বিশ্বসাহিত্যে রয়েছে চারটি জাত মহাকাব্য— ইলিয়ড, ওডেসি, রামায়ণ, ও মহাভারত। শেষোক্ত দুটি, অর্থাৎ রামায়ণ ও মহাভারত হচ্ছে সংস্কৃত ভাষায় রচিত। এ দুটি প্রাচীন ভারতের মহাকাব্য। রামায়ণে বলা হয়েছে রাম-সীতার কাহিনী। আর মহাভারতে বলা হয়েছে প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত পৌরাণিক রাজা ভরতের বংশধরদের কাহিনী।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌরাণিক তিনটি উপন্যাসের প্রথম উপন্যাস শকুন্তলার কথা নিশ্চয়ই পাঠকের মনে আছে। বইটি সম্পর্কে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। সেখানে দুষ্মন্ত নামক এক রাজা তপোবনে শিকারে গিয়ে শকুন্তলা নামক এর রূপসীর প্রেমে মজেছিল। রাজা দুষ্মন্ত সেই রূপসী শকুন্তলাকে বিয়ে করে তপোবনেই কাটিয়েছিলেন কিছুদিন। এর কিছুদিন পরে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার ঔরসে জন্ম নিয়েছিল ভরত নামক এক সন্তান। যে পরবর্তীতে দুষ্মন্তের উত্তরাধিকারী হিসেবে ভারতের রাজা হন।
মহাভারত হলো সেই শকুন্তলা-পুত্র ভরতের বংশধরদের কাহিনী। মূল মহাভারত বইটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। কিন্তু তা ক’জন পড়ে বা বুঝে? বাংলায় প্রথম মহাভারত অনুবাদ করেন কাশীরাম দাস, তারপর আরো অনেকে লিখেছেন। কিন্তু সেসব বুঝে ওঠা সাধারণ পাঠকের পক্ষে অনেক সময় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে, ছোটদের জন্য তো আরো কঠিন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই যেমন বলে উঠেছিলেন, “কাশীরাম দাস বাবু আরেকটু সহজ করে লিখলেন না কেন?“
যা-ই হোক, একসময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই ছোটদের জন্য সহজবোধ্য করে মহাভারত লেখায় হাত দিলেন, উপন্যাস আকারে, শেষ বয়সে এসে; নাম— আমাদের মহাভারত। উপন্যাস শুরুর আগে প্রকাশকের নিবেদন অংশে যেমনটি বলা হয়েছে, ‘মহাভারতের কাহিনী চিরন্তন। সেই কাহিনীই ছোটদের জন্য সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাষায় বলেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।’ যা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল আনন্দমেলা পত্রিকায়।
কিন্তু দুঃখের বিষয়— উপন্যাসটি শেষ করার আগেই সুনীল মৃত্যুবরণ করেন। তবুও মহাভারতের সম্পূর্ণ কাহিনী যাতে পাঠকের সামনে থাকে সেই উদ্দেশ্যে আনন্দমেলা পত্রিকা নিজে থেকে উদ্যোগ নেয় লেখাটি শেষ করার। সংক্ষেপে বাকি কাহিনী জুড়ে দিয়ে সুনীলের লেখা অসমাপ্ত ‘আমাদের মহাভারত‘ সমাপ্ত করে তারা। পত্রিকায় প্রকাশিত সেই উপন্যাস পরবর্তীতে বই আকারে ‘আমাদের মহাভারত’ নামে প্রকাশিত হয়।
মহাভারত নিয়ে লেখকের শৈশবের স্মৃতি দিয়েই শুরু উপন্যাস। লেখকের ভাষায়,
‘আমি যখন বেশ ছোট, তখন আমার দাদিমার মুখে প্রায়ই একটা কথা শুনতাম, যা নেই ভারতে, তা নেই মহাভারতে… শৈশবে মূল মহাভারতের বাংলা অনুবাদ আমি যে কতবার পড়েছি তার কোনো শেষ নেই’
এরপর বেশ কিছু প্রেক্ষাপট পেরিয়ে লেখক প্রবেশ করেন মহাভারতের মূল ঘটনায়।
মহাভারত বলতেই আমরা পঞ্চপাণ্ডব আর কৌরবদের দ্বন্দ্বের কাহিনীগুলো বুঝি। কিন্তু এসব ছাড়াও এতে রয়েছে অসংখ্য রাজ-রাজড়া আর মুনি ঋষিদের কথা। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, পঞ্চপাণ্ডব আর কৌরবদের দ্বন্দ্বমুখর কাহিনী এই বইয়ের প্রাণ। সে কারণেই সুনীলের আমাদের মহাভারত উপন্যাসের বড় অংশ জুড়ে পঞ্চপাণ্ডব আর কৌরবদের দ্বন্দ্ব উঠে এসেছে। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বের যুগে যাওয়ার আগে পাণ্ডব আর কৌরবদের বংশ বৃত্তান্ত লেখক প্রথমেই সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন। যযাতি-দেবযানী, দুষ্মন্ত-শকুন্তলা, ভরত, শান্তনু, দেবব্রত, ভীষ্মের মত বহুল আলোচিত পৌরাণিক চরিত্রগুলো উপন্যাসের শুরুতেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বৃহস্পতি, শুক্রাচার্য, কচ, বিশ্বমিত্র, বেদব্যাসের মত দৈবিক শক্তিগুলোর প্রাসংগিকতাও উপন্যাসের প্রথমে তুলে ধরা হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে মহাভারতের মূল কাহিনীতে প্রবেশ করেছেন লেখক। এর মাঝে অপ্রাসঙ্গিক গল্প, দৈববানী, শাস্ত্র, ধর্মবাণীসমূহ লেখক সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। মূল কাহিনীর সাথে প্রাসঙ্গিক গল্পগুলোই কেবল উঠে এসেছে শুরুতে।
লেখক উপন্যাসটির মাধ্যমে মহাভারতের কাহিনীকে ছোটদের জন্য বোধগম্য করে তোলার চেষ্টা করেছেন। সেই কারণে শুরু থেকেই উপন্যাসটি লেখক গল্পচ্ছলে বলে গেছেন। বড়রা ছোটদের কান্না থামাতে কিংবা ঘুম পাড়াতে যেভাবে সহজ-সরল সাবলীল ভাষায় গল্প বলেন অনেকটা সেভাবে। সেই কারণে ছোটদের পাশাপাশি নবীন মহাভারত পাঠকদের জন্যও উপন্যাসটি সমান উপযোগী।
মহাভারত একটি প্রাগৈতিহাসিক রচনা। সেই হিসেবে নানা গল্প, চরিত্র ও সময়ের বর্ণনায় অসংখ্য বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান সেখানে। রয়েছে অনেক অস্বাভাবিকতাও। লেখক গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সে বৈসাদৃশ্য ও অস্বাভাবিকতাগুলোকে তুলে ধরেছেন। চেষ্টা করেছেন কাহিনী যতটা সম্ভব বাস্তবিক করে তোলার, মানবিক করার। সময়ের অস্বাভাবিক সংখ্যা নিয়ে উপন্যাসের এক জায়গায় যেমনটি বলা হয়েছে, ‘মহাভারতে কথায়-কথায় এক হাজার বছর, দশ হাজার বছর বলা হয়। তা বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি। আমরা তো এখন জানি, মানুষ অতদিন বাঁচে না। তাই শূন্যগুলো কয়েকটা কমিয়ে নিতে হবে।’ বোঝাই যাচ্ছে— উপন্যাসটিতে লেখক নিরবচ্ছিন্ন গল্প বলেই ক্ষান্ত হননি।
পঞ্চপাণ্ডব আর কৌরবদের উত্থানের প্রেক্ষাপট আলোচনা করেই লেখক মূল কাহিনীতে প্রবেশ করেন। পঞ্চপাণ্ডবদের জম্ম বৃত্তান্ত, কৌরবদের সাথে দ্বন্দ্ব, আগুন, ষড়যন্ত্র, বনবাস, রাক্ষস বধ, ছদ্মবেশ, সর্বোপরি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পেক্ষাপট তৈরির গল্প নিয়ে এগোতে থাকে উপন্যাসের কাহিনী।
মহাভারতের ক্লাইমেক্স অবশ্যই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। সুনীলের আমাদের আমাদের মহাভারত উপন্যাসটি একসময় সেই ক্লাইমেক্সে প্রবেশ করে। ঘটনাবহুল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চিত্র যখন একে একে পাঠকের সামনে উঠতে আসতে থাকে, তখন হঠাৎ করে উপন্যাসের গতি থমকে দাঁড়ায়। “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের মহাভারত এই পর্যন্ত লিখেছিলেন। পাঠকের কৌতূহল মেটাতে ‘আমাদের মহাভারত’-এর বাকি অংশটুকু সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হলো‘। এ জায়গায় এসেই সুনীলের কলম থেমে গিয়েছিল। বাকি কাহিনীগুলো আনন্দমেলা পত্রিকা সংক্ষেপে তুলে ধরে আমাদের মহাভারত উপন্যাসের ইতি টেনেছে।
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, শিখণ্ডী খাড়া করা, অশ্বত্থামা হতঃ ইতিগজ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মত অসংখ্য প্রবাদ প্রবচন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহুল প্রচলিত। গল্পের ফাকে ফাঁকে সে প্রবাদ প্রবচনগুলো সৃষ্টির প্রেক্ষাপট আমাদের মহাভারত উপন্যাসে উঠে এসেছে। মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্র— ভীষ্ম, অর্জুন, ভীম, যুধিষ্ঠির, দুর্যোধন, দ্রোন, কর্ণ স্বাভাবিকভাবে আমাদের মহাভারত উপন্যাসেরও প্রধান প্রধান চরিত্র। নারী চরিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কুন্তী, মাদ্রী, দ্রৌপদী। এদের মধ্যে দ্রৌপদী ছিলেন পঞ্চপাণ্ডবদের একমাত্র স্ত্রী, অর্থাৎ পাঁচ ভাইয়ের এক স্ত্রী। দ্রৌপদী মহাভারতে একটি বিখ্যাত চরিত্র। তার রূপ, লাবণ্য, সাহসিকতার কথা তুলে ধরার ক্ষেত্রেও সুনীল দারুণ দক্ষতা দেখিয়েছেন।
মহাভারতে লক্ষাধিক শ্লোক রয়েছে। রয়েছে দীর্ঘ গদ্যাংশ। শব্দসংখ্যা প্রায় আঠারো লক্ষ। এটি আয়তনে ইলিয়াড ও ওডিসি কাব্যদ্বয়ের দশগুণ এবং রামায়ণের চারগুণ। কাশিরাম দাস অনূদিত অনুবাদটিও ছোট নয়। এতে রয়েছে শত শত চরিত্র। এমন একটি মাহাকব্যেকে ১৩৬ পৃষ্ঠার একটি উপন্যাসে গ্রন্থবদ্ধ করা সহজ ব্যাপার নয়। বিক্ষিপ্ত চরিত্রগুলোর মাঝে সমন্বয় করে একে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য করে গল্পকে একমুখী করার কাজ নিঃসন্দেহে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু যেটুকু লিখেছেন তাতেই তিনি কৃতিত্বের সাথে এ চ্যালেঞ্জটুকু জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাকি অংশটুকুও হয়ত আরো সুন্দর হয়ে উঠতো যদি তা সুনীল নিজের হাতে শেষ করে যেতে পারতেন।