আর নয় ঝাড়ফুঁক, তুকতাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, বিখ্যাত সাইকোলোজিস্ট, ড. আহমেদ করিম এবার আপনার যাবতীয় সমস্যার সমাধান করবেন। মানসিক/আধিভৌতিক/ভৌতিক সমস্যা নিয়ে চলে আসুন। সমাধান নিশ্চিত। বিফলে মূল্য ফেরত।
আহমেদ করিম। পেশায় একজন সাইকোলজিস্ট। অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে থাকেন পুরানা পল্টন এলাকায়। একতলা একটা বাড়িতে থাকেন একা, নিঃসঙ্গ। তবে নিভৃতচারী নয় লোকটা। কেননা, পত্রিকার পাতায় উপরিউক্ত ভাষায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের প্রচার করতে তার ভালো লাগে। আর অদ্ভুত সব কেস নিয়ে তদন্ত করাটা তার নেশা ও পেশা। মানব মন অত্যন্ত জটিল আর রহস্যময়। সেসব জটিল রহস্যের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দেয়াটাই মূলত আহমেদ করিমের কর্ম।
এক দুপুরবেলা সেরকমই এক অদ্ভুত কেস নিয়ে হাজির হয় নেত্রকোনার জমিদার গোছের এক লোক। কেননা, সোনার দাঁত আর দামী পাথরের আংটি পরা মানুষ এই জমানায় তেমন একটা নেই বললেই চলে।
চৌধুরী আজিজুল গণি। একসময় তাদের জমিদারী ছিল নেত্রকোনা এলাকায়। বর্তমানে নেই, তবে হাবভাবটা এখনও রয়েই গেছে। মা মরা একমাত্র মেয়েকে নিয়ে চৌধুরী আজিজুল গণি বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছেন। নাহ! ঠিক সুখে নয়। কেননা, সুখে থাকলে তিনি আহমেদ করিম সাহেবের কাছে কেন আসলেন? তার একটা সমস্যা আছে। সেই সমস্যার সমাধানেই এসেছেন আহমেদ করিম সাহেবের কাছে। গণি সাহেবের রাতে ঘুম হয় না; হলেও মোটে এক ঘণ্টা। আরো অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, সপ্তাহের সাত দিনে নিয়ম মেনে সাতটা স্বপ্ন দেখেন গণি সাহেব। নিয়মের কোনো হেরফের হয় না। প্রতিটি স্বপ্নই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন, যেজন্য ঘুমাতেও ভয় পান তিনি।
এষা চৌধুরী। আজিজুল গণি সাহেবের একমাত্র সন্তান। মা মরা মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই একা একা থাকে। এতবড় বিশাল জমিদার বাড়িতে একা থাকতে থাকতে মেয়েটা একদম অন্যরকম হয়ে গেছে। সারাদিন বাসায় থাকে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের মনের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে মেয়েটা। গণি সাহেবের না বলা পাঁচটি স্বপ্ন শুনতেই সহকারী সোহেল আহমেদকে নিয়ে নেত্রকোনা ছুটে যান আহমেদ করিম। আর সেখানেই এষা তাকে এই অদ্ভুত ক্ষমতার কারসাজি দেখায় প্রথমবারের মতো। আহমেদ করিম বিপাকে পড়ে যান। অন্ধকারে একদল ছায়া এসে তার টুঁটি চেপে ধরে। জীবনে প্রথমবারের মতো ব্যাখ্যাতীর শক্তির কবলে পড়ে মারাত্মক ভয় পান। ঠিক সেই সময়ই এষা জানায়- তার আসল নাম রূপকুমারী।
চৌধুরী আজিজুল গণির বাকি পাঁচটি স্বপ্ন শোনার উদ্দেশ্যে নেত্রকোনা গিয়েছিলেন আহমেদ করিম। কিন্তু গণি সাহেব তার চেম্বারে যাবার কথা অস্বীকার করেন। কেন? উপরন্তু, এষা চৌধুরী, যে কিনা তার একমাত্র সন্তান, নিজেকে রূপকুমারী নামে পরিচয় দেয়। কে এই রূপকুমারী? আর তার সেই অদ্ভুত ক্ষমতার ব্যাখ্যা কী? চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে আহমেদ করিমের সহকারী সোহেল আহমেদ যে ঝোপের আড়ালে শিংওয়ালা, রক্তলাল চক্ষুর শুকনো এক সত্তাকে দেখতে পায়, সে আসলে কে? নাকি সোহেলের মনের ভ্রম? শেষমেশ কী হয়? আহমেদ করিম কি এই কেসের সমাধান করতে পারে? নাকি সে নিজেই এই ঘোর রহস্যের জঞ্জালে আটকে যায়?
মানুষ যখন ভয় পায়, বিভ্রমের সৃষ্টি হয় তখন।
– শরীফুল হাসান
জানতে হলে পড়তে হবে ১৬০ পৃষ্ঠার আধিভৌতিক ঘরানার উপন্যাস রূপকুমারী ও স্বপ্নকুহক। সমসাময়িক জনপ্রিয় লেখক শরীফুল হাসান রচিত বইটি ইতিমধ্যেই পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে নিয়েছে। আহমেদ করিম তার সৃষ্ট এক চরিত্র যাকে নিয়ে এর আগেও টুকটাক ছোটগল্প লেখা হয়েছে। পাঠকদের অনুরোধেই আহমেদ করিমকে এই পরিসরে টেনে নিয়ে আসা। তাই বলা চলে, বাংলা সাহিত্যে আহমেদ করিমের যাত্রা হলো শুরু। বইটির প্রচ্ছদের কাজ করেছেন সজল চৌধুরী। মূল গল্পের আধিভৌতিক আবছায়ার মতোই বইয়ের প্রচ্ছদ পাঠকদের মন কাড়বে নিঃসন্দেহে।
শরীফুল হাসান। ময়মনসিংহেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশুনার পাঠ চুকিয়েছেন। বেসরকারি একটি সংস্থায় বর্তমানে কর্মরত। লেখালেখির শুরু অনুবাদের মাধ্যমে। ডার্কলি ড্রিমিং ডেক্সটারের মতো বিশ্বনন্দিত বই অনুবাদ করেছেন তিনি। কিন্তু অনুবাদে ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। তাই জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে লিখে ফেললেন মৌলিক উপন্যাস। সাম্ভালা বের হলে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পান লেখক।
আর সেই সুবাদেই সাম্ভালা ট্রিলজি হিসেবে প্রকাশ পায়। সাম্ভালার জনপ্রিয়তা ওপাড় বাংলা অবধি আছে বিধায়ই, সেখান থেকেও প্রকাশ পেয়েছে সিরিজটি। এমনকি বইটি ইংরেজিতেও অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও, ‘ছায়াসময়’ এর মতো নস্টালজিক সামাজিক থ্রিলার তাকে সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে দারুণ পাঠকপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। এছাড়া আঁধারের যাত্রী, মেঘ বিষাদের গল্প। জনারণ্যে একা কয়েকজন এবং অন্ধকার যাদুকর- তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। কিশোর উপন্যাস অদ্ভুতুড়ে বইঘর লিখে ২০১৬ সালে অর্জন করেছেন কালি ও কলম সাহিত্য পুরষ্কার।
শরীফুল হাসানের লেখনশৈলী চমৎকার। ছোট ছোট শব্দ বুনে বাক্য গঠন করেন। তারপর সেই বাক্যগুলোকে ছোট ছোট করে একের পর এক স্থান দেন; যেমন একটা কেকে বিভিন্ন স্তর থাকে তেমন। এতে গল্পের ধারাবাহিকতা আর গতি ঠিক থাকার পাশাপাশি লেখা থাকে প্রাঞ্জল আর প্রাণবন্ত। পড়ে তাই আরাম পায় পাঠক।
সব কথার জবাব সাথে সাথে দিতে নেই। তাহলে সত্যি-মিথ্যার মীমাংসা হয়ে যায় সহজেই।
– শরীফুল হাসান
আধিভৌতিক বা এই ধরনের সাইকোলোজিক্যাল বইয়ের ক্ষেত্রে ভয়কে ভিন্ন রূপে উপস্থাপন করতে হয়। কেননা, এই ধরনের উপন্যাসে লেখকের উদ্দেশ্যই থাকে পাঠককে গল্পের গহিনে নিয়ে গিয়ে ভয় দেখানোর। পাঠককে গল্পটাকে কেবলই পড়ানোই নয়; বরং অনুভব করানোই থাকে লেখকের উদ্দেশ্য। শরীফুল হাসান এই বইয়ে খুব বেশি একটা ভয়ের বর্ণনা দেননি। তা সত্ত্বেও, পুরো বই জুড়েই একটা গা ছমছমে ভাব ছিল। ভয় জাগানিয়া একটা অনুভূতি কাজ করে বইয়ের গল্পে। হুট করে অনস্তিত্বের কিছু একটা দৃশ্যপটে চলে আসা; রগরগে আর ভয়ানক দৃশ্যের অবতারণা ব্যতিরেকেই ভয়ের একটা গা ছমছমে আবহ তৈরি করা; বাস্তব আর অবাস্তবের এক দুর্বল সীমানায় নিয়ে গল্পকে দাঁড় করানো- এসব ব্যাপারে বেশ ভালোই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন শরীফুল হাসান।
শুরু থেকেই লেখক এমন এক গল্পের পরিবেশ তৈরি করেছেন যাতে পাঠক একদম মজে যায়। গল্পের আবহ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে পাঠক শেষ করার আগ অবধি এক ঘোরলাগা পরিবেশের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করবে। এক রতির গল্পটা ডালপালা বিস্তার করে কখন যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় তা টের পাওয়া মুশকিল। কিন্তু গল্পের উপসংহারে সেসব গল্পকে একসুতোয় গেঁথে দিতে অনেকটাই সক্ষম ছিলেন লেখক। অনেকটাই বলার কিছু কারণ অবশ্য আছে। গল্প শেষেও অনেক কিছুই রয়ে যায় ব্যাখ্যাহীন। তবে এসব নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করতে গেলে স্পয়লারের ভয় থাকে বিধায় করা গেল না। আবার, যেহেতু আহমেদ করিম একটি সিরিজের অংশ, সেহেতু এমনও হতে পারে যে পরের কোনো বইয়ে হয়তো লেখক ব্যাখ্যা দেবেন বলে তুলে রেখেছেন।
আবার, চরিত্র গঠনে লেখক মুন্সিয়ানার পাশাপাশি কিছু চরিত্রের খামতিও নজরে পড়ে। যেমন- মূল চরিত্রের এতটাই প্রাধান্য ছিল যে পার্শ্ববর্তী চরিত্রগুলো অনেকটাই ম্লান হবার পথে ছিল। রূপকুমারী বা এষা চৌধুরীর রহস্যময়ী চরিত্র সম্পর্কে পাঠকের জানার আগ্রহ রয়েই যাবে। যদিও শেষে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি জীবনীর ছোঁয়া আছে; তা-ও পাঠক তো, আকাঙ্ক্ষা তো থাকবেই। এছাড়া সোহেল আহমেদ সহকারী হিসেবে খুব একটা কাজে আসেনি। তবে আবারও বলতে হচ্ছে, সিরিজের পরবর্তী বইগুলোতে হয়তো সোহেল আহমেদকে আরো কার্যকরী করে তুলবেন লেখক।
প্রেমিকের ধর্ম এটাই। তারা প্রেম ছড়াতে চায়। প্রেম এক জায়গায় থাকে, সে বহমান নদীর মতো।
– শরীফুল হাসান
একদিকে চৌধুরী আজিজুল গণি চরিত্রকে যেভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে লেখক, তা সত্যিই বাহবা পাওয়ার যোগ্য। একইসঙ্গে মূল চরিত্র আহমেদ করিমও দুর্দান্ত ছিলেন। লেখক আহমেদ করিমকে খুব বেশি বয়স্ক দেখাননি; কিন্তু তাকে জ্ঞানের দিক থেকে বয়স্কের একটা ছাপ দিয়েছেন মাত্র। আহমেদ করিমকে খুব বেশি কাল্পনিক একটা চরিত্র হতে দেননি লেখক, বরং রক্ত-মাংসের মানুষের মতোই অতীতের স্মৃতিতে আবেগে ভাসার সুযোগও দিয়েছেন। এজন্যই আহমেদ করিমকে প্রাণবন্ত, জীবন্ত আর বাস্তব বলে বিশ্বাস করাটা খুব বেশি কঠিন হয় না পাঠকের কাছে। এছাড়া, পুরো গল্পজুড়ে অশরীরী আত্মার মতো ঘুরে বেড়ানো পার্শ্বচরিত্র বাচ্চু- খুব দক্ষ হাতে গড়া এক চরিত্র। বাচ্চু যেমন অনেক রহস্যের জট পাকায় গল্পে, তেমনই রহস্যের সমাধানও বাচ্চুর কারণেই ঘটে।
সাইকোলোজিক্যাল, আধিভৌতিক অথবা মনস্তাত্ত্বিক ঘরানার উপন্যাসের কথা উঠলে চলে আসে হুমায়ুন আহমেদ সৃষ্ট চরিত্র মিসির আলীর কথা। কেননা, মিসির আলীর পূর্বে এমন কোনো চরিত্র এতটা পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। তাই পাঠক মিসির আলীর চালচালন, হাবভাব, এমনকি তার মনের অবস্থা বুঝতেও অনেকটা সক্ষম হয়ে উঠেছিল। সেই সুবাদেই বর্তমানে সাইকোলোজিক্যাল কোনো উপন্যাস লেখাটা নিঃসন্দেহে দারুণ চ্যালেঞ্জের একটা বিষয়। কেননা, লেখক নিজে মিসির আলীর চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত হলেও হতে পারেন। আর সেক্ষেত্রে একদমই ভিন্ন একটা চরিত্র দাঁড় করানো অনেক মুশকিল।
শরীফুল হাসান সেই চ্যালেঞ্জকে বেশ দারুণভাবে গ্রহণ করেছেন। তবে তা যে পরিপূর্ণভাবে উতড়ে গিয়েছেন সেটা বলা যাবে না। আহমেদ করিমের মধ্যে পাঠক মিসির আলীর ছাপ পেলেও পেতে পারেন। হয়তো চালচলন নয়; দুয়েকটা ভাবভঙ্গি; অথবা কথাবার্তায়। কিন্তু তা-ও আহমেদ করিম অনেক স্বতন্ত্র একটা চরিত্র। আরো স্বতন্ত্র হয়ে উঠবে সময়ের আবর্তে। মিসির আলী গড়তে যে সময়টা দেয়া হয়েছে, সেই একই সময় আহমেদ করিমেরও দরকার। কেননা, যেকোনো সিরিজের একটা চরিত্র দাঁড় করানোর জন্য কয়েকটা উপন্যাসের দরকার পড়ে। ফুল যেমন ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়, তেমনি চরিত্রের বিকাশের জন্যও দরকার সময়।
মিসির আলীর পর অনেকটা সময় ধরে এই ধরনের একটা চরিত্রের অভাবই মূলত আহমেদ করিমের উপর মিসির আলীর ছায়া ফেলে দেয়। আবার, একইসঙ্গে এই অভাবের পূর্ণতাও আহমেদ করিমের হাত ধরে আসবে বলেই আশা করা যায়। লেখকের কাছে তাই পাঠকের অনুরোধ রয়ে যায়, আহমেদ করিম যেন আরো শক্তিশালী হয়ে নিজেকে দাঁড় করানো সুযোগ পায়। হেলায় মিসির আলীর ছায়াতলে যেন হারিয়ে না যায়।
বই: রূপকুমারী ও স্বপ্নকুহক
লেখক: শরীফুল হাসান
প্রচ্ছদ: সজল চৌধুরী
প্রকাশনী: অবসর প্রকাশনা সংস্থা
মলাট মূল্য: ৩০০/- টাকা মাত্র