‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’, ও ‘পিনবল,১৯৭৩’: হারুকি মুরাকামির প্রথম দুই উপন্যাস

হারুকি মুরাকামির লেখা প্রথম উপন্যাস ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’ (Hear the Wind Sing)। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় জাপানি ভাষায়, ১৯৭৯ সালের জুন মাসে। এই বইয়ের চরিত্রগুলো নিয়ে তিনি আরো তিনটি বই লিখেছেন, ‘পিনবল, ১৯৭৩’, ‘অ্যা ওয়াইল্ড শিপ চেজ’, এবং ‘ডান্স ডান্স ডান্স’। মুরাকামি পরের বইগুলোকে প্রথম বইয়ের সিক্যুয়েল বললেও মূল চরিত্রগুলো ছাড়া, বইগুলোর আর কোনো মিল নেই। এমনকি গল্পের মধ্যেও কোনো সংযোগ নেই। এই চারটি বইয়ের মধ্যে প্রথম দুটির অনুবাদ বাতিঘর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ করেছেন আলভী আহমেদ।

বরাবরের মতোই বাতিঘরের প্রকাশনা উৎকৃষ্ট মানের। বইয়ের কাগজের গুণমান থেকে মোটা মলাট, সবখানেই রুচির ছাপ স্পষ্ট। দুটো বইয়েরই প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী মিস্ত্রী। প্রচ্ছদও সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়েছে। বিশেষ করে বই দুটোর প্রচ্ছদের রং অনেকেরই মনে ধরার মতো। আর আলভী আহমেদ বর্তমান সময়ের সেরা একজন অনুবাদক। তার করা অনুবাদে ভাষার কোনো আড়ষ্টতা নেই, একদম মেদহীন ঝরঝরে অনুবাদ।

মুরাকামির ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’ লেখার ইতিহাস, সর্বোপরি নিজের লেখালেখি শুরুর ইতিহাস নিয়ে ২০১৪ সালে এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই নিবন্ধের অনুবাদও হিয়ার দ্য উইন্ড সিং বইয়ের অনূদিত সংস্করণের একদম শুরুতে জুড়ে দেয়া হয়েছে।

মুরাকামির লেখালেখি শুরুর গল্প, তার লেখার মতোই অনেক আকর্ষণীয়। লেখক হতে হবে এমন কোনো পরিকল্পনা তার ছিল না। তিনি যে লিখতে পারবেন— এই অভিপ্রায় তার মাথায় আসে আকস্মিকভাবেই। তিনি লেখা শুরুও করেন অনেকটাই অপরিকল্পিতভাবে। সেসময়ে তিনি ও তার স্ত্রী অনেক ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের জ্যাজ ক্লাব নিয়ে। সারাদিন কাজের পর মুরাকামি নিজের রান্নাঘরের টেবিলে লেখালেখি করতেন। এ কারণে, তার প্রথমদিকের লেখা উপন্যাস দুটোকে তিনি ‘কিচেন টেবিল ফিকশন’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। এভাবেই মুরাকামির লেখালেখির জগতে পদার্পণ।

হিয়ার দ্য উইন্ড সিং এর প্রচ্ছদ; ছবি: বাতিঘর

‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’ ও ‘পিনবল, ১৯৭৩’ দুটো বইয়েরই প্রধান চরিত্রগুলো এক। দুটো বইয়েই মূল চরিত্র উত্তম পুরুষে পাঠককে তার গল্প শোনায়। তবে লেখকের নাম পাওয়া যায় না দুটির কোনোটিতেই। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া, একুশ বছর বয়স্ক নামহীন এই তরুণের স্বপ্ন— সে লেখক হবে। একই স্বপ্ন দেখে তার বন্ধু র‍্যাট। আমাদের নামহীন প্রধান চরিত্র গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি এসে বন্ধু র‍্যাটের সাথে তাদের বড় ভাই অথবা বন্ধু জে-এর বারে আড্ডা দেয়। সচরাচর উপন্যাসে একটা গল্পের কাঠামো থাকলেও মুরাকামির প্রথম দুটি উপন্যাসে নির্দিষ্ট কোনো গল্প নেই।

‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’কে একধরনের দিনলিপিও বলা যেতে পারে, যেখানে মূল চরিত্রের ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসের আঠারোটি দিন বর্ণিত হয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে তার দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে অতীতের স্মৃতিচারণ। এই বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো অন্য প্রধান তিন চরিত্রের সাথে আমাদের মূল চরিত্রের মিথষ্ক্রিয়া। ছোটবেলা থেকেই এই নামহীন যুবক কথা বলত কম, তাই অন্যের সাথে কথোপকথনের বেশিরভাগ সময়েই তার ভূমিকা ছিল শুধুই শ্রোতার। এছাড়াও তার স্মৃতিচারণের মাধ্যমে আমরা তার জীবনের কিছু অধ্যায় এবং তার সাহিত্য নিয়ে ভাবনাও জানতে পারি।

‘পিনবল, ১৯৭৩’ এর প্রচ্ছদ; ছবি: বাতিঘর

‘পিনবল, ১৯৭৩’ এর গল্প শুরু হয় ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’ এর প্রায় তিন বছর পর থেকে। এরই মধ্যে বইয়ের প্রধান চরিত্রটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হয়ে তার বন্ধুর সাথে অনুবাদ কাজের ফার্ম খুলে ফেলেছে। এই বইয়েরও কোনো নির্দিষ্ট কাহিনী নেই। অনেকটা দিনলিপির মতোই আমরা মূল চরিত্রের দৈনিক জীবন ও তার স্মৃতিচারণ শুনি। এই বইয়ে আমরা দুই ধরনের ঘোরের প্রকাশ দেখি। মূল চরিত্রের পিনবল গেমের প্রতি আসক্তি, ও তার বন্ধু র‍্যাটের এক মেয়ের প্রতি আসক্তি। তবে প্রথম বইয়ে আমরা যে মূল চরিত্রের লেখক হবার বাসনা দেখতে পেয়েছিলাম এই বইয়ে তা আর দেখা যায় না।

‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমার পোস্টার; ছবি: The Movie Database

এই দুটি বইয়েরই মূল যে তিন চরিত্র নামহীন যুবক, জের‍্যাট তিনজনকেই মুরাকামির ভিন্ন ভিন্ন সত্ত্বা মনে হয়। নামহীন যুবক ও র‍্যাট দুজনেই লেখক হতে চায়। এমন লেখা লিখতে চায় যেটা তাদের ভেতর থেকে আসে। আমরা দেখি নামহীন যুবকের প্রিয় লেখক হচ্ছে হার্টফিল্ড যিনি সবসময় সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তিকে সাহিত্যমানের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা মুরাকামির নিবন্ধে দেখেছি তিনিও লেখার গুণগত মানের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন নিজের মনের ভাব প্রকাশকে। আবার সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছিল। আর জে একটা বার চালায় যেখানে জুকবক্সে জ্যাজ বাজানো হয়। যেমনটা মুরাকামি ও তার স্ত্রী তাদের জীবনের প্রথমার্ধে করেছিলেন, তারা একটা জ্যাজ ক্লাব চালাতেন যেটা মূলত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আড্ডা দেয়ার জায়গা ছিল। আমার মনে হয়েছে, মুরাকামি তার প্রথমদিকের উপন্যাসগুলোতে চরিত্রগুলোকে নিজের ছাঁচেই তৈরি করেছেন। হয়তো তিনি স্বপ্রণোদিতভাবে করেছেন, নাহলে হয়ে গিয়েছে তার অগোচর সাবলীলতায়। অবশ্য নিজের সৃষ্ট চরিত্রের মাধ্যমে নিজের চিন্তা প্রকাশ করা হারুকি মুরাকামির একধরনের ট্রেডমার্ক বলা যেতে পারে। এ ব্যাপারটি আমরা তার অন্য বইগুলোতেও দেখে থাকি।

হারুকি মুরাকামি; ছবি: The New York Times

হারুকি মুরাকামির বর্ণনা অত্যন্ত প্রাঞ্জল। একইসাথে জটিলতা ও বাহুল্য বিবর্জিত। তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘নরওয়েজিয়ান উড’, বা এ পর্যন্ত তার লেখালেখির ক্যারিয়ারের ম্যাগ্নাম ওপাস ‘কাফকা অন দ্য শোর’-এর সাথে তার লেখা প্রথম দুটি বইয়ের মূল পার্থক্যের জায়গা চরিত্রায়ন ও গল্পের কাঠামো বিন্যাসে। প্রথমদিকের বইয়ে মুরাকামি কোনো গল্প বলার চেষ্টা করেননি আর চরিত্রগুলোকেও ঢেলে সাজাননি। কিন্তু পরের দুটি বইয়ে লেখক যেমন গল্পের দিকে নজর দিয়েছেন, তেমনি প্রত্যেকটি চরিত্রকে বেশ ভালোভাবে তুলে ধরেছেন। যার ফলে পাঠক অনেক সহজেই চরিত্রগুলোকে ধরতে-বুঝতে পারে, যেটা তার প্রথমদিকের লেখা বইগুলোতে পারা যায় না।

তবে মুরাকামির সৃষ্ট বেশিরভাগ চরিত্রই আশ্চর্যরকমের নিঃসঙ্গ। তারা সমাজে বসবাস করেও যেন আলাদাই এক জগতে থাকে। এমন নয় যে তারা ‘সোশ্যালি মিসফিট’, তাদেরও সামাজিক জীবন আছে, কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে মুরাকামি নিঃসঙ্গতা ও একধরনের হাহাকার ফুটিয়ে তুলেছেন। মোটামুটি সাবলীল জীবন হবার পরও তার চরিত্রগুলোর মাঝে অদ্ভুত একধরনের শূন্যতা বিরাজমান। আর এ ব্যাপারে তিনি একদমই নির্লিপ্ত। মানে, সবকিছু যেমন চলছে চলুক না! অসুবিধা কোথায়!— এমন একটা ভাব। এরই সাথে আছে মুরাকামির লেখার সূক্ষ্ম রসবোধ ও ছোট ছোট বাক্যে সাবলীল গল্পকথন। চরিত্রের উপস্থাপন ও গল্প বলার অনন্য ধরন— এই দুইয়ের মিশেলে হারুকি মুরাকামি পরিণত হয়েছেন তার সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় লেখকে।

Language: Bangla

Topic: This article is on first two books written by Haruki Murakami. 

Featured Image: leelenghuat

Related Articles

Exit mobile version