‘আদমসুরাত’ নাম দিয়ে এখানে আদিম রূপটার দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। কার আদিম রূপ? পুরুষের। সে যেভাবে তার লিবিডো বা যৌনকামনা/তাড়না দ্বারা চালিত হয়, সেই রূপের কথাই বলা হচ্ছে এখানে। তার ভেতরে যে লালসার পশু বাস করে, তারই বয়ান এই উপন্যাস। পুরুষের প্রকৃতি নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে একটু পড়লেই; তা স্পষ্টত বোঝা যায়। ওই তাড়নার হাত ধরেই তো এত নৈরাজ্য, এত অশান্তির সূত্রপাত। পুরুষতান্ত্রিকতার যে এত বড়াই, তা তো টিকে আছে লিবিডোর ক্ষেমতাতে! কটু লাগলেও সত্য।
এই গল্পে পুরুষদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সুপন নামক এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ। চাকরিতে তার উন্নতির গ্রাফ তলানীতে। সংসারে গুণবতী এক আদর্শ বউ আছে, যাকে সুপন ভালোবাসে। আর আছে তাদের ফুটফুটে সন্তান। সংসারের হাল যখন এমন বেহাল, স্ত্রী তখন সুপনসহ গেল এক জ্যোতিষীর কাছে। সংসারে কোকিল আসিবার সমূহ কোনো সম্ভাবনা বেঁচে আছে কিনা, তাহা জানিবার নিমিত্তে। জ্যোতিষীর চেম্বারে গিয়েই সুপনের চোখাচোখি হলো এক সুন্দরী রমণীর সহিত। আরে! একে যে সে চেনে! ফেসবুকে এই মেয়ের সাথেই তো তার ভাব বিনিময় হয়! সুপনের আরেকটি রূপ তখন উন্মোচিত হবার দ্বারপ্রান্তে। জ্যোতিষীর মুখোমুখি যখন সে বসলো, তখনই গিয়ে বোমাটা ফাটলো কিংবা লাড্ডু ফুটলো।
জ্যোতিষী তার হাত দেখেই বললো, নিজ হাতে তার অর্থযোগ হবে না। তবে শীঘ্রই তার কপাল ঘুরে যাবে। শুনে উৎসুক হয়ে উঠলো সুপন। খানিক পরেই জ্যোতিষী বললো, সেই উন্নতি সম্ভব হবে সুপনের স্ত্রী মারা যাওয়ার মধ্য দিয়ে। সুপন আঁতকে উঠলো। বউয়ের মৃত্যু উন্নতি কীভাবে বয়ে আনবে? এর পরপরই জ্যোতিষী বললো; স্ত্রীর মৃত্যুর পর সুপনের প্রথম প্রেমিকার সাথে সুপনের বিয়ে হবে, যাকে সে প্রথম চুমু খেয়েছিল। সেই মেয়েরও স্বামী আছে এবং সেই স্বামীও মারা যাবে। এরপর তাদের দুজনের বিয়ে হবে এবং সুপনের ভাবনাতীত অর্থপ্রাপ্তি ঘটবে! ওটাই শুরু।
স্ত্রী মারা যাবে এই ভেবে সুপনের দুঃখ হয়। কিন্তু প্রথম প্রেমিকাকে কাছে পাবে, অর্থপ্রাপ্তি ঘটবে- এই ভাবনায় সুপন পুলকিত হয়। সেদিন থেকেই বউয়ের দোষ চোখে পড়তে শুরু তার। বউয়ের হাঁটায় দোষ, কন্ঠে দোষ, পিঠ দেখিয়ে শোয়ায় দোষ। সবকিছুতেই শুধু দোষ। আর প্রতি দোষের পিঠে সে শুধু ভাবতে থাকে তার প্রথম প্রেমিকা রিনু যখন বউ হবে, এমন পরিস্থিতিতে রিনু কী করবে। ঘরে খাবার কিছু না থাকলেও, রিনু নিশ্চয় তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কিছু একটা বানিয়ে নেবে কিংবা অন্তত আদরসোয়াগ দেবে, যা রেখা কিছুতেই দিতে পারে না। এই ভেবে ভেবে সুপন আরো দাঁত কিড়মিড় করে। বউ কবে মরবে, সেই অপেক্ষায় থাকে।
বিছানাতেও সে রিনুর কথাই ভাবে। এর মধ্যে রিনুর সাথে যোগাযোগও করে ফেলে সুপন। সুযোগ নেয় রিনুর বিষণ্নতার। হাজার হোক, কিছুদিন পরেই তো বউ হবে। সুপনের চোখের ভয় জ্যোতিষীর সাথে কথা বলার দিন থেকেই কেটে গেছে। সে এখন বাসার কাজের মেয়ের উন্নত বুকের দিকেও চোখ বাড়ায়। কামনা করে তার শরীর। সে ফেসবুকের বন্ধু আফসানার সাথেও ভাব জমায় আরো গভীরভাবে। এসবের মাঝে অর্থকষ্ট তাকে পর্যুদস্ত করে; কিন্তু থাক, সয়ে যাবে, ক’দিন বাদেই অর্থ, নারী সবই প্রাপ্তি ঘটবে! তাই কি?
লেখক মাইনুল এইচ সিরাজীর এই উপন্যাসের গল্পসংক্ষেপ পড়েই বোঝা যায়, শ্লেষাত্মক এক উপন্যাস এটি। আসলেই তাই। একটি ব্ল্যাক-কমেডি এবং স্যাটায়ারে পূর্ণ উপন্যাস ‘আদমসুরাত’। যেখানে পুরুষের লিবিডো নিয়ন্ত্রণে রাখবার অক্ষমতা আর তার কামুকতা নিয়ে পাতায় পাতায় বিদ্রুপ করা হয়েছে। উপন্যাসে সুপন শুধু একজন ব্যক্তি নয়, সে পুরুষ গোষ্ঠীরই প্রতিনিধিত্ব করে। আহা… কী পরিহাসের ব্যাপার তা!
সুপন নিজের পশুত্ব ঢাকে এই বলে, জ্যোতিষীই তো তার মাথায় এই চিন্তা ঢুকিয়েছে। এতেও মিশে আছে শ্লেষ। কারণ পুরুষ যে নিজের দোষকে এভাবেই হালাল করতে চায়। সে শিশুর মতো কোমল থাকতে চায়। শুধু কামুকতা জেগে উঠলেই মাথা ঠিক থাকে না আর কী! জ্যোতিষী শুধু তার মনের গভীরে যে বাসনা লুকনো, সেটাকেই দেখিয়েছে। কামুক পুরুষ তো শুধু এই অনুমোদনই চায় তার সকল পাপ, অপরাধ হালাল করতে। সুপনও তা-ই। সে তো এক জায়গায় বলে, “নারীর জন্ম হয়েছে পুরুষের মন আর শরীরের ক্ষুধা বুঝবার জন্য। পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য নারী আবশ্যক নয়। আচ্ছা, যদি এমন হতো- পেটের জন্যও নারী লাগতো? দুনিয়ার কায়দাকানুন ওলটপালট হয়ে যেত তাহলে!“
পুরুষের মনস্তত্ত্ব, বিশেষ করে বাঙালী পুরুষের মনস্তত্ত্বকে শ্লেষের চূড়ান্ত রূপে প্রকাশ করা হয়েছে এই অংশে। আরেক জায়গায় সে বলে, “রেখা যদি অনুমতি দিত, আমিও আরেকটা বিয়ে করতাম। আমার বাঘকে নানাবিধ হরিণ খাওয়াতে পারতাম। চিত্রাহরিণ, মায়াহরিণ। কিন্তু রেখা অনুমতি দিবে না। না দিলেই বা কী? বাঘকে কি আমি বিচিত্র খাবার থেকে বঞ্চিত রাখতে পারি?”
পুরুষের এই নারীলোভ, এই বিকৃত স্বভাব, এই কামুকতাকে পদে পদে বিদ্রুপ করেছেন আর নিটোল হাস্যরসে বেধেছেন লেখক। মানে নিজেদের চিন্তার, নিজেদের স্বভাবের বিশ্লেষণ সুপনের মধ্য দিয়ে পড়তে গিয়ে নিজেদেরই যে হেসে ওঠা- এর চেয়ে ভয়ংকর বিদ্রুপ, ধ্বজভঙ্গ লজ্জা, ছুরির মতো তীক্ষ্ণ পরিহাসের বিষয় আর কী-ই বা হতে পারে! সুপনের মতো ওই ভদ্রতার মুখোশের প্রলেপ সবারই আছে। শুধু কেউ একটু সরিয়ে দেখলেই কেল্লাফতে!
স্যাটায়ার বা বিদ্রুপধর্মী লেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি যেটা; বিদ্রুপ ও বক্তব্য সাহসী কিনা, ধারটা আছে কিনা- তার সবকিছুই এই গল্পে আছে। মাইনুল এইচ সিরাজীর গদ্যের এই সুতীব্র ধার এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর এমন সিরিয়াস এক বিষয়কে নিগূঢ় হাস্যরসের মাধ্যমে প্রকাশ করাটা সহজ কথা নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা হয়, সিরিয়াসনেস ভোঁতা হয় নয়তো হাস্যরস খটখটে হয়, এই বইয়ে তার কোনোটিই হয়নি। সিরাজীর বয়ানে দুটো বিপরীত টোনের এমন সমতা প্রশংসনীয়। ‘স্ট্রিম অব কনশাসনেস’-এর প্রথা মেনে সুপনের মধ্য দিয়ে পুরুষের মনস্তত্ত্বকে তিনি যেভাবে প্রকাশ করেছেন তাতে অ্যাকুরেসি (মনস্তাত্ত্বিক দিকের সঠিক বিশ্লেষণে, যা আবার বইয়ের শেষ পাতায় ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছে), ডিটেল এবং ইনসাইট সবই ছিল। সুঢৌল গদ্যে লেখা; বাহুল্যবর্জিত। এবং ডিটেইল ব্যবহারের দিক থেকে অত্যন্ত পরিমিত স্বভাবের গদ্য। বয়ানভঙ্গীমা স্ট্রেইটফরোয়ার্ড হওয়ায় গল্পও তরতর করে এগিয়ে গেছে, উপভোগ্যতা ধরে রেখে।
মাইনুল এইচ সিরাজী ‘আদমসুরাত’ উপন্যাসে, পুরুষের মনস্তত্ত্ব আর চারিত্রিক বিশ্লেষণকে যেভাবে শ্লেষের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন তা একইসাথে সাহসী এবং (নানাবিধ অলংকার, বক্তব্য পাল্টে দেবার ক্ষেত্রে) সাবভার্সিভ।