আমি বীরাঙ্গনা বলছি: মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের দুঃখগাথা

১৯৯৪ সালে প্রথম প্রকাশিত নীলিমা ইব্রাহিমের এই বইটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক নির্মম বেদনার চিত্র তুলে ধরেছে। ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটি কোনো গল্প-উপন্যাস নয়, কোনো কল্পনাকে আশ্রয় করে তার সাথে সত্যের মিশেল ঘটিয়েও এটি লেখা হয়নি। বইয়ের প্রতিটি শব্দ সত্য, যা তুলে ধরেছে একটি নির্মম বাস্তবতাকে।

বইয়ের পাতায় কী লেখা আছে তা জানার আগে জানা যাক বীরাঙ্গনা কী এবং শব্দটি কেন এতটা আলোচিত আমাদের দেশে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের প্রথমদিকে পাকিস্তানীরা ভেবেছিল মানুষ হত্যার মধ্যে দিয়েই তারা বর্তমান বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে পারবে। কিন্তু যুদ্ধের তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে আসেনি তখন তারা যুদ্ধের নীতি হিসেবে নারীদের ধর্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়।

‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটির প্রচ্ছদ; Image source: rokomari.com

প্রতিদিন মানুষ হত্যা, গ্রামের পর গ্রাম আগুন লাগিয়ে শেষ করা যেমন পশ্চিম পাকিস্তানীদের বর্বরতার প্রতিদিনকার অংশ হিসেবে দাঁড়িয়েছিল, তেমনি আরেকটি বর্বরতা ছিল নারীদের ধর্ষণ করা। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে জাতিগতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া, নারীদের ধর্ষণের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের জনগণের মনোবল ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ধর্ষণকে বেছে নেওয়া হয়। আর এ কারণেই পরিবারের সবার সামনেই নারীদের আক্রমণ করা হতো। পশ্চিম পাকিস্তানীদের ক্যাম্পে প্রতিদিন গাড়ি বোঝাই করে মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। কমান্ডারদের জন্য নতুন নতুন মেয়ের ব্যবস্থা করা হতো। সাধারণ সৈনিকেরা একই নারীকে ঢালাওভাবে ধর্ষণ করতো। নানা রকম নির্যাতনের পরেও তাদের বাঁচিয়ে রাখা হতো যেন তারা সন্তান জন্ম দিতে পারে।

নয় মাসের যুদ্ধে বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী ২ থেকে ৪ লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। সঠিক সংখ্যা হয়তো কখনোই জানা যাবে না। যুদ্ধ শেষে এই নারীদের যখন ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা হয়, তখন তাদেরকে ধর্ষিতা নামে ডাকাসহ বিভিন্ন অপামান করা হতো। বঙ্গবন্ধু এই ভাগ্যাহত নারীদের নিজের মেয়ের স্বীকৃতি দেন এবং তাদের বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করেন। বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ বীর নারী। আসলেই তো তারা বীর ছিলেন, তাদের সম্ভ্রমের বিনিময়েই তো পেয়েছি এই স্বাধীন দেশ।

যুদ্ধ শেষে বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্য অনেকগুলো কেন্দ্র খোলা হয়। নীলিমা ইব্রাহিম বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন এবং সেখানেই তার আলাপ হয় ভাগ্যের পরিহাসে নির্মম নিয়তির শিকার হওয়া এসব নারীর সাথে। তাদের থেকে সাতজনের সাক্ষাৎকার নিয়েই রচিত হয় এই বই। সাতজনের সাক্ষাৎকার কিংবা সাতজনের জীবনের ভাগ্যলিপি প্রথমে দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। নীলিমা ইব্রাহিমের তৃতীয় খণ্ড প্রকাশ করার কথা থাকলেও শারীরিক এবং এই নির্মম দুঃখগাঁথা লেখাকালীন মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় বলে তৃতীয় খণ্ড অপ্রকাশিতই থেকে যায়।

নীলিমা ইব্রাহিম; Image source: weeklyekota.net

এখানে সাতজন নারীর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হওয়ার গল্প আছে। গল্প! হয়তো গল্প বলতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু এ ভীষণ বাস্তবতা যা সকল গল্প-কল্পনাকেও হার মানায়। কী অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছে আমাদের নারীরা, কত প্রাণ ঝরে গেছে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে! কিন্তু পাকিস্তানীদের নির্যাতনই কী শেষ?

না, এ যেন নির্যাতনের শুরু। যুদ্ধ শেষে, এই নারীদের পরিবারেরা তাদের নিতে অস্বীকৃতি জানায়। নিজের সমাজ আর পরিবারই যখন তাদের মেনে নিতে পারে না, এই অপমানের সামনে যেন সব অপমান ম্লান হয়ে যায়। নিজের পরিবার যখন দূরে ঠেলে দেয়, অস্বীকৃতি জানায়, এর চেয়ে যন্ত্রণার, কষ্টের বোধহয় কিছু হয় না।

বীরাঙ্গনাদের রাখা উচিত ছিল সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে, কিন্তু রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় আমরা তাদেরকে পায়ে পিষে ফেলেছি। তাদেরকে ন্যূনতম সম্মানটুকু দেইনি, তাদের থেকে কেড়ে নিয়েছি মানুষের মতো বাঁচার অধিকার। কত শত অপমানে জর্জরিত হয়ে তারা বেঁচে ছিলেন, সেই তীব্র দুঃখবোধের গভীরতা আমাদের বোঝার কথা না।

কী গভীর আঘাতে একজন তারা থেকে মিসেস টি নিয়েলসন হয়ে যায় আমাদের তা জানার কথা না। মেহেরজান, রীনা, শেফা, ময়না, ফাতেমা, মিনা এদের মধ্যে দিয়েই সেই সময়ে পাকিস্তানীদের বর্বরতা আর আমাদের রক্ষণশীলতা তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। পাকিস্তানিরা এতটাই নির্মম ছিল যে নির্মম বা বর্বরতা শব্দগুলোও যেন লজ্জায় কেঁপে উঠতো তাদের কাজকর্ম দেখে।

গণধর্ষনের পুরোটাই ছিল পাকিস্তানীদের সমর নীতির একটি অংশ। তারা ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করেছে। শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, চালিয়েছে অসহনীয় শারীরিক নির্যাতন। আমাদের মা-বোনেরা সেই অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে যেদিন জানতে পারল দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেদিন হয়তো ভেবেছিলো নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে । কিন্তু বড় আঘাতটা আসলো নিজের দেশ আর পরিবার থেকেই। শারীরিক যন্ত্রণা শেষে মানসিক অত্যাচারের মধ্যে দিয়েই কাটাতে হয়েছে দিন। আর এই সব কিছুই ফুটে উঠেছে নীলিমা ইব্রাহিমের লেখনীতে।

‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ আমাদের যুদ্ধের সময়কার নারীদের উপর নির্যাতনের চিত্রের এক প্রতিচ্ছবি। যে ছবি পাকিস্তানী হানাদারদের জঘন্যতম বর্বরতার পাশাপাশি আমাদের সমাজের অযাচিত রক্ষণশীল মনোভাবকেও তুলে ধরে, যার পরিবর্তন এত বছর পরেও খুব একটা হয়নি।

বইটি কিনতে দেখুন- আমি বীরাঙ্গনা বলছি

This Bengali article is a book review of 'Ami Birangona Bolchi'. The book was written by Nilima Ibrahim. In this book, we can see how women were tortured during the liberation war.

Featured Image: Opinion

Related Articles

Exit mobile version