মহান জার্মান ঔপন্যাসিক এরিক মারিয়া রেমার্ক বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত তার যুদ্ধবিরোধী উপন্যাসগুলোর জন্য। কৈশোরে জার্মানির হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, যুদ্ধ করেছেন পশ্চিম রণাঙ্গনের দ্বিতীয় কোম্পানিতে, আবার শত্রুপক্ষের শেলের আঘাতে আহত হয়ে যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করতে হয়েছে তিন মাসের মধ্যেই। সেই যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় লেখা উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ তাকে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। অদ্যাবধি সেই বই বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিক বলে ব্যাপকভাবে পঠিত এবং আলোচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে তার উপন্যাস ‘দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক’। তৎকালীন বাস্তবতায় অ্যাডলফ হিটলারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সামাজিক পটভূমি চমৎকারভাবে অঙ্কিত হয়েছে এ উপন্যাসে। রেমার্কের অন্যান্য উপন্যাসের মতো এটিও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।
উপন্যাসের মূল কাহিনীতে প্রবেশ করবার আগে এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা জরুরি। ১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তখন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য, বুলগেরিয়া এবং উসমানী সাম্রাজ্যের সাথে অক্ষশক্তি হিসেবে যোগ দেয় সম্রাট ভিলহেলম কাইজারের নেতৃত্বাধীন জার্মানি। তাদের বিপরীতে যুদ্ধে নামে সার্বিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, রুমানিয়া, এবং মার্কিনিদের মিলিত মিত্রশক্তি। সেই যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় ঘটে অক্ষশক্তির। সেই গ্লানিময় সময়ে জার্মানির জন্য যুদ্ধবিরতি বা সমঝোতা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না।
যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানির ওপর মিত্রশক্তি চাপিয়ে দেয় ঐতিহাসিক ভার্সাই চুক্তি। অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, একপেশে এই চুক্তির কারণেই উন্মুক্ত হয়েছিল ততোধিক ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ। এ চুক্তিতে ছিল মিত্রশক্তিকে যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির জন্য বিপুল ক্ষতিপূরণ দেওয়া, সৈন্যবাহিনী সংকুচিত করা, বিভিন্ন মহাদেশে জার্মানির কলোনিগুলোকে মিত্রশক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া প্রভৃতি ধারা, যা জার্মানির জন্য ছিলো ভীষণ অপমানজনক। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, সামাজিক অস্থিরতা, বিশৃঙ্খল জনবল, এবং তার সাথে জার্মানির দুর্ভাগ্যের তালিকায় যুক্ত হয় ভার্সাই চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ। বহুমুখী চাপে ভেঙে পড়ে জার্মান অর্থনীতি। বিপুল বেকারত্ব, মুদ্রার দরপতন, চতুর্দিকে অনাহার-দারিদ্র্য-অসন্তোষ- সবমিলিয়ে হিমশিম খেতে থাকে জার্মান সরকার। ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরের বছরই উত্থান ঘটে জার্মান নাৎসি পার্টির। ব্যাপক গণ-অসন্তোষকে পুঁজি করে তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে ভার্সাই চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। পুরো জার্মানি জুড়ে বইতে শুরু করে উগ্র জাতীয়তাবাদের লু হাওয়া। বিশ্বের ইতিহাসে পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখা এই টালমাটাল পরিস্থিতিকেই ঔপন্যাসিক এরিক মারিয়া রেমার্ক বেছে নিয়েছেন তার উপন্যাসের ক্যানভাস হিসেবে।
উপন্যাসের শুরুর সময় ১৯২৩ সালের এপ্রিল মাস। স্থান ওয়ার্ডেনব্রাক নামক একটি ছোট্ট জার্মান শহর। গল্পের মূল প্রোটাগনিস্ট লাডউইগ বডমার নামের এক যুবক। সে যুদ্ধফেরত ল্যান্স কর্পোরাল। তার বয়সী অন্যদের মতো তাকেও যোগ দিতে হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। তখন তার বয়স মাত্র সতেরো। যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে সহযোদ্ধা জর্জ ক্রলের বদান্যতায় লাডউইগ যোগ দেয় তাদের পারিবারিক ব্যবসা ‘ক্রল কোম্পানি’তে। থাকার জায়গাও হয়ে যায় জর্জের বাসার এককোণে। মৃতদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ফলক, স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির কাজ করে সেই কোম্পানি। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির অভিশাপে দিশেহারা পুরো জার্মানির মতোই সময় তাদের ভালো যাচ্ছে না। এক ডলারের দাম হয়েছে ছত্রিশ হাজার মার্ক, আর লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো সেই দাম বেড়েই চলেছে প্রত্যেক ঘন্টায়! সকালে কোনো জিনিসের যা দাম, দেখা যাবে বিকেলেই তা হয়ে গেছে দ্বিগুণ। অবস্থা এমন দাঁড়ায়- শ্রমিকদের দিনে দুবার করে মজুরি দিতে হচ্ছে, মজুরি নিয়ে তারা কিছু সময়ের জন্য ছুটি পেত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটার জন্য। তারপরও বাজারে গিয়ে দেখা যেত মজুরির অর্থে বিশেষ কিছুই কেনা সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতির সাথে যুঝতে না পেরে কেউ শহর ছাড়ছে, আত্মহত্যার ঘটনাও বিরল থাকছে না।
লাডউইগ ব্যবসায়ী হলেও সংবেদনশীল মনের অধিকারী। দুঃসহ এই পরিস্থিতিতে কোনোমতে বেঁচে থেকে গোপনে কবিতা লেখে সে। আর গির্জার উন্মাদ আশ্রমে রবিবার অর্গান বাজায়। এর একটা কারণ যৎসামান্য বেতনের পাশাপাশি গির্জার ভালো নাস্তা। পাশাপাশি, সেখানে সে নিরুপদ্রব মানসিক শান্তিও পায়। কারণ, ওখানে কেউ তার বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় পাওয়ার জন্য যুদ্ধ, রাজনীতি বা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ লেকচার দিতে আহ্বান জানায় না। গির্জার শান্ত পরিবেশ, বাগানের নিঃশব্দ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে উদাস করে দেয়। একজন ‘বিশেষ মানুষ’ও তাকে টানে। সে ইসাবেল। একহারা গড়নের যুবতী, কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ। সে কখনো নিজেকে ইসাবেল, আবার কখনো জেনি বলে পরিচয় দেয়; অন্যদেরও একেক সময় একেক নামে ডাকে। এই যুবতীর প্রতি বিশেষ মায়ামিশ্রিত আকর্ষণ বোধ করে লাডউইগ; প্রত্যেক রোববারে বাগানে একসাথে কিছুটা সময় কাটাতে আনচান করে তার মন।
বিরাজমান আর্থসামাজিক সংকট সামাল দিতে যখন সরকার হিমশিম খাচ্ছে, তখনই জার্মানদের চোখে নতুন দিনের স্বপ্ন নিয়ে আবির্ভূত হন হিটলার। তার অনলবর্ষী বক্তৃতা আগুন ধরিয়ে দেয় জনগণের রক্তে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে- প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ নন, তাদের একমাত্র ত্রাণকর্তা হতে পারেন হিটলার। উপন্যাসে দেখা যায়- হিটলারের সমর্থকেরা সংগঠিত হয়ে দেশপ্রেমের ‘পরীক্ষা’ নিচ্ছে দেশজুড়ে। একটি দৃশ্যে একদল লোক হোটেলে ঢুকে জাতীয় সংগীত বাজাতে শুরু করে, এবং সবাইকে আদেশ করে উঠে দাঁড়িয়ে গলা মেলাতে। লাডউইগসহ অগ্রজরা এরূপ পাগলামির নিন্দা করলে দলটি তাদের ‘বলশেভিস্ট’, ‘দেশদ্রোহী’ প্রভৃতি বলে গালি দিতে থাকে। এমনকি, লাডউইগের যুদ্ধে অংশ নেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলে তারা। উগ্র জাতীয়তাবাদের সাথে অন্ধ ইহুদিবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। যুদ্ধে যাওয়া জার্মানদের স্মৃতিফলক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক পাদ্রি নিমন্ত্রিত হলেও বঞ্চিত হন ইহুদি র্যাবাই; উল্টো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় তাকে। যুদ্ধফেরত জনৈক প্রভাবশালী মেজর উলকেনস্টাইন হিটলারের অনুসরণে স্থানীয় সমাবেশে বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের জন্য ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘বিদেশি স্পাই’ ইহুদিরা দায়ী বলে তাদের কোণঠাসা করার ছবক দিয়ে বেড়ান। শুরু হয় যুদ্ধ করা জার্মানদের তালিকা থেকে ইহুদিদের নাম বাদ দেওয়ার পাঁয়তারা।
রেমার্কের নিজের জীবনের প্রতিফলন এই উপন্যাসে পাওয়া যায়। হিটলার ক্ষমতায় আরোহণের পর রেমার্কের লেখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় দেশজুড়ে। লাইব্রেরি থেকে সরিয়ে ফেলা হয় তার লেখা সমস্ত বই; বিক্রি কিংবা প্রকাশ করার উপরও নেমে আসে খড়গ। ১৯৩৩ সালের ১০ মে খ্যাতনামা বহু লেখকের সাথে পুড়িয়ে ফেলা হয় তার কয়েকটি বই। নাৎসিরা এমন দাবিও করে যে, রেমার্ক নাকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশই নেননি! নিজের চোখে দেখা পিতৃভূমির এই দুরবস্থা এবং এক ফ্যাসিবাদি শাসকের উত্থানের পটভূমি উপন্যাসের পাতায় আঁকতে তাই বিশেষ বেগ পেতে হয়নি রেমার্ককে।
দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে জার্মানির মানুষের অসহায়ত্ব, উদভ্রান্তি, দুঃখ, ভালোবাসা উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। লাডউইগের সাথে ইসাবেল এবং ডাক্তার ওয়ার্নিকের কিছু কথোপকথন হৃদয়ে নাড়া দেওয়ার মতো। রেমার্কের অন্যান্য বইয়ের মতো এখানেও রয়েছে প্রচুর জীবনদর্শন। ‘প্রথমা প্রকাশন’ থেকে বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে; অনুবাদ করেছেন লব্ধপ্রতিষ্ঠ অনুবাদক শেখ আবদুল হাকিম। হাকিমের অনুবাদের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, রেমার্ক স্বয়ং বাংলায় লিখলে বোধহয় এর চেয়ে সুন্দর, সাবলীল ভাষায় লিখতে পারতেন না!
যুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতা নিয়ে রেমার্কের মতো লেখকজীবনের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত খুব কম লেখকই কাজ করেছেন। যুদ্ধ এবং যুদ্ধ শেষে যুদ্ধাহতদের নতুন যে যুদ্ধ- অনবদ্য দক্ষতায় তার সকরুণ চিত্র রক্তমাংসসমেত তুলে আনেন তিনি। ‘দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক’ যেভাবে শুরু হয়েছিল, তাতে এর ক্যানভাস আরো বড়ো হতে পারত, যেমন হয়েছে রেমার্কের ক্লাসিকত্রয়ী ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, ‘দ্য রোড ব্যাক’, কিংবা ‘থ্রি কমরেডস’- এর ক্ষেত্রে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানিতে হিটলারের বর্ধিষ্ণু জনপ্রিয়তা সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে এ উপন্যাসে, তা যথাযোগ্য পরিণতি পেতে পারত একই উপায়ে হিটলারের ক্ষমতাআরোহণ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বর্ণনা দিয়ে। কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি এখানে। হিটলারের ক্ষমতাপ্রাপ্তি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার ইঙ্গিত আছে এই উপন্যাসে, তবে তা যেন শুধু বলার জন্যই বলা। ব্যক্তিমানুষের দ্বন্দ্ব, ক্ষোভ ও সেই সময়ের টালমাটাল আর্থসামাজিক চিত্র অঙ্কনেই যেন রেমার্ক বেশি মনোযোগী ছিলেন। বোধকরি সেজন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা হিটলারি শাসনামলের বদলে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছেন অমোঘ মৃত্যু আর ধ্বংসের প্রতীক ‘ব্ল্যাক অবিলিস্ক’কে (কবরের ওপর স্থাপিত সমাধিফলককে অবিলিস্ক বলে)। তথাপি, অস্বীকার করার উপায় নেই- রেমার্ক এমন এক লেখক, যার প্রায় প্রতিটি উপন্যাসই ক্লাসিকের মর্যাদাপ্রাপ্ত। ‘দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির সকরুণ সামাজিক দলিল হিসেবে সেই ধারার এক অনন্য সৃষ্টি হয়েই বেঁচে থাকবে- এ কথা বলাই বাহুল্য!