ভাব হলো সুপারম্যানের!
সুপারম্যান নামকরণের পিছনে খুব সম্ভবত বড় ভূমিকা জর্জ বানার্ড শ’য়ের নাটক- ম্যান এন্ড সুপারম্যান। কারণ এরপরেই সুপারম্যান শব্দটি পপ কালচার হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে এই শব্দটির প্রয়োগ প্রথম দেখা যায় জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিটশের প্রবন্ধ ‘Also Sparch Zarathusra’তে। সে প্রবন্ধে জার্মান শব্দ Übermensch কে অনেক ইংরেজ অনুবাদক সুপারম্যান হিসেবে অনুবাদ করেন।
সুপারম্যানের ভালোবাসার মানুষ লইস লেন নামটি নেয়া হয়েছিল অভিনেত্রী লোলা লেনের নাম অনুসারে। চরিত্রটি সৃষ্টি করা হয় গ্লেন্ডা ফেরেল অভিনীত টর্চি ব্লেন অনুকরণে। আর লইস লেনকে আঁকা হয় জোলান কোভ্যাকস নামক এক মডেলের অনুকরণে, পরে যিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন জোয়ান কার্টার। কিছুদিন পর তিনি জেরি সিগ্যালের সহধর্মিণী হন। জোয়ান সিগাল বলেছিলেন তিনি জোয়ি শাস্টারকে দেখেছিলেন সুপারম্যানের কিছু ছবি আঁকতে, যেখানে মডেল হিসেবে ছিলেন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জেরি সিগাল। আবার ক্লার্ক কেন্টের পেশা হিসেবে রিপোর্টার বেছে নেয়া হয় যেটা ছোটবেলায় জেরির স্বপ্ন ছিল।
এক হিরোর উত্থানের গল্প
ঘটনার শুরু পৃথিবী থেকে অনেক দূরের এক গ্রহে। ক্রিপ্টন নামের সেই গ্রহটি ছিল প্রযুক্তিগত দিক থেকে পৃথিবী থেকে অনেক এগিয়ে। সেই গ্রহের বাসিন্দা জর-এল বুঝতে পেরেছিলেন গ্রহটির কোর ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে খুব দ্রুতই ক্রিপ্টন ধ্বংস হয়ে যাবে। জর-এলের আগেও একই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, কিন্তু সেগুলো সত্য হয়নি দেখে এবার আর কেউ তার কথা বিশ্বাস করেনি। আবার একই কাজ করায় ক্রিপ্টনের পরিচালনা পর্ষদ হল অফ সায়েন্স থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়।
কিন্তু এবার জর-এলের কথা সত্য হলো, ক্রিপ্টন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে এলো। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। জর এল নিজের সবকিছুকেই বিসর্জন করতে প্রস্তুত ছিলেন তার সন্তান ক্যাল-এলের জন্য। তাই একটি স্পেসশিপে করে তাকে জর-এল এমন একটি গ্রহে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, যেটার হলুদ সূর্য এবং তুলনামূলক কম মাধ্যাকর্ষণ বল তাকে অন্যান্য ক্রিপ্টোনিয়ান থেকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে।
জর-এলের অশ্রুসিক্ত স্ত্রী লারার একমাত্র সন্তানকে সেই স্পেসশিপে একা এই মহাশূন্যে দিতে মন মানছিল না। কিন্তু জর-এল তাকে বলছিলেন, এটাই একমাত্র আশা, কারণ সে যদি এই গ্রহে থাকে অন্য সবার মত তাকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হবে। এদিকে শিশু ক্যাল-এলের কোন ধারণাই ছিল না কী হতে চলেছে। লারা নিজের কান্না সামলাতে পারছিলেন না। শেষবারের মত যখন নিজের সন্তানের কপালে চুমু দিচ্ছিলেন, তার চোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছিল।
ক্রিপ্টন একদিকে ধ্বংস হচ্ছিলো, অপরদিকে ক্যাল-এলের স্পেসশিপ ছুটে চলছিল মহাকাশে। বিদায়ের আগে লরার মনে একটাই আশা, তার সন্তান যেন একটি পরিবার খুঁজে পায়, ভালোবাসায় যেন সে বেড়ে উঠে। মায়ের আশা সত্যি হলো।
এদিকে ক্যানসাসের স্মলভিলের এক দম্পতি জনাথন এবং মার্থা কেন্ট কিছুদিন আগেই তাদের গর্ভের সন্তানকে হারিয়েছেন। মার্থা এজন্য মানসিকভাবে বেশ ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি তার এই অভাব পূরণের জন্য সুদূর কোন গ্রহ থেকে কেউ একজন আসছে। একরাতে কেন্ট দম্পতি দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর একটি দিন কাটিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ আকাশে আলোর ঝিলিক দেখা গেল যেটা দেখে মনে হয়েছিল কোন উল্কাপাত। যখন সেটি মাটিতে আছড়ে পড়লো মার্থা ছুটে গেলেন সেটি কী ছিল তা দেখতে। কিন্তু যখন সে দেখলো তখন সে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারেনি। হাসিখুশি একটি শিশু একটি অদ্ভুত স্পেসশিপের মধ্যে, হাত বাড়িয়ে যেন তাকে ডাকছে।
মার্থা সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেননি। আনন্দের অশ্রুতে সিক্ত চোখে সে শিশুটিকে দেখছিলেন। যখন তিনি শিশুটির কপালে চুমু দিচ্ছিলেন, সেই কপালে অন্য কারো অশ্রু অনুভব করতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারলেন এই শিশুটিকে কেউ ভালোবাসতো। তাই মার্থাও তার সমস্ত ভালোবাসা দিতে চাইলেন শিশুটিকে। যার ফলে কেন্ট দম্পতির ভালোবাসায় ক্লার্ক কেন্ট হিসেবে পৃথিবীতে বড় হয়ে উঠতে লাগলো ক্যাল-এল।
কেন্ট দম্পতি এক সময় বুঝতে পারলেন এটি কোন সাধারণ শিশু নয়। যতই দিন গড়াচ্ছিল ক্লার্কের নতুন নতুন সব ক্ষমতা তাদের সামনে আসতে লাগল। তবে সেসব ক্ষমতা যতটাই ভীতিকর অথবা অসাধারণ হোক না কেন, তারা সবসময়ই ক্লার্ককে সঠিক পথটিই দেখিয়েছেন। তারা তাকে শিখিয়েছেন মানুষকে ভালোবাসতে, তার সব ক্ষমতা নিয়ে অহংকার নয় বরং মানুষের উপকার করতে।
ক্লার্ক স্মলভিলের ছোট ফার্মটিতে বাবা-মায়ের সাথে সুখেই দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু একদিন রোড এক্সিডেন্টে ক্লার্ক হারায় তার মা মার্থাকে। জনাথনও খুব বাজেভাবে আহত হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনি ক্লার্ককে বলেন, ক্লার্কের মত সুন্দর ক্ষমতা এ পৃথিবীতে কারো নেই। তাই ক্লার্ক যেন এই ক্ষমতাকে ভালোকাজে ব্যবহার করে। সে যেন এ পৃথিবীটাকে আরো সুন্দর করে তুলে।
পিতা-মাতাকে হারিয়ে কিছুটা সময় শোঁকে কাটানোর পর ক্লার্ক বুঝতে পারে তাকে কি করতে হবে। এখন তার পাশে কেউ নেই, কিন্তু তার বাবা-মা তাকে যা শিখিয়েছে তা তার একমাত্র সম্বল। তাকে সে মানুষটি হতে হবে যা তার দুই বাবা মা চেয়েছিল। তাকে তার ক্ষমতাগুলো ব্যবহার করে একজন ভাল মানুষ হতে হবে। তারপর ক্লার্ক পরিণত হয় সুপারম্যানে। তবে সে তার পরিচয় সবসময় গোপন রাখে। ক্লার্ক কেন্ট হয়ে ডেইলি প্ল্যানেটের নিউজ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করে আর সুপারম্যান হয়ে পৃথিবীকে বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করে।
উপরে বর্ণিত গল্পটি সুপারম্যানের নিউ ৫২ কমিক অরিজিন স্টোরি থেকে নেয়া। এর আগেও অনেক লেখক বিভিন্নভাবে ক্যাল-এলের সুপারম্যান হয়ে উঠার গল্প বলেছেন। সবগুলোতেই অল্প কিছু পরিবর্তন চোখে পরে।
অন্যসব সুপারহিরোদের মত সুপারম্যান কখনো মুখোশ পড়ে না। কারণ তার বিশ্বাস মুখোশ পড়ে সে মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে না। কিন্তু দুটি ভিন্ন পরিচয়ে চলাফেরা করতে তাকে অবশ্যই ছদ্মবেশের আশ্রয় নিতে হয়। চশমা পড়া সে ছদ্মবেশেরই অংশ।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে যে কেন সুপারম্যানকে চশমা পড়লে চেনা যায়না। এর কারণ চশমা তার একমাত্র ছদ্মবেশ না। সুপারম্যান দুটি চরিত্রকে এমনভাবে আলাদা রাখে যে কেউ কখনোই সেটি মাথাতেই আনতে পারে না। ক্লার্ক কেন্ট সবসময়ই অপ্রস্তুত, কিছুটা ভীতু, সে কিছুটা ঝুঁকে থাকে, নরম কণ্ঠে কথা বলে আর এমন জামাকাপড় পড়ে যাতে তার পেশিবহুল শরীর বোঝা না যায়। আর বিভিন্ন সময়ে সুপারম্যান যেভাবে তার সম্পর্কে সবকিছু বিভিন্ন মিডিয়ায় বলেছে, তাই কেউ কখনো ভাবেই না যে সুপারম্যানের কোন গোপন পরিচয় থাকতে পারে। তাই ক্লার্ক কেন্ট যে সুপারম্যান এটা কারো মাথাতেই আসে না। তবে একটা সময় কমিকে অনেক অদ্ভুত ক্ষমতার সাথে সম্মোহন করার ক্ষমতাও ছিল সুপারম্যানের, যার মাধ্যমে সে নিজের পরিচয় গোপন রাখত। তবে এখন সেটি আর দেখা যায়না।
সুপারম্যানের রয়েছে একগাদা অসাধারণ ক্ষমতা। যদিও প্রথমদিকে দ্রুত গতিতে চলা, বেশ শক্তিশালী এবং লম্বা লাফ দেয়া বাদে আর কোন ক্ষমতা ছিল না। হ্যাঁ, প্রথমদিকে সুপারম্যান উড়তে পারত না। আবার তখন হলুদ সূর্য থেকে শক্তি পাওয়ার বিষয়টিও ছিল না। তার এত ক্ষমতা পাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ক্রিপ্টোনিয়ানরা যৌবনে উপনীত হবার পর দানবীয় কিছু শক্তি পেয়ে থাকে। হলুদ সূর্যের বিষয়টি আসে সিলভার এজে (১৯৫০-১৯৭০ সাল)। তারপর যোগ হতে থাকে হিট ভিশন, এক্স-রে ভিশন, ফ্রিজিং ব্রেথ, হিপনোটিজম, ভেন্ট্রিকুইলিজম, টেলিকাইনেসিস, শক্তিশালী ইন্দ্রিয়, হিলিং পাওয়ার, সুপার ওয়েভিং। সে সময়টাতে সুপারম্যান ছিল অপ্রতিরোধ্য, শত আঘাতেও তার কিছু হত না। তবে তার দুর্বলতা ছিল ক্রিপ্টোনাইটে। সে টাইম ব্যারিয়ারও ভাঙতে পারত, যেটার মাধ্যমে একবার সে অতীতে চলে গিয়েছিল। এতসব ক্ষমতার কারণে সুপারম্যান অনেকটাই ঐশ্বরিক চরিত্র ছিল, তাই ব্রোঞ্জ এজে (১৯৭০ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত) সুপারম্যানের ক্ষমতাগুলো অনেকটাই কমিয়ে আনা হয়। মডার্ন এজেও সুপারম্যানের সুপার স্পিড, হিট ভিশন, এক্স-রে ভিশন, ফ্রিজিং ব্রেথ এসব ক্ষমতা ছিল। তবে তার অপ্রতিরোধ্য থাকার ক্ষমতা কমিয়ে আনা হয়, যার প্রয়োগ দেখা যায় ডেথ অফ সুপারম্যান গল্পে। আর ২০১৫ সালের ম্যান অফ স্টিল কমিকসে তাকে নতুন ক্ষমতা দেয়া হয়, সুপার ফ্লেয়ার। যার মাধ্যমে সুপারম্যান মধ্যে জমে থাকা সকল শক্তি সোলার ফ্লেয়ার রূপে ছেড়ে দিতে পারে। তবে এরপর সুপারম্যান তার সব ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং একদিন সূর্যস্নানের পর আবার সবকিছু ফিরে পায়।
কমিকস ছাড়িয়ে অন্যান্য মাধ্যমে সুপারম্যান
সুপারম্যান কমিকসের পাতায় প্রকাশের পরপরই তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। আর পত্রিকায় প্রকাশের সাথে সাথে যখন ২ কোটিরও বেশি মানুষের কাছে সুপারম্যান পরিচিত হয়ে উঠে, কমিকসের পাতা ছাপিয়ে সুপারম্যান চলে যায় অন্যান্য মাধ্যমে। যেমন প্রথম প্রকাশের দুই বছরের মাথাতেই দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ সুপারম্যান নামের রেডিও প্রোগ্রাম পায়, যা প্রচারিত হয়েছিল এগারো বছর ধরে। এদিকে ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত ১০ মিনিট দৈর্ঘ্যের ১৭ টি অ্যানিমেটেড শর্ট ফিল্ম মুক্তি পায়। ১৯৪৮ সালে প্রথম লাইভ অ্যাকশন সুপারম্যান হিসেবে কার্ক অ্যালেনকে ১৫ পর্বের সুপারম্যান সিরিয়ালে দেখা যায়। এরপর ১৯৫১ সালে সুপারম্যান প্রথমবারের মত বড় পর্দায় আসে সুপারম্যান এন্ড দ্য মোল ম্যান সিনেমাতে।
সেই সিনেমাতে সুপারম্যান হিসেবে অভিনয় করেন জর্জ রিভস। পরের বছরেই জর্জ রিভস সুপারম্যানকে রঙ্গিন পর্দায় নিয়ে আসেন দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ সুপারম্যান টিভি সিরিজে। ছয় সিজনের সেই সিরিজটি তখন বেশ জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু জর্জ রিভসের মৃত্যুর পর সিরিজটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আবার এনিমেশনের পর্দায় আসে সুপারম্যান। সুপার ফ্রেন্ডস নামের সেই অ্যানিমেটেড সিরিজটি প্রায় ১৩ বছর ধরে প্রচারিত হয়। জর্জ রিভসের মৃত্যুর ২০ বছর পর প্রথমবারের মত বড় বাজেটের সিনেমাতে দেখা যায় সুপারম্যানকে। রিচার্ড ডোনারের পরিচালনায় ৫৫ মিলিয়ন ডলার বাজেটের সেই সিনেমাতে ক্রিস্টোফার রিভ সুপারম্যান হিসেবে থাকেন। এছাড়াও জিন হেকম্যান, মার্লন ব্র্যান্ডো, মার্গট কিডারের মত তারকারা ছিলেন সেই সিনেমায়। এ সিনেমাটি সে বছরের তিনটি ক্যাটাগরিতে অস্কারে মনোনয়ন পায়। এরপর আরো তিনটি সিকুয়েল মুক্তি পায়। প্রথম তিনটি সিনেমার স্ক্রিনরাইটার হিসেবে মারিও পুজো ছিলেন।
সুপারম্যান সিরিজের চতুর্থ সিনেমাটি বক্স অফিসে ব্যর্থ হবার পর জন নিউটন অভিনীত সুপারবয় সিরিজের মাধ্যমে আবার ছোট পর্দায় ফিরে আসে। ১৯৯৩ সালে ডিন কেইনের লইস এন্ড ক্লার্ক: দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চারস অফ সুপারম্যান মোটামুটি বড় বাজেটের সিরিজ ছিল। চার সিজনের এই সিরিজটি বিটিভিতেও প্রচারিত হত। এরপর ১৯৯৬ সালে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের মাধ্যমে আসে জনপ্রিয় সুপারম্যান: দ্য অ্যানিমেটেড সিরিজ।
নাইন/ইলেভেনের হামলার পর পৃথিবীতে যে একজন সুপারম্যান প্রয়োজন সেটি জানান দিতেই যেন, এর এক মাস পর টিভিতে প্রচার শুরু হয় আধুনিক সময়ের সুপারম্যানকে নিয়ে নির্মিত স্মলভিল টিভি সিরিজটি। ২০০১ সালে আরো আসে কমিক ফ্যানদের প্রিয় অ্যানিমেটেড সিরিজ জাস্টিস লীগ। খুবই ভাল মানের গল্প এবং চরিত্রদের সাজিয়ে তোলার জন্য সিরিজটি এখনো বেশ জনপ্রিয়। ২০০৬ সালে ২০ বছর পর আবার বড় পর্দায় আসে সুপারম্যান। ব্র্যান্ডন রুথ অভিনীত সুপারম্যান রিটার্নস সিনেমাটি যতটা আশা করা হয়েছিল ততটা সাড়া ফেলতে পারেনি। যার কারণে এর কোন সিকুয়েল পাইনি আমরা। এর ৭ বছর পর বড় পর্দায় দেখা যায় হেনরি কেভিল অভিনীত এবং জ্যাক স্নাইডার পরিচালিত সুপারম্যানকে নিয়ে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ সিনেমা ম্যান অফ স্টিল। এ সিনেমাতে আরো ভালোভাবে ক্রিপ্টন ধ্বংস এবং ক্লার্ক কেন্টের সুপারম্যান হয়ে উঠা ভালোভাবে তুলে ধরা হয়। এদিকে ততদিনে ডিসি তাদের নতুন সিনেম্যাটিক ফ্র্যাঞ্চাইজির পরিকল্পনা করে ফেলে। যার ফলে সুপারম্যান হিসেবে হেনরি কেভিলকে আরো দুটি সিনেমাতে দেখা যায়, ব্যাটম্যান ভার্সাস সুপারম্যান:ডন অব জাস্টিস (২০১৬) এবং জাস্টিস লীগ (২০১৮)। ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া শ্যাজাম মুভিতেও তার ছোট একটি ক্যামিও ছিল। সিডাব্লিউ এর অ্যারোভার্সেও সুপারম্যানকে দেখা যায়, যেখানে সুপারম্যান হিসেবে অভিনয় করেন টাইলার হোয়েচিন।
কমিকসের পাতায় আগমনের পর এই ৮০ বছরে সুপারম্যানের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। তবে তার ন্যায়পরায়ণতা এবং মানবিক মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়নি। ব্যাটম্যানের মত সেও কাউকে হত্যায় বিশ্বাসী না। সুপারম্যান চাইলেই তার ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবী শাসনের স্বপ্ন দেখতে পারত, সে পারত তার সব প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধুলোয় মিটিয়ে দিতে। কিন্তু সুপারম্যান একটি ফার্মে দুজন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কিছু অসাধারণ শিক্ষা পেয়েছে। সে জেনেছে তার ক্ষমতাগুলো সুন্দর, এই সুন্দর ক্ষমতা দিয়ে সে পৃথিবী টাকে আরো সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারবে। সুপারম্যান তার ক্রিপ্টোনিয়ান বাবা-মা থেকে যা পেয়েছে তার মধ্যে সে S এর মত দেখতে চিহ্নটিকে সবসময় তার বুকে ধারণ করে। এই চিহ্নটির অর্থ আশা। সে এই পৃথিবীর মানুষের কাছে আশার এক প্রতীক।
বই ও সিনেমা সম্পর্কিত চমৎকার সব রিভিউ আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/