আগে দেখা মুহূর্তেরা স্মৃতির ক্যানভাসে ম্লান হয়ে আসে। উদ্ভব ঘটে জ্যমেয় ভু❜র। পরিচিত প্রেক্ষাপটের মেজাজ পাল্টে গেলে নিজেকে মনে হয় অজানা বাকশালীনের বিরুদ্ধ বন্দি। চেনা আদল বদলে গেলে শিহরণ তো মস্তকেও জাগে… তখন বিক্ষত নিউরনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। অজানা উন্মাদনায় ঠুনকো মেমোরির ম্যাট্রিক্স আশ্চর্য উপায়ে স্লথ হয়ে আসে। চোখ থেকে উড়ে যায় ঘুম। স্বপ্ন দেখার কথা? মনে থাকে না। থাকে শুধু লিপ্সা আর মুঠোভর্তি হতাশা। কিন্তু জীবনের মুশকিল হিসেবের গল্পগুলো কি এত সহজে মেটে? সে যে ভারী ঝক্কির ব্যাপার!
ঝক্কি বা ঝাঁকুনি ছাড়া আর যা-ই হোক, থ্রিলার ধাঁচের গল্প হয় না। উদ্বেগ এখানে মূল চালিকাশক্তি, আতঙ্ক ছড়িয়ে থাকে কাহিনির বাঁকে বাঁকে। ভয় আর উত্তেজনার মিশেলে তৈরি হয় রহস্য। সমাধানযোগ্য রহস্যের আবার গালভরা নাম আছে, ডিটেকটিভ থ্রিলার। আর যে রহস্যের সমাধান হয় না, থেকে যায় অমীমাংসিত? অতিপ্রাকৃত? অলৌকিক আবরণে আবৃত?
আদতে রহস্যের সমাধান হোক আর না হোক, গল্পের বাঁকে উৎকণ্ঠার মাত্রা ঠিক থাকতে হবে। পাঠকের পাতে যেন খোরাক থাকে পর্যাপ্ত। তাতে যদি থ্রিলারের সাথে হরর, কল্পবিজ্ঞান কিংবা ফ্যান্টাসির মতো জনরাগুলো খাপ খেয়ে যায়— ক্ষতি নেই। দিব্যি জমে ক্ষীর। থ্রিলার জার্নালের সাম্প্রতিক ইস্যুতেও মূল জনরার তুলনায় গল্পের বাঁকে সর্বাধিক গুরুত্ব নজরে আসে। নামটাও অভিনব— গল্পবাঁক সংখ্যা। থ্রিলার জার্নাল গল্পবাঁক সংখ্যার উল্লেখযোগ্য কিছু গল্প সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলো এই লেখায়।
জ্যমেয় ভু
ডেজা ভু অর্থ আগে দেখা। এ এক বিচিত্র অনুভূতি, যখন অচেনা দৃশ্যকে পরিচিত মনে হয়। কিন্তু জ্যমেয় ভু? জ্যমেয় ভু মূলত ডেজা ভু’র বিপরীত অর্থ ধারণ করে। লেখক তানজীম রহমানের ভাষায়, “যখন আগে হাজার বার করা একটা কাজ, হাজার বার দেখা একটা দৃশ্যকে দেখে সম্পূর্ণ অপরিচিত লাগে, সেটাই হচ্ছে জ্যমেয় ভু।”
কাহিনির বিস্তৃতি ছোটখাট একটা উপন্যাসিকায় এসে ঠেকেছে। মূল চরিত্র, সুমনা এখানে জ্যমেয় ভু’র শিকার। অ্যাড এজেন্সির যাপিত জীবনের গল্পটা লেখক তুলে ধরেছেন কল্পবিজ্ঞান আর অতিপ্রাকৃতিক আবহের মিশেলে। সমাপ্তি কিছুটা ম্লান লাগলেও নভেলেট হিসেবে জ্যমেয় ভু নিঃসন্দেহে এক ভিন্নধারার অভিজ্ঞতার জানান দিয়েছে।
লিপ্সা
সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হুবাল নামের এক অদ্ভুত লোকের সন্ধান মিলেছে। শোনা যায়, লাল চোখের এই লোকের মুখ বলতে কিছু নেই। অলৌকিক এক উপায়ে তার মুখের অংশটা চামড়ার মসৃণ আবরণে আবৃত। কিন্তু কে এই হুবাল? দেবতা নাকি পিশাচ?
আরব্য পুরাণ আর অতিপ্রাকৃতিক আবহের মিশেলে লিপ্সা গল্পবাঁক সংখ্যার একটি দুর্দান্ত সংযোজন। লেখক বাপ্পী খান তার অন্ধকার সিরিজের প্রিক্যুয়েলের খানিকটা আভাস দিয়েছেন এই গল্পে, যেখানে আধিভৌতিক সত্ত্বার তুলনায় প্রকট হয়ে ওঠে মানবসত্ত্বার চিরায়ত লিপ্সা। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ট্রিবিউট জানানোর ব্যাপারটি প্রশংসনীয়।
অল উই ওয়ান্ট ইজ ইয়োর শিট
কারখানার নগরী নৃৎক্ক। সেখানকার এক বাসিন্দার নাম ৎৎৎ৬৯। কারখানাগুলো কীসের, জানে না ৎৎৎ৬৯। তবে ধারণা করতে পারে, বর্জ্য রিসাইকেল করে ব্যবহারযোগ্য কিছু একটা তৈরি হয় এখানে। অদ্ভুত সেই জিনিসের আবার চাহিদা আছে প্রচুর পরিমাণে। উপরন্তু কারখানাগুলো জানান দেয়, অল উই ওয়ান্ট ইজ ইয়োর শিট।
অদ্ভুত ধাঁচের এক প্লটের ওপর দাঁড়িয়ে আছে লেখক জাহিদ হোসেনের অল উই ওয়ান্ট ইজ ইয়োর শিট। হিউমারের সফল প্রয়োগে কল্পবিজ্ঞানের যে গল্পটা এখানে উঠে এসেছে, তার প্রতিক্রিয়া কিছুটা বিমিশ্র। একদিকে দারুণ আনন্দদায়ক, অন্যদিকে বিদঘুটে একটা অভিজ্ঞতার অবতারণা।
প্রোশোকি
দুপুরবেলা ঘুড়ি নিয়ে ছোটাছুটি করতে করতে জঙ্গলে এসে পড়ে ইকরা। সেখানেই ঘটে এক রহস্যময় নারীর আগমন। সে নিজেকে অরণ্যশঙ্খিনী হিসেবে পরিচয় দেয়। অদ্ভুত কিছু কথার রেশ টানে, “সাবধান… মারবাসের অশনি বিচ্ছুরণ বড়ই বর্তমান। বসতির নিশ্ছিদ্র আবরণ নিরাপদ…ফিরে যাও…ফিরে যাও…।”
লেখক সালেহ আহমেদ মুবিনের প্রোশোকি মূলত ফ্যান্টাসি ধাঁচের পরাবাস্তব গল্প। অরণ্যশঙ্খিনীর বার্তা বরাবরই সংকটময় একটা পৃথিবীর দিকে ইঙ্গিত করে। আর ইকরা? ইকরা এখানে সমগ্র মানবসমাজের ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি। অপ্রচলিত অথচ সুন্দর কিছু শব্দের প্রয়োগে স্বল্প পরিসরের গল্পটা দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
স্বপ্ন
আগাথা ক্রিস্টির শর্ট স্টোরি, দ্য ড্রিমের বঙ্গানুবাদ। এবারের অভিযানের মূলে রয়েছে, স্বপ্ন। বেনেডিক্ট ফার্লের অদ্ভুত এক স্বপ্ন। প্রতি রাতে নিজেকে গুলি করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। ঠিক রাত তিনটে বেজে আঠাশ মিনিটে। সম্মোহন, খুন নাকি অন্য কিছু? রহস্যের সমাধানে আবারও সেই বেলজিয়ান ভদ্রলোক হাজির। এরকুল পোয়ারো নামে যাকে সবাই চেনে।
জমজমাট এক মিস্ট্রি থ্রিলার, আগাথা ক্রিস্টির স্বপ্ন। কাহিনির নির্মাণ, বিস্তৃতি, গল্পের বাঁক— সবটাই সুখপাঠ্য। দীপ্তজিৎ মিশ্রের অনুবাদে মূল গল্পের স্বাদ অনেকাংশেই উঠে এসেছে।
অলাতচক্রম: বাকশালীনের বন্দি (#২)
বাবার নির্দেশে কারু গিয়েছিল হিংস্র ঘাঘের সাথে লড়াই করতে। ঘাঘ দেখতে কিছুটা বাঘের মতো। দু’পাশে ডানা থাকায় উড়তেও পারে প্রাণীটা। যা-ই হোক, দ্রুত গতির এই ঘাঘকে শেষমেশ বেঁধে নিয়ে আসে কারু। বাবাকে খুশি করতে চায় ছেলেটা। কিন্তু কোথায় বাবা? কারুর বাড়ি তো একদম ফাঁকা পড়ে আছে… তবে কি কারো সময় এসে গেছে জাওলিন ভ্রমণের?
ফ্যান্টাসি আর অ্যাডভেঞ্চারের মিশেলে এগিয়ে চলেছে লেখক সিদ্দিক আহমেদের‘অলাতচক্রম: বাকশালীনের বন্দি’। দুটো পর্বে ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে মূল কাহিনির সূচনা টানা হয়েছে মাত্র। পরিপূর্ণতা পেলে এর বিস্তৃতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটা জানার জন্য অপেক্ষা করা ভারি কঠিন ব্যাপার। দুর্দান্ত চরিত্রায়ণ আর চমকপ্রদ প্লটের আভাসে আগ্রহের পারদ যে অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে।
নরাদ
ভাঙা বাড়িতে চুরি করতে এসেছে মধুনাথ। সামনের দরজায় প্রকাণ্ড তালা। সেখানে ঝুলছে সাতটা লেবু। বাধ্য হয়ে বাড়ির পিছন দিকে এগিয়ে চলে মধুনাথ। জানালার শিক টপকে ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারপর… অজানা আতঙ্কে জমে যায়।
লেখক আলী ওয়াহাব সৌহার্দ্যের অতিপ্রাকৃতিক ধাঁচে লেখা, ‘নরাদ’ গল্পের মূল কাহিনিটা বেশ সুন্দর। শেষাংশের পরিণতি ভালো লেগেছে বেশি।
একটি লিবিয়ান অপহরণ
অপহরণের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে মৃত্যুর। শোনা যায়, মৃত্যুকালে মানুষ তার সমগ্র জীবনের দৃশ্যপট একসাথে দেখে নেয়। তবে এদিক দিয়ে গল্পকথকের অভিজ্ঞতা কিছুটা আলাদা। তার মতে, “অতীতের কোনো কথাই মনে পড়েনি। আমার শুধু মনে পড়ছিল ভবিষ্যতের কথা।”
পৃথিবীর চলার পথ কতখানি অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ থাকে, লেখক মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার ‘একটি লিবিয়ান অপহরণ’ তার জানান দেয়। উত্তম পুরুষে লেখা এই গল্পের সাথে বাস্তব জীবনের দারুণ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
মেমোরি ম্যাট্রিক্স
জোভি, নিক, রুমেলা আর ভন একদম স্কুল জীবনের বন্ধু। বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি তাদের অগাধ আগ্রহ। অবশ্য জোভি একটু বেশিই চালাক। দু’মাস আগে মারা গিয়েছে ভন। এদিকে ক্ষমতার লোভে ভনের যুগান্তকারী আবিষ্কার, মেমোরি ম্যাট্রিক্স হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে ধূর্ত জোভি। কিন্তু ভনের স্ত্রী, ক্লদিয়া কী চায়? সে কেন করছে মেমোরি ম্যাট্রিক্সের সন্ধান?
সংকলনের অন্যতম চমকপ্রদ সংযুক্তি লেখক প্রদীপ্ত দে’র ‘মেমোরি ম্যাট্রিক্স’। জ্যমেয় ভু’র ন্যায় কাহিনির বিস্তৃতি ডালপালা ছড়িয়ে নভেলেটের আকার ধারণ করেছে এখানেও। কল্পবিজ্ঞানের আবহে লোভ, ক্রোধ কিংবা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের এই গল্পটা দারুণ গতিশীল। অসাধারণ বর্ণনা পাঠককে শুরু থেকেই বইয়ের পাতায় আটকে রাখবে।
ম্যাগাজিনের জগতে থ্রিলার জার্নাল এক অনন্য সংযোজন। বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে থ্রিলার, হরর, কল্পবিজ্ঞানের এরূপ সংকলন সত্যিই বিরল। আগের তিন সংখ্যার ছিল বাহারি সূচি— মৌলিক গল্প, অনুবাদ, ফিচার, গল্পধাঁধা, আর্টওয়ার্কের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু থাকত সেখানে। তবে এবারের পুরো সংখ্যা জুড়ে প্রাধান্য পেয়েছে শুধু গল্প। পেটমোটা বই পড়ার অবসরে এ ধরনের রোমাঞ্চকর গল্পের সংকলন পাঠকের মুখে হাসি ফোটাতে অব্যর্থ।
বই সংক্ষেপ
বই: থ্রিলার জার্নাল গল্পবাঁক সংখ্যা
ধরন: গল্প সংকলন
প্রকাশক: থ্রিলার পাঠকদের আসর
মুদ্রিত মূল্য: ৩২০ টাকা