১৯৬৯ সাল, স্থান আফ্রিকা। অভিনেত্রী টিপ্পি হেড্রেন তার তৎকালীন স্বামী নোয়েল মার্শালের সাথে কাজ করছিলেন আফ্রিকার এক ফিল্ম সেটে। এমন সময় তারা এক পশুর খামারে একদল সিংহ দেখতে পান। সিংহগুলির আক্রমণে খামার মালিক খামারটি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। হেড্রেনের স্বামী মার্শাল ছিলেন একজন হলিউড এজেন্ট ও পশু অধিকার কর্মী। সেদিন পরিত্যাক্ত সেই খামারে সিংহগুলোকে দেখে মার্শালের মাথায় নতুন একটি সিনেমা তৈরির আইডিয়া আসে। তিনি ঠিক করেন আফ্রিকা থেকে ফিরেই আফ্রিকার দিন দিন কমতে থাকা এই সিংহদের নিয়ে সচেতনতা মূলক একটি সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করবেন তিনি। কিন্তু তখনও তিনি বুঝতে পারেননি তার লেখা সেই স্ক্রিপ্টের চিত্রায়ন জন্ম দেবে চলচ্চিত্র দুনিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত, দুর্ভাগ্যজনক ও ভয়বহ এক সিনেমার।
সিনেমাটির নাম হলো ‘রোর (Roar)’, আর এর শুটিং শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। সিনেমাটির প্রধান চরিত্রে ছিলেন টিপ্পি হেড্রেন। প্রধান চরিত্রের পাশাপাশি পুরো সিনেমাটিতেই হেড্রেনের পরিবারের নানা সদস্যরা অভিনয় করেছিলেন। তার স্বামী মার্শাল, তাদের দুই পুত্র জন আর জেরি এবং তাদের কন্যা মেলানি গ্রিফিথ এই সিনেমাতে অভিনয় করেন। সিনেমাটিতে দেখা যায়, আফ্রিকার একস্থানে সিংহ সহ নানা হিংস্র প্রাণীর দেখাশোনা করেন এক আমেরিকান ব্যক্তি। তার পরিবার হঠাৎ একদিন তার সাথে দেখা করতে আসলেই ঘটে যত বিপত্তি। তার পরিবারের সদস্যরা আবদ্ধ একস্থানে সিংহ ও নানা বন্যপ্রাণীর আক্রমণের শিকার হন।
এ তো গেলো সিনেমার গল্প। কিন্তু এমন গল্পের একটি সিনেমা বানাতে হলে প্রয়োজন অনেক পোষা সিংহ। তাই, প্রথমেই হেড্রেন ও মার্শাল নানা পশু প্রশিক্ষকদের কাছে ঘুরতে লাগলেন। কিন্তু চাইলেই তো কেউ আর মুভির জন্য ত্রিশ-চল্লিশটি সিংহ ভাড়া দিতে পারেন না। ফলে কিছুটা হতাশ হতে হলো মার্শাল দম্পতিকে। তবে হাল ছেড়ে দিলেন না তারা। বরং কয়েকজনের পরামর্শে নিজেরাই এই হিংস্র পশু রাখা ও তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা একটি সিংহের বাচ্চা সংগ্রহ করলেন এবং এটি কখন কেমন আচরণ করে তা পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলেন।
সিংহের বাচ্চাটির নাম দেওয়া হলো ‘নেইল’ এবং তারা এটিকে তাদের সাথে তাদের বাসাতেই রাখতে শুরু করলেন। কিন্তু, আপনি ঘরের মধ্যে একটা জলজ্যান্ত সিংহ পোষা শুরু করলে তাতে আপনার আপত্তি না থাকলেও আপনার বাসার আশেপাশের মানুষ ভয়ে আধমরা হয়ে যেতে পারে। আর ঠিক এমনটাই ঘটলো মার্শালদের ক্ষেত্রে। প্রতিদিনই আশেপাশের বাড়ি থেকে সিংহটি সরিয়ে ফেলার জন্য অভিযোগ আসতে লাগলো। ফলে হেড্রেন এবং মার্শাল খুব শীঘ্রই তাদের এই সিংহটিকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন। তারা লস এঞ্জেলসে একটি খামার কিনলেন এবং সেখানে সিংহটিকে নিয়ে গেলেন। তবে এত বড় জায়গায় শুধু একটা সিংহ, কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হলো মার্শাল দম্পতির কাছে। ফলে তারা প্রায় এক ডজনের মতো সিংহ, বাঘ এমনকি কয়েকটি আফ্রিকান হাতি এনে পোষা শুরু করলেন সেই খামারে। দূর থেকে তাদের সেই খামারটি দেখে একটি চিড়িয়াখানা বলেই মনে হতো। আর এই স্থানেই শ্যুট করা হয় সর্বকালের বিপদজনক ও ভয়াবহ মুভি ‘রোর’।
মুভির শুটিং যখন শুরু হয় তখন মুভির যে যে শটে সিংহ রয়েছে সেগুলোকে বেশ কয়েকবার করে নানা ক্যামেরায় নানা এঙ্গেলে ধারণ করা হয়। প্রায় একশোর বেশি মানুষ এই মুভির সেটে কাজ করেন এবং প্রায় ১৫০টির মতো অ-প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিংহ, বাঘ, চিতাবাঘ এই মুভিতে ব্যবহার করা হয়। শুরুতে মুভিটির শুটিং ৯ মাসে শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও এর শুটিং শেষ করতে লেগে যায় প্রায় পাঁচ বছর! আসতে থাকে নানা বাধা। সেই সাথে মুভির অভিনেতা অভিনেত্রী ও কর্মীদের কাছে নানা রকম আঘাত ও জখম প্রতিদিনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এই সিনেমায় কাজ করেছেন অথচ কোনো আঘাতের শিকার হননি এমন কাউকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এখন চলুন জেনে নেওয়া যাক এই মুভি বানাতে গিয়ে কাকে কিরকম খেসারত দিতে হয়েছিল। কেনই বা এটি সবচেয়ে বিপদজনক মুভি হিসাবে পরিচয় লাভ করলো। প্রথমেই আসা যাক মুভির সিনেমাটোগ্রাফার, জেন ডি বন্টের কাছে। এই মুভিতে কাজ করতে গিয়ে তার মাথার খুলির চামড়া অর্ধেক তুলে নেয় এক সিংহ। ফলে ২২০টি সেলাই নিতে হয় তাকে। প্রধান অভিনেত্রী হেড্রেনের একটি পা ভেঙ্গে যায় এই মুভিতে কাজ করতে গিয়ে। একটি দৃশ্যে একটি হাতির পিঠে চড়া অবস্থায় হাতিটি তাকে ফেলে দেয়। ফলে মাথায় আঘাত পান তিনি। এখানেই শেষ নয়, দুর্ঘটনাবশত কাঁধে একটি সিংহের কামড়ও খান তিনি। এই দৃশ্যটি দেখতে পাওয়া যাবে মুভিতেও। হেড্রেনের সুন্দরী কন্যা গ্রিফিথ যে কিনা হলিউডের একজন সফল অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলেন তাকেও সিংহের আক্রমণের শিকার হতে হয়। তার গোটা মুখমন্ডলে ৫০টি সেলাই নিতে হয়। সেই সাথে চেহারায় ফেসিয়াল রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি করতে হয় তাকে। তার একটি চোখ হারানোর মতো অবস্থাও হয়েছিল একসময়। যদিও শেষমেশ চোখটি হারাতে হয়নি তাকে।
মুভিটির পরিচালক ও প্রধান পরিকল্পনাকারী মার্শালও বহুবার সিংহের আক্রমণের শিকার হন। এক দুর্ঘটনায় একটি চিতা থাবা বসিয়ে দেয় তার শরীরে। এসব আক্রমণের ফলে তার দেহের ক্ষতে পচন ধরে এবং পুরোপুরি সুস্থ হতে তার লেগে যায় কয়েক বছর। মার্শালের পাশাপাশি তার ভাইও আক্রমণের শিকার হন। তার পায়ের পাতা কামড়ে তুলে নেয় সিংহ। মুভির সহকারী পরিচালক ডরন কাউপারের গলায় কামড় দেয় একটি সিংহ। সেই সাথে মাথা, বুক, উরুর মতো শরীরের নানা স্থানে আঘাত পান তিনি।
শুধু বন্যপ্রাণীর আক্রমণ নয়, আরো অনেক কিছুই লেখা ছিল এই অভিশপ্ত সিনেমার কর্মীদের কপালে। মুভি শুটিংয়ের একপর্যায়ে এক বন্যা আঘাত হানে মুভির সেটের সেই খামারটিতে। ফলে ধ্বংস হয়ে যায় পুরো সিনেমার সেট এবং মারা যায় তিনটি সিংহ। ফলে চিত্রধারণের কাজে আসে বিশাল এক বাধা। ইতিমধ্যেই নানা বিপর্যয়ে অনেক সময় ব্যয় করে ফেলেছেন মুভি কর্মীরা। এই বন্যার ফলে মুভি শেষ করতে লেগে যায় আরো কয়েক বছর। তবে এত কিছুর পরও মুভিটি শেষ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন হেড্রেন ও মুভির কর্মীরা। তিনি বলেন, “আমরা সবাই মুভিটির সফলতা নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলাম। আমরা জানতাম মুভিটি সফল হবে।” তবে বাস্তবে দেখা যায় তার ঠিক উল্টোটি। মুভিটি তৈরিতে লেগে যায় প্রচুর সময় এবং ১৯৮১ সালে ইউরোপে মুভিটি মুক্তি পেলে বক্স অফিসে তেমন একটা সাড়া ফেলতে পারেনি রোর।
তবে বক্স অফিসে সাড়া ফেলতে না পারলেও ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ মুভি হিসাবে নাম লিখিয়ে ফেলে রোর। মুভি শেষে ৭০ জনের বেশি কর্মী এই মুভিতে কাজ করার সময় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে জানা যায়। মুভির বেশিরভাগ ফুটেজে এসব কর্মীদের উপর বন্যপশুর বাস্তব আক্রমণের দৃশ্যই দেখা যায়। মুভিটি নির্মাণ করতে গিয়ে ঠিক কতজন আক্রমণের শিকার হয়েছেন জানতে চাইলে অভিনেত্রী টিপ্পি হেড্রেন বলেন,
“আমি বিশ্বাস করি এই সংখ্যাটি সঠিক নয়। আমার বিশ্বাস মোট ১০০ জনের বেশি আক্রমণের শিকার হয়েছেন। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর মুভি ছিল এটি। বর্তমানে অনেক নিয়মকানুন চালু হয়েছে। এখন কেউ একজন আহত হলেই তারা চাইলে মুভি নির্মাণ কাজ বন্ধ ঘোষণা করতে পারেন।”
তিনি পরবর্তীতে তার নিজের বাসায় সিংহ পোষা নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেন। তিনি বলেন,
“নিজের বাসায় একটি সিংহ নিয়ে আসাটা ছিল সবচেয়ে বড় বোকামি। আমাদের কখনোই এত বড় ঝুকি নেওয়া উচিত হয়নি। এই প্রাণীগুলো অসম্ভব দ্রুত। আর এরা যদি ঠিক করে আপনার পিছু নিবে তবে বুলেট ছাড়া কেউ এদেরকে থামাতে পারবে না।”
সিনেমার ইতিহাসে আর কোনো মুভি নির্মাণ করতে এত মানুষ আহত হননি, এত বাধাও হয়তো আসেনি। আর এই জন্যই রোরকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ও বিপদজনক মুভি বলা হয়। ভয়াবহ এই মুভিটি ১৯৮১ সালে ইউরোপে মুক্তি পেলেও আমেরিকাতে এর মুক্তি পেতে অনেক দেরি হয়। ২০১৫ সালে এটি যখন আমেরিকায় মুক্তি পায়, তখন মুভিটির সাথে একটি ট্যাগলাইন যোগ করে দেওয়া হয়। আর সেটি ছিল-
“No animals were harmed in the making of this film. 70 cast and crew members were.”
ফিচার ইমেজ – pinterest.com