১৯৬০ এর দশকের হংকংয়ের কথা। এক লোক তার স্ত্রীর সাথে একটি অ্যাপার্টমেন্টে ওঠেন। এক মহিলা তার স্বামীর সাথে পাশের বাড়িতে ওঠেন। তাদের বাড়িওয়ালা উদার মনের এবং আড্ডাবাজ। লোকটি প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন, স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় দেখা হয় না বললেই চলে। অন্যদিকে, মহিলাও দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন। তার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য; তারও নিজের স্বামীর সাথে খুব একটা দেখা হয় না। তাদের নৈশভোজগুলো হয় বাড়ি থেকে দূরে ও একাকী। কিন্তু, সময় থেমে যায়, যখন আবদ্ধ দরজার পাশ দিয়ে তারা একে অন্যকে পাশ কাটিয়ে যান। প্রায়ই ধোঁয়াটে বসার ঘরে তাদের সঙ্গীদের অজান্তে তাদের চোখ একে অন্যকে দেখে। রসহীন বিয়ে চূড়ান্তভাবে তাদের ঠেলে দেয় একে অন্যের দিকে।
প্রথমে তারা প্রলোভনের কাছে নতি স্বীকার করতে ইতস্তত বোধ করে। আর দশজনের মতো তারা হতে চায় না। শেষপর্যন্ত তারা নতি স্বীকার করে। একে-অন্যের প্রেমে পড়ে যায়। সবার চোখের আড়ালে তারা প্রায়ই হোটেল রুমে সাক্ষাৎ করে, অকথিত কথার নীরবতা তাদের অনুপ্রাণিত করে। বর্তমানই তাদের একমাত্র ভবিষ্যত, লড়াই যেন গোটা পৃথিবীর সাথে। বিবর্ণ রঙ, লাল রঙের দেয়াল, গোপন সাক্ষাৎকার, দোষী চাহনি, কাব্যিক ফ্রেমসমূহ, শৈল্পিক বৃষ্টি– তাদের গল্প যেন মহাকাব্যিক।
কিন্ত, ওং কার-ওয়াই এর চলচ্চিত্রটি তাদের নিয়ে নয়। বরং, ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ নির্মিত তাদের সহজ-সরল সঙ্গী চাও মো-ওয়ান (টনি লিউং চিউ ওয়াই) ও সু-লি ঝেন তথা মিসেস চানকে (ম্যাগি চিউং) কেন্দ্র করে, যারা দ্রুতই বিশ্বাসঘাতকতার সূত্রে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তবু, মিস্টার চাও-ও একজন লোক যিনি তার স্ত্রীর সাথে একটি অ্যাপার্টমেন্টে ওঠেন। আবার, মিসেস চানও একজন মহিলা যিনি তার স্বামীর সাথে পাশের বাড়িতে ওঠেন। তাদের ক্ষেত্রেও সময় ধীরে কাটে যখন তারা আবদ্ধ দরজা দিয়ে একে অন্যকে পাশ কাটিয়ে যান।
‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’-এ নীরবতার কোনো স্থান নেই। এমনকি নীরবতার গুরুত্ব বোঝানো দৃশ্যগুলোতেও রয়েছে সঙ্গীত অথবা চারপাশের শব্দের ব্যবহার। এতে নীরবতার স্থান না থাকার কারণ হলো- চলচ্চিত্রটির মূলে রয়েছে স্মৃতিকাতরতা। ইংরেজিতে অনুবাদ করলে চলচ্চিত্রের নাম আসলে দাঁড়ায় ‘ফ্লাওয়ারি ইয়ার্স’ অথবা ‘দ্য এজ অফ ব্লসম’, যা নির্দেশ করে ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ তৈরি হয়েছে স্মৃতিকাতরতার উপর ভিত্তি করে।
শুরুতে ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ এর গল্প লেখা হয়েছিল ‘দ্য স্টোরি অফ ফুড’ হিসেবে। অতীতের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো সেই সময়ের খাবার। এ কারণে, স্মৃতিকাতরতার বহিঃপ্রকাশে খাবার অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গোটা চলচ্চিত্র জুড়ে আমরা দেখতে পাই মূল চরিত্রগুলো খাচ্ছেন, খাবার তৈরি করছেন অথবা খাবার কিনছেন। বিখ্যাত ‘করিডোর গ্ল্যান্স’ সিকোয়েন্স বাদে খাবার নিয়ে প্রতিটি দৃশ্য দর্শকদের সেই সময়কার খাদ্য সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
চলচ্চিত্রটির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য কোনো না কোনোভাবে খাবারের সঙ্গে সম্পর্কিত। খাবার অন্তরঙ্গতার একটি পথ এবং একইসাথে একজনের খাদ্যাভ্যাস সেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দেয় যা আমরা দেখেছি সু-লি ঝেন ও চাও মো-ওয়ান যখন তাদের সঙ্গীদের পরকীয়ার কারণ সন্ধান করতে শুরু করে তখন। আবার, এই দুজন নিজেদের আবদ্ধ ঘরে বসে থাকাকালে একাকিত্বের সম্মুখীন হলে এর থেকে বাঁচার পথ হিসেবে যখন খাবার আনাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে একে অন্যের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তার মাধ্যমেও আমরা দেখেছি চলচ্চিত্রে খাবারের গুরুত্ব।
‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’-এ সঙ্গীত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওং-এর অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলোয় সাধারণত ব্যতিক্রমহীনভাবে চীনা সঙ্গীতের ব্যবহারই বেশি দেখা যায়। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে অন্যগুলোর তুলনায় সঙ্গীতের বাছাই একেবারে অনন্য। তিনি এতে মূলত ন্যাট কিং কোলের স্প্যানিশ ভাষায় গাওয়া কিছু গান ও কিছু কালজয়ী চীনা সঙ্গীত ব্যবহার করেছেন। গানগুলো কিংবা জাপানি সংগীতশিল্পী শিগেরু উমেবায়াসির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, দুইয়েরই মূল বিষয়বস্তু হারানো কোনোকিছুর জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা। স্মৃতিকাতরতার উপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতে পূর্বের দিনগুলোর আনন্দ নির্দেশ করতে প্রায়ই নৃত্যের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু এই সিনেমায় নেই কোনো নৃত্যের দৃশ্য। তবুও এর একটি সিকোয়েন্সকে ছন্দময়, দ্রুত সম্পাদনার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে নৃত্যের সারাংশ।
ওং কার-ওয়াই এর চলচ্চিত্রগুলো বিখ্যাত তাদের সজীবতার জন্য, যা তিনি শিখেছেন তার গুরু প্যাট্রিক টামের কাছ থেকে। আলোচ্য সিনেমায় ‘৬০-র দশকের রাস্তা, অট্টালিকাগুলোর নির্মাণ একদম নিখুঁত। রাস্তাগুলো আধুনিক যুগের হাইওয়ের মতো নয়, সেগুলোর স্থানে স্থানে রয়েছে ফাটল। ওং তার শৈশব কাটান ‘৬০ ও ‘৭০ এর দশকের হংকংয়ে। তবে চলচ্চিত্রটির মূল চরিত্রগুলো হংকংয়ের হলেও তিনি নিজে সাংহাইয়ের মানুষ। তার শৈশবের দিনগুলোর সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেগুলো একজন ব্যক্তি হিসেবে তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেসবেরই বহিঃপ্রকাশ ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’। কিন্তু তার দর্শকরা হংকং হোক কিংবা অন্য কোনো স্থানের হোক, তারা তো আর সেই সময়কার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে অবগত নন। তাহলে ওং কীসের মাধ্যমে তার শৈশব সম্পর্কে আমাদের পরিচিত করতে পারেন?
উত্তর হচ্ছে- পুনরাবৃত্তি ঘটানোর মাধ্যমে। পুরো দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়েছে মাঝেমধ্যে এবং একই সিকোয়েন্স ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে কয়েকবার করে দেখানো হয়েছে। যেমন- সু এবং চাও একই ছায়াতলে বারবার দেখা করেছেন। এমন করার মূল লক্ষ্য দুটি- ১. তাদের সম্পর্কের কোন মুহুর্তে তারা রয়েছে দর্শকদের কাছে তা নির্দেশ করা, ২. রাস্তা ও অট্টালিকাগুলোর সাথে দর্শকদের পরিচয় করানো। পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে রাস্তা, নুডলসের দোকান, সিড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, ২০৪৬ এর করিডর- সব দর্শকের মনে জায়গা করে নেয়। গানগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে, খাবারগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং ওং কার-ওয়াইয়ের মনের ভেতরকার পৃথিবী দর্শকের মনের ভেতরকার পৃথিবীতে রূপ নেয়।
“That era has passed. Nothing that belonged to it exists anymore.”
এই উক্তির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে- পরিচালক ও দর্শকদের উভয়কেই নিজেদের অতীত ভুলে যেতে হবে। অতীত এখন সময়ের দখলে এবং পুষ্পময় দিনগুলোর সমাপ্তি ঘটেছে। পুষ্পময় দিনগুলো সু এবং চাও-কে অন্তরঙ্গতার সীমাবদ্ধতা ও অনুভূতি সম্পর্কে ভুল ধারণা জন্মাতে সাহায্য করেছে। এরপরই আসে নতুন যুগ, পরিপক্কতার যুগ, যেখানে আবেগ ও অনুভূতিগুলো লুকায়িত থাকে এক স্থির ভবিষ্যতের খোঁজে। কিন্তু সু অথবা চাও- দুজনের কেউই অতীত ভুলে যেতে পারেননি। চলচ্চিত্রের শেষদিককার অনেক ঘটনাতেই দেখা যায় তারা পুষ্পময় দিনগুলোর স্মৃতির উপর নির্ভর করে দিন কাটাচ্ছেন। শেষপর্যন্ত, তারা দুজনেই ভবিষ্যতের দিকে তাকান বটে, কিন্তু অতীত ভুলতে না পেরে স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠেন।
চলচ্চিত্রটিতে টনি লিউং ও ম্যাগি চিউংয়ের পারফরমেন্স ছিল অনবদ্য। এতে অভিনয়ের সুবাদে টনি লিউং জিতে নেন কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেতার পুরস্কার। এর সিক্যুয়াল ‘২০৪৬’-এও তিনি মূল চরিত্রে অভিনয় করেন। তিন সিনেমাটোগ্রাফার ক্রিস্টোফার ডয়েল, কয়ান পাং-লিউং এবং মার্ক লি পিং-বিং ষাটের দশকের ব্রিটিশ হংকংয়ের সৌন্দর্য সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন এতে। বিশেষ করে তাদের ক্যামেরায় বৃষ্টির কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। ওং-এর নিয়মিত কোলাবরেটর উইলিয়াম চ্যাং ছিলেন আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে। সেই সময়কার হংকংয়ের চারপাশের পরিবেশ পুনরায় সৃষ্টিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
শেষ করছি চলচ্চিত্রটিতে থাকা আমার প্রিয় কয়েকটি উক্তি দিয়ে।
“He remembers those vanished years. As though looking through a dusty window pane, the past is something he could see, but not touch. And everything he sees is blurred and indistinct.”
“In the old days, if someone had a secret they didn’t want to share… you know what they did?…They went up a mountain, found a tree, carved a hole in it, and whispered the secret into the hole. Then they covered it with mud. And leave the secret there forever.”