উত্তর কোরিয়ার নেতাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন সম্পর্কে আমরা মিডিয়ায় সবসময়ই শুনে থাকি। দেশটির জনগণ বাক-স্বাধীনতা বা চিন্তার স্বাধীনতা থেকে কতটা বঞ্চিত, সেই সম্পর্কে আমাদের কিছুটা হলেও ধারণা আছে।
রহস্যময় এই দেশ বহির্বিশ্বের কাছ থেকে নিজেদের সবসময় বিচ্ছিন্ন করে রাখে। ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব সম্পর্কে ‘হয়তো’ তাদের কোনো ধারণাই নেই। বিদেশি পর্যটক বা সাংবাদিকরা দেশটিতে ভ্রমণে গেলেও তাদের উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে সরবরাহ করা ‘ট্যুর গাইড’সহ নির্দিষ্ট কিছু স্থানেই যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সাধারণ জনগণ কীভাবে জীবন কাটায়, সেই সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য এভাবে জানা সম্ভব নয়।
তাহলে তাদের মানবেতর জীবন নিয়ে এসব তথ্য আমরা কীভাবে জানতে পারি? এগুলো আমরা জানি মূলত দেশটি থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। তাদের সাক্ষাৎকার, আত্মজীবনী কিংবা সাহিত্যের মাধ্যমে সেখানকার জীবনধারা প্রতিফলিত হয়। কিন্তু এমন যদি হয়- উত্তর কোরিয়ার কোনো লেখক তার সাহিত্য প্রকাশ করেছেন, যেখানে তার স্বৈরশাসকদের ব্যঙ্গ করে কঠোর সমালোচনার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের দুর্ভোগের কথা তুলেছেন, সেই লেখা আবার বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রকাশিতও হয়েছে, সেটা কি কখনো কল্পনা করা সম্ভব?
হ্যাঁ, এমন ঘটনাই ঘটেছে ছোট গল্পের সঙ্কলন ‘দ্য একিউজিশন’ বইটিতে। লেখকের নাম বান্ডি। অবশ্যই ছদ্মনাম। কোরিয়ান ভাষায় ‘বান্ডি’ শব্দের অর্থ জোনাকি। ২০১৪ সালে এ সঙ্কলনটি প্রথমে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রকাশিত হয়। পরে ২০১৭ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডেবোরাহ স্মিথ। বইটিতে গল্পের সংখ্যা সাতটি। এগুলো লেখা হয়েছে ১৯৮৯-৯৫ সালের মধ্যে। অর্থাৎ, উত্তর কোরিয়ার জাতির পিতা কিম ইল সাংয়ের শাসনামলের শেষের দিকে। গল্পগুলোতে মূলত কিম ইল সাংকে ব্যঙ্গ করে সেখানকার সমাজব্যবস্থার সমালোচনা করা হয়েছে।
বইটির গল্পগুলোর চেয়ে গল্পগুলো বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার ঘটনা আরো বেশি চাঞ্চল্যকর। কারণ লেখক নিজে উত্তর কোরিয়ার লেখকদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বিশিষ্ট সংস্থা ‘চোসান রাইটার্স লিগ সেন্ট্রাল কমিটি’র একজন সদস্য। এ সংস্থার দ্বারা উত্তর কোরিয়া সাধারণ জনগণের মধ্যে শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা ছড়ায়।
দ্য একিউজিশনের সাতটি গল্পে বান্ডি বিভিন্ন কাল্পনিক চরিত্রের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন, যে কিম ইল সাংকে সবাই দেবতা মনে করে, তিনি আসলে কতটা অমানবিক আর নিষ্ঠুর। এখানে তিনি হতদরিদ্র থেকে পিয়ংইয়ংয়ে থাকা এলিট শ্রেণির পরিবারগুলোও যে শাসকদের অত্যাচার থেকে মুক্ত নয়, তা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন- একটি গল্পে আমরা দেখতে পাই পিয়ংইয়ংয়ে থাকা এক পরিবারের বাচ্চা স্ট্যালিনও কিম ইল সাংয়ের বিশাল ছবি দেখে ভয় পেয়ে কাঁদে। শিশুটির কান্না ও ভয় যেন কমিউনিস্ট শাসনের প্রতি উত্তর কোরিয়ার সাধারণ মানুষদের ভয় আর ঘৃণাকেই নির্দেশ করে।
উত্তর কোরিয়ায় চাইলেই এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়া যায় না। এর জন্য আলাদা করে পার্টির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। অনেকটা পাসপোর্ট-ভিসার মতোই। অর্থাৎ, তারা দেশের ভেতরে থাকলেও এক শহর থেকে অন্য শহর হয়ে যায় বিদেশের মতো। এ ব্যবস্থার প্রতি লেখকের চরম আক্রোশ প্রকাশ করতে দেখা যায় এক গল্পে, যেখানে এক শ্রমিক তার অসুস্থ মায়ের কাছে যেতে পারে না শহর ত্যাগের অনুমতি না থাকায়।
এখানে যোগ্যতার চেয়ে পার্টির প্রতি আনুগত্য আর পারিবারিক মর্যাদা কেমন, সেটাই বেশি গুরুত্ব পায়। এ কারণেই এক গল্পে দেখা যায় এক বিজ্ঞানীকে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে শস্যের চাষ করতে। এতে যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয়, সাধারণ মানুষের যত যোগ্যতাই থাকুক, পার্টি যেভাবে চাইবে আমজনতাকে সেভাবেই চলতে হবে। লাল রঙ হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতীক। সে গল্পে এক শহরের পার্টির অফিসের রঙ ভেতর-বাইরে সব জায়গা লাল রঙ দিয়ে পরিপূর্ণ থাকে। সেই লাল দুর্গকে লেখক তুলনা করেন বিষাক্ত লাল মাশরুমের সাথে, যা মানুষের জীবনীশক্তি শুষে নিচ্ছে।
এতটা কড়া ভাষায় পার্টি বা কিম পরিবারের নেতাদের সমালোচনা করা উত্তর কোরিয়ায় প্রকাশ্যে আলোচনা তো দূরের কথা, চিন্তা করাই পাপ। এমনকি নেতাদের মৃত্যু উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় শোকের সময় কে কতটা চোখের পানি ফেলছে কিংবা নিয়মিত ফুল দিয়ে শোক প্রকাশ করছে কিনা, সেগুলো সম্পর্কেও নজর রাখা হয়। এমন অবস্থার মধ্যে লেখক বান্ডি কীভাবে তার গল্প সঙ্কলন প্রকাশ করতে পারলেন?
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে সেখান থেকে উত্তর কোরিয়াতে সহযোগিতা আসা বন্ধ হয়ে যায়। তারা উত্তর কোরিয়াকে গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করে দিল। ওই সময়টা উত্তর কোরিয়ার জন্য ছিল খুবই বাজে সময়। পরপর বন্যা আর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভুগছিল দেশটি। কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ বেকারও হয়ে পড়ে। তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়। বান্ডিরও কাছের বেশ কিছু মানুষ মারা যান। এতে তিনি উত্তর কোরিয়ার সমাজ ব্যবস্থা ও শাসন ব্যবস্থার প্রতি ক্ষুব্ধ হন।
যদিও সেগুলো প্রকাশ করতে পারছিলেন না, গোপনে ওই সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে সাহিত্য রচনা শুরু করেন। তখন অনেকেই দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ চীনে পালিয়ে যাচ্ছিল। বান্ডিও এমন চিন্তা করছিলেন। কিন্তু স্ত্রী-সন্তানদের কথা চিন্তা করে ঝুঁকি নিতে চাননি। কারণ সীমান্তে কোরিয়ান বা চীনা সেনাদের হাতে ধরা পড়লে নিজের ওপর তো বটেই, পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপরও কঠোর শাস্তি নেমে আসতে পারে।
তখন তার এক আত্মীয়র পালানোর কথা জানতে পারেন। তিনি ওই আত্মীয় মহিলার কাছে তার পাণ্ডুলিপি দিতে চেয়েছিলেন। তিনি চাইছিলেন তার লেখাগুলো বহির্বিশ্বের মানুষদের কাছে পৌঁছাক। তারা জানুক উত্তর কোরিয়ার মানুষরা কী ভয়াবহ পরিবেশে বাস করছে। তবে সেই আত্মীয় ঝুঁকি নিতে চাননি। তবে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, সীমান্ত পার হয়ে যেতে পারলে সেখান থেকে কাউকে পাঠাবেন পাণ্ডুলিপি নেওয়ার জন্য।
ওই আত্মীয় চীনে গেলে সেখানে এক মানবাধিকার কর্মী দু হি ইয়ুনের সাথে পরিচয় হয়। দু হি ইয়ুন তাকে চীন থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। ওই মহিলা তখন বিনিময়ে দু হি ইয়ুনকে অর্থ দিতে চান। কিন্তু দু হি ইয়ুন সেগুলো নিতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ তিনি উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা অনেক নাগরিককে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করতে সাহায্য করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভদ্র মহিলা তাকে যে অর্থ দিতে চাচ্ছেন, সেগুলো আসলে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের তরফ থেকে দেওয়া ভরণপোষণের অর্থ।
তখন ওই মহিলা তাকে সেই পাণ্ডুলিপির গল্প শোনান। তিনি শুনে অবাক হয়ে যান। তখন কাকতালীয়ভাবে তার এক চীনা বন্ধু উত্তর কোরিয়াতে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলেন, যা বান্ডির শহরেই ছিল। দু হি ইয়ুন ওই মহিলার লেখা এক চিঠি তার বন্ধুর মাধ্যমে পাঠান বান্ডির কাছে। চিঠিটি কিম ইল সাংয়ের এক প্রোপাগান্ডা বইয়ের ভেতর ভরা ছিল। সেটা নিয়ে বান্ডির কাছ থেকে ৭৫০ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি সীমান্ত পার করে নিয়ে আসেন। এরপরই সেগুলো প্রকাশিত হয় দক্ষিণ কোরিয়ায়।
বান্ডির সাহিত্য রচনা পড়লে বোঝা যায় ভুল দেশে ভুল মানুষের জন্ম নেওয়ার প্রকৃত উদাহরণ কেমন হতে পারে। উত্তর কোরিয়াতে থাকায় তার প্রতিভার অপচয় হচ্ছে শুধুমাত্র সরকারের স্তুতি রচনার মাধ্যমে।
বান্ডি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ সালে যখন কোরীয় যুদ্ধ শুরু হয়। তার পরিবারের সাথে চীনে চলে যান শরণার্থী হিসাবে। পরবর্তীতে আবার ফিরে আসেন নিজ দেশে। অবসরে লেখালিখি করতেন। তার সাহিত্য রচনার হাত এতই প্রখর ছিল যে, বেশিদিন তার প্রতিভা গোপন থাকে না। কাছের মানুষরা তাকে উৎসাহ দেয় নিয়মিত লেখার জন্য।
উত্তর কোরিয়াতে লেখকরা ক্যারিয়ার শুরু করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে সাহিত্য রচনার মাধ্যমে। বান্ডিও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি মুক্ত পরিবেশে সাহিত্য রচনার সুযোগ পেলে হয়তো আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারতেন।
দ্য একিউজিশন বইটি বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছালেও খোদ উত্তর কোরিয়ার মানুষরাই তা পড়তে পারেননি। ২০১৫ সালে দু হি ইয়ুন জানান, তিনি কয়েক মাস ধরে বান্ডির কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। সম্ভবত উত্তর কোরিয়ার কর্তৃপক্ষ তার পরিচয় বের করে কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। কিম পরিবার উত্তর কোরিয়ায় যেমন তাদের নিজেদের নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালায়, আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়াও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালায়। এ গল্পগুলো পড়লে তাই অনেকটা উত্তর কোরিয়া বিরোধী প্রোপাগান্ডাও মনে হতে পারে অনেকের কাছে। তবে নিঃসন্দেহে হৃদয় ছুঁয়ে যাবে প্রতিটি কাহিনি।