লাতিন আমেরিকা ইউরোপের চোখে একজন যুবকের মতো, যার এক হাতে গিটার, আরেক হাতে বন্দুক। সেখানকার মানুষ রোমান্টিক বিপ্লবী। তারা সারাদিন গান গেয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। আবার স্বৈরশাসকের শক্তিধর সেনাবাহিনীকে গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে চোখে সর্ষে ফুলও দেখিয়ে দিতে পারে। দারিদ্র্য এখানে সাধারণ মানুষের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু মানুষের জীবনীশক্তি দারিদ্র্যকে ছাপিয়ে উঠে গিয়েছে আরও অনেক উঁচুতে।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এই লাতিন আমেরিকারই মানুষ। লাতিন আমেরিকার নরম মাটির সোঁদা গন্ধ তার খুব চেনা। সেখানে মানুষ কিভাবে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে, তা তিনি জানেন। লাতিন আমেরিকার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কেও তার পরিষ্কার জানাশোনা আছে। লাতিন আমেরিকাকে তার চেয়ে ভালো করে বোধহয় আর কেউ চেনে না। নইলে তার লেখায় লাতিন আমেরিকার জীবন চিত্র এত নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত হয় কিভাবে?
‘কর্নেলকে কেউ লেখে না’ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের একটি উপন্যাসিকা। তার সবচেয়ে ভালো কাজগুলোর একটি। এই লেখাটিতে একজন কর্নেলের কষ্টকর দিনাতিপাতের আড়ালে তুলে ধরা হয়েছে লাতিন আমেরিকার মানুষের সহজসরল জীবনযাপন, সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থের অভাবে জীবনের টানাপোড়েনের চিত্র। যেহেতু এটি একটি উপন্যাসিকা, তাই আকারে খুব বড় নয়। কিন্তু স্বল্প আয়তনের এই লেখাতেই গোছালো বর্ণনা এবং সুস্পষ্ট জীবনবোধের মিশেল তৈরি করেছে অদ্ভুত মোহাচ্ছন্নতা, যা মার্কেজের লেখায় বরাবরই পাঠকরা পেয়ে থাকেন।
উপন্যাসিকায় মার্কেজ মানুষের আশাবাদিতা ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে। উপন্যাসিকার কর্নেলের চিঠি আসে না বহু বছর হলো। “পেনশনের চিঠিটা এসে পৌঁছালেই সমস্ত দুর্দশা লাঘব হবে”– কর্নেলের মাথায় এই চিন্তা ঘুরপাক খায় বারবার। অন্তত বুড়ো বয়সে অর্থের সংস্থান নিয়ে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তাই কর্নেল আশা নিয়ে প্রতি সপ্তাহেই বন্দরে যান। প্রতিবারই হতাশ হতে হয় তাকে।
কর্নেল গৃহযুদ্ধে লড়েছিলেন পরাজিত শক্তি পক্ষে। পরাজিত ও জয়ী পক্ষের মধ্যে যেবার চুক্তি হলো, সে চুক্তি অনুসারে তার পেনশন পাবার কথা ছিল। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সরকারের উদাসীনতায় আর চিঠি আসে না। তবুও কর্নেল অপেক্ষা করেন।
কর্নেলের সন্তান অগাস্টিনকে রাজনৈতিক নিপীড়নের অংশ হিসেবে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যু আমাদের সামনে আরেকটি বিষয় উন্মোচিত করে দেয়। ভিন্নমত দমনের জন্য সেই সময়ে ল্যাটিন আমেরিকার কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো নির্মম পন্থা অবলম্বন করতো, তারই নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে অগাস্টিনের মৃত্যুতে।
কর্নেলের স্ত্রী হাঁপানি রোগের জন্য প্রায়ই ডাক্তার দেখাতে হতো তাকে। ডাক্তারও কোন বিরক্তি ছাড়াই চলে আসতেন তাকে দেখতে। মাঝেমধ্যে কিছু ঘটনায় ডাক্তারদের অমানবিকতা চোখে পড়ে। কিন্তু লাতিন আমেরিকার সেই ছোট্ট শহরের ডাক্তার মিশে গিয়েছিলেন প্রান্তিক মানুষের স্রোতে। কর্নেলের আর্থিক দৈন্যতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। বিলের প্রসঙ্গ উঠলে ঠাট্টাচ্ছলে এড়িয়ে যেতেন।
পৃথিবীর নির্মম অর্থনৈতিক পরিসীমায় নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষকে দারিদ্র্যের সাথে যুঝতে হয় প্রতিনিয়ত। একটি পরিবারকে যখন বাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও বিক্রি করতে শুরু করে, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না আর্থিক দুরাবস্থা চরমে সীমায় পৌঁছেছে। কর্নেলের পরিবারকে তিনবেলার আহার যোগাতে শেষমেশ তাই করতে হচ্ছিল। সমাজের প্রান্তিক মানুষের জীবন যে সবসময়ই কঠিন, তা বোঝা যায় কর্নেলের প্রাত্যহিক জীবনের বর্ণনা থেকে।
অগাস্টিনের হাতে বেড়ে ওঠা লড়াইয়ের একটি মোরগ কর্নেলের পরিবারকে স্বপ্ন দেখায়। অর্থের টানাপোড়েন থেকে মুক্তির স্বপ্ন। মোরগটি জানুয়ারিতে প্রতিযোগিতার পর চড়া দামে বিক্রি করতে পারবেন , এমনটাই আশা রাখেন কর্নেল। মোরগ বিক্রির টাকা দিয়ে তাদের আরও কয়েক বছর নিশ্চিন্তে চলে যাবে। কিন্তু কর্নেল তার আগেই স্ত্রী’র প্ররোচনায় বিক্রি করতে চলেছিলেন, যদিও শেষমেশ আর করেননি।
চরম দারিদ্র্যের মাঝেও কর্নেল ঠিকই তার আত্মমর্যাদাবোধ ধরে রেখেছিলেন। ঘড়িটি যখন বিক্রি করতে বেরিয়েছিলেন, তখন কেউ যেন না দেখে সেজন্য ঢেকে নিয়েছিলেন। স্থানীয় মানুষের সাথে তার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে ছিল। তিনি কিংবা তার পরিবার যে চরম অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছেন, সেটি কাউকেই বুঝতে না দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
কর্নেলের স্ত্রী আর দশজন গ্রামের সাধারণ মহিলার মতোই। সহজসরল, পরিবারকে আগলে রাখার সহজাত প্রবৃত্তি সম্পন্ন। কর্নেলের চেয়ে অর্থের চিন্তা তারই বেশি বলে উপন্যাসিকায় প্রতীয়মান হয়। কর্নেলের লড়াইয়ের সঙ্গী হিসেবে নিয়তি মেনে নিয়েছেন।
উপন্যাসিকাটি যখন লেখা হয়, তখন লাতিন আমেরিকায় চলছে সহিংসতায় সময়। ইতিহাসে যেটিকে ‘লা ভায়োলেন্সিয়া’ বলা হয়। তখন কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো সংবাদপত্রের উপর সেন্সরশিপ আরোপ করেছিল। কর্নেলের শহরে যে ডাক্তার ছিলেন তিনি চুপে চুপে পত্রিকা নিতেন। সরকারি প্রোপাগান্ডা ছড়ানো ব্যতীত যে সংবাদমাধ্যমগুলো জনগণের দুর্দশার খবর প্রকাশ করতো, সেগুলো পাঠ করা অপরাধ বলে গণ্য করতো। উপন্যাসিকায় এ বিষয়টি বুঝতে পারা যায়।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখায় ম্যাজিক রিয়েলিজমের অনুসন্ধান চালানোটাই স্বাভাবিক। কারণ, পশ্চিমারা তাকে ম্যাজিক রিয়েলিজমের যাদুকর হিসেবেই সবচেয়ে বেশি প্রচার করেছে। কিন্তু তিনি তার ছোট গল্প কিংবা উপন্যাসিকায় যেভাবে লাতিন আমেরিকার জীবন বাস্তবতা তুলে এনেছেন, তা নির্দ্বিধায় অনন্য বলা যায়।
অনলাইনে কিনুন- কর্নেলকে কেউ লেখে না