আপনাকে যদি বলা হয় মারভেল সুপারহিরোদের মধ্যে পছন্দের চরিত্র কোনটি, কেউ হয়তো বেছে নেবেন স্পাইডার ম্যান, কেউ আয়রন ম্যান অথবা কেউ ক্যাপ্টেন আমেরিকা। খুব কম মানুষই বলবেন ব্লেইডের কথা।
এমনটা হবারই কথা, ব্লেইড চরিত্রটি মারভেল কমিকের ‘সি’ গ্রেডের চরিত্র! কমিকবুকে সত্তরের দশকে ব্লেইডের সৃষ্টি হলেও একুশ শতক শুরুর আগে খুব কম মানুষই চরিত্রটি ভালোভাবে চিনতো। ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ওয়েসলি স্নাইপস’ অভিনীত ‘ব্লেইড’ সিনেমাটি অবশ্য পুরো ঘটনা পাল্টে দেয়। কালো পোশাকের সাথে কালো চশমা পরা এবং রুপার তলোয়ার ব্যবহার করা এই স্টাইলিশ ভ্যাম্পায়ার হান্টার মানুষের মনে জায়গা করে নেয় খুব দ্রুত।
ব্লেইড সিনেমাটির পর এই সিরিজের আরো দুটি কিস্তি মুক্তি পায় যথাক্রমে ২০০২ এবং ২০০৪ সালে। হলিউড সুপারহিরো সিনেমা এবং মারভেল স্টুডিওর জন্য সিনেমা তিনটি অনেক গুরুত্ব বহন করে। এই সিনেমাগুলো না থাকলে বক্স অফিস থেকে প্রায় বিশ বিলিয়ন ডলার আয় করা বর্তমান এই মারভেল স্টুডিওর অস্তিত্বই হয়তো থাকতো না!
‘ব্লেইড’ হলিউডের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা অভিনীত সুপারহিরো সিনেমা এবং তা-ও ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ মুক্তি পাবার বিশ বছর আগে মুক্তি পেয়েছিলো। আবার হলিউডের প্রথম আর রেটেড সুপারহিরো সিনেমাও ছিলো ব্লেইড।
কমিক এবং অন্যান্য মিডিয়ায় ব্লেইড
১৯৭৩ সালে মারভেল কমিকের ‘টুম্ব অফ ড্রাকুলা’র দশম ইস্যুতে ব্লেইডের প্রথম পরিচয় করান মার্ভ উলফম্যান এবং জিন কোলান। কমিকে ব্লেইডের গল্পটি বেশ অন্যরকম। ব্লেইড হলো একজন অর্ধমানব-অর্ধভ্যাম্পায়ার যার জীবনের লক্ষ্যই হলো অন্যান্য ভ্যাম্পায়ারদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া, সোজা কথায় ব্লেইড একজন ভ্যাম্পায়ার হান্টার।
ব্লেইড নামে পরিচিত হলেও চরিত্রটির আসল নাম এরিক ব্রুকস। উনিশ শতকের শুরুতে এক পতিতালয়ে জন্ম এরিকের। ব্লেইড গর্ভে থাকা অবস্থায় মা টারা ব্রুকস এক ভ্যাম্পায়ার ‘ডিকন ফ্রস্টের’ কবলে পড়েন। পরবর্তীতে এরিককে জন্ম দিয়েই মারা যান টারা। জন্ম হয় অর্ধমানব-অর্ধভ্যাম্পায়ার ব্লেইডের। ভ্যাম্পায়াররা দিনের বেলা বেরোতে পারে না এবং রুপার জিনিস সহ্য করতে পারে না কিন্তু এরিকের এসব ব্যাপারে কোনো সমস্যা ছিলো না। ভ্যাম্পায়ারদের দুর্বলতা বাদে সমস্ত সুপার পাওয়ার ব্লেইডের ছিলো। দিনে চলতে পারবার জন্যই ব্লেইডকে ডাকা হতো ‘ডে-ওয়াকার’ নামে।
কৈশোরে ‘জামাল আফারি’ নামে এক ভ্যাম্পায়ার হান্টার থেকে ব্লেইড প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে। কিন্তু সেই ভ্যাম্পায়ারের কবলেই জামাল আফারির মৃত্যু ব্লেইডকে পুরদস্তুর ভ্যাম্পায়ার হান্টার বানিয়ে দেয়। বন্ধু হুইসলারকে সাথে নিয়ে ভ্যাম্পায়ারদের যম হয়ে উঠে ব্লেইড। ড্রাকুলা, ডিকন ফ্রস্ট এবং মরবিয়াসের মতো বিখ্যাত কিছু মারভেল খলচরিত্রের সাথে লড়াই হয় ব্লেইডের।
টেলিভিশনে ব্লেইডকে প্রথম দেখা যায় ১৯৯৪ সালের ‘স্পাইডার ম্যান দ্য অ্যানিমেটেড সিরিজে’। কুখ্যাত ভ্যাম্পায়ার এবং স্পাইডার ম্যান খলনায়ক মরবিয়াসের মোকাবিলা করতে দেখা যায় ব্লেইডকে। পরবর্তীতে ‘ব্লেইড দ্য সিরিজ (২০০৬)’, ‘ব্লেইড অ্যানিমে সিরিজ (২০১১)’, ‘আল্টিমেট স্পাইডার ম্যান (২০১৩) এবং ‘মারভেল ডিস্ক ওয়ার্স: দ্য অ্যাভেঞ্জারস (২০১৫)’ টেলিভিশন সিরিজগুলোতে ব্লেইডের দেখা মিলে।
নব্বইয়ের দশকে ব্লেইড সিনেমা করার সত্ত্ব কিনে নেয় ‘নিউ লাইন’ স্টুডিও। ডেভিড এস গয়ারের হাতে দায়িত্ব পড়ে সিনেমাটির চিত্রনাট্য লিখার। এই লেখকই পরবর্তীতে ‘ডার্ক নাইট ট্রিলজির তিনটি সিনেমাসহ বিখ্যাত অনেক সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন।
ব্লেইডের চরিত্রটিতে অভিনয় করবার জন্য ডেনজেল ওয়াশিংটন, লরেঞ্জ ফিশবার্নের মতো অভিনেতারা তালিকায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত ওয়েসলি স্নাইপস চরিত্রটি পান দুটি কারণে। ওয়েসলি স্নাইপস ছিলেন অনেক বড় কমিকবুক ফ্যান এবং তিনি খুব ভালো মার্শাল আর্ট জানতেন যা ব্লেইড চরিত্রটির সাথে মিলে যায়।
মার্শাল আর্ট জানা থাকায় ব্লেইড সিরিজের সিনেমাগুলোর সমস্ত মারামারির দৃশ্যগুলো স্নাইপসের নিজের পরিকল্পনাতে করা। স্টিফেন নরিংটনের পরিচালনায় ‘ব্লেইড’ নামের সিনেমাটি ১৯৯৮ সালে মুক্তি পায়।
মূল কমিকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ব্লেইডের অরিজিন অনেকটা একই রাখা হয় সিনেমাটিতে। সিনেমায় ব্লেইডের বয়স সাধারণ মানুষের মতো বাড়লেও ভ্যাম্পায়ারদের সুপার পাওয়ারগুলো এবং দিনে চলাফেরা করার ক্ষমতা তার ছিলো।
সিনেমাটিতে ব্লেইড ডিকন ফ্রস্টের সাথে মোকাবিলা করে। এই সিনেমাসহ পরবর্তী দুই ব্লেইড সিনেমা প্রযোজনা করেন ওয়েসলি স্নাইপস এবং ডেভিড এস গয়ার লেখক হিসেবেই থেকে যান। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সিনেমাতে যথাক্রমে ব্লেইড কিং ও ড্রাকুলার মুখোমুখি হয়।
ওয়েসলি স্নাইপস কান্ড
এই তিনটি ব্লেইড সিনেমা করতে গিয়ে বহু সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন অভিনেতা। স্নাইপসকে নিয়ে হলিউড পাড়ায় বহু অভিযোগ রয়েছে, যার অনেকগুলো অনেকটাই অবিশ্বাস্য। সিনেমার সেটে কাজ করবার জন্য তিনি মোটেও সুবিধার মানুষ ছিলেন না। ব্লেইড সিরিজের তৃতীয় সিনেমা ‘ব্লেইড ট্রিনিটি’র শুটিং করবার সময় স্নাইপসের ওপর অভিযোগের তীর সবচেয়ে বেশি আসে।
সিনেমা ক্রুদের ভাষ্যমতে, স্নাইপস নিজের ট্রেইলারে দিনের পর দিন বসে থাকতেন। পরিচালকের কথা মতো অভিনয় করতেন না এবং সেটে ওয়েসলি বা স্নাইপস নামে ডাকলে সাড়া দিতেন না, ব্লেইড নামে ডাকতে হতো স্নাইপসকে! ‘ব্লেইড: ট্রিনিটি’ সিনেমার পরিচালক এস গয়ারের সাথে স্নাইপসের জনসম্মুখে তর্কাতর্কি পর্যন্ত হয়েছিলো। সিনেমার একটি দৃশ্যের জন্য চোখ বন্ধ থেকে চোখ খুলতে হতো স্নাইপসকে। অনেকবার বলার পরও চোখ খুলতে নারাজ অভিনেতা! পরবর্তীতে সিজিআই করে বন্ধ চোখে খোলা চোখ লাগাতে হয়েছিলো পরিচালককে।
এত কিছুর পরও ব্লেইড ট্রিনিটি মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পরই ওয়েসলি স্নাইপস সিনেমাটির অন্যান্য প্রযোজকদের বিপক্ষে আদালতে বর্ণবাদ এবং তাকে না জানিয়ে সহ-অভিনেতা ঠিক করার নালিশ করে ৫ মিলিয়ন ডলার দাবি করেন!
মারভেল স্টুডিওতে ব্লেইডের অবদান
ওয়েসলি স্নাইপসের সিনেমাগুলো নিয়ে বিতর্ক হলেও মারভেল স্টুডিওর জন্য সিনেমা তিনটি ত্রাণকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আজকের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করা মারভেল স্টুডিও হয়তো থাকতোই না এই সিনেমাগুলো না হলে!
৪৫ মিলিয়ন ডলার বাজেটের প্রথম সিনেমাটি বক্স অফিসে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার তুলে নেয়। সব মিলিয়ে তিনটি সিনেমাতে বক্স অফিস থেকে প্রায় ৫৬৭ মিলিয়ন ডলার আয় হয় ‘নিউ লাইন’ স্টুডিওর। নিউ লাইন সিনেমাগুলো তৈরি করায় মারভেল এখান থেকে তেমন আয় করেনি, তবে কীভাবে এই সিনেমাগুলি পথপ্রদর্শক হলো মারভেলের?
সে প্রশ্নের উত্তর জানতে চলুন জেনে আসি প্রথম সুপারহিরো সিনেমা তৈরির ইতিহাস। কমিকবুক থেকে সিনেমা তৈরির ধারণা প্রথম আসে ডিসি কমিক্স থেকে। সত্তর, আশির দশকে ডিসি সর্বপ্রথম সুপারম্যানের দুটি সিনেমা এবং ব্যাটম্যান মুক্তি দেয়, যা বক্স অফিসে কিছুটা সাফল্য লাভ করে, যার কারণে আরেক কমিকবুক কোম্পানি মারভেল ঠিক করে তারাও সিনেমা বানাবে। কিন্তু মারভেল মোটেও সাফল্য পায়নি এই বিভাগে। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকটা কমিকবুক সিনেমার জন্য খুব খারাপ সময় ছিলো। ডিসির নতুন ব্যাটম্যান সিনেমা বক্স অফিসে বাজে ফলাফল করে। এই সময়ে মারভেল একটি ফ্যান্টাস্টিক ফোর সিনেমা বানিয়ে তা আর মুক্তি দেয়নি।
মারভেল আবার বড় বাজেটের শিশুদের লক্ষ্য করে তৈরি করে একটি সিনেমা ‘হাওয়ার্ড দ্য ডাক’, যা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। এই সময় থেকেই মারভেল অল্প কিছু টাকার জন্য নিজেদের কমিকবুক চরিত্রগুলোর সত্ত্ব বিভিন্ন স্টুডিওকে দিতে থাকে।
ব্লেইড সিনেমাটিই মারভেলের এই অন্ধকার যুগে কিছুটা আলো এনে দেয়। ব্লেইড মারভেলের প্রথম আধুনিক সিনেমা বলা যায়। ডেভিড এস গয়ারকে চিত্রনাট্যকার হিসেবে নিয়ে মারভেল বাজিমাত করেছিলো। ডেভিড চরিত্রটিকে শুধুমাত্র একজন ভ্যাম্পায়ার হান্টার হিসেবে না নিয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে ভেবেছেন। পরিচালকের সাথে আলোচনা করে সিনেমাটি বড়দের লক্ষ্য করে তৈরি করেছেন। রক্ত, বীভৎসতা সবকিছু নিয়েও কাল্পনিক পৃথিবী এবং সত্যিকার দুনিয়ার অদ্ভুত এক মিশেল দেখিয়েছিলেন ডেভিড, যা আগের সুপারহিরো সিনেমাগুলো করে দেখাতে পারেনি। এসব ব্যাপার এবং ওয়েসলি স্নাইপসের ব্লেইড চরিত্রে স্টাইলিস্টভাবে অভিনয় করা, রাতারাতি সিনেমাটিকে ‘কাল্ট ক্ল্যাসিকে’ পরিণত করে।
সিনেমাটির এই সাফল্যতেই মারভেলের টনক নড়ে। তাদের কমিকবুকের সি গ্রেডের একটি চরিত্রের সিনেমাই যদি এত সাফল্য পায়, তাহলে এ গ্রেডের চরিত্রগুলোর কী হবে!
যেই ভাবা সেই কাজ, ব্লেইড মুক্তি পাবার এক বছর পরই স্পাইডার ম্যানের সত্ত্ব ‘সনি পিকচারস’ এর কাছে বিক্রি করে দেয় মারভেল। ততদিনে ব্লেইডের দেখাদেখি ২০০০ সালে ‘এক্স ম্যান’ রিলিজ পায় টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স থেকে। সে সিনেমাটিও তুমুল সাফল্য পায় বক্স অফিসে। কিন্তু ২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া স্যাম রেইমি পরিচালিত স্পাইডার ম্যান বক্স অফিস থেকে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার তুলে নেয়, যা মারভেলকে নিজেদের সিনেমা নিজেরাই তৈরি করবার চিন্তা যোগায়। এর ফলাফল মারভেল স্টুডিও যা ২০০৮ সালে ‘আয়রন ম্যান’ সিনেমা দিয়ে যাত্রা শুরু করে।
মজার ব্যাপার হলো, যে সিনেমা মারভেলকে প্রথম সাফল্যের পথ দেখিয়ে দিয়েছে, সেই ব্লেইডের সত্ত্ব মারভেল স্টুডিওর কাছে ২০১১ সালে ফিরে আসে। এতদিন পর্যন্ত ব্লেইড নিয়ে মারভেলের কোনো চিন্তাভাবনাই ছিলো না। ২০১৮ সালে অস্কার জেতার পর ‘মাহের্শালা আলী’ মারভেল স্টুডিও প্রধান কেভিন ফাইগির সাথে আলোচনা করে বলেন, তিনি ব্লেইড চরিত্রটিকে আবার বড় পর্দায় ফেরাতে চান! কেভিন ফাইগির ভাষ্যমতে,
যখন একজন অস্কার জেতা অভিনেতা আপনার সাথে কাজ করতে চাইবে আপনি চোখ বন্ধ করে রাজি হয়ে যাবেন এটাই নিয়ম!
এবং ফাইগি তা-ই করলেন। এই বছরের স্যান ডিয়েগো কমিকনে ঘোষণা দিলেন ‘মাহের্শালা আলী’ অভিনীত ব্লেইড সিনেমা হতে যাচ্ছে, তা হবে মারভেলের পঞ্চম ফেইজের একটি সিনেমা, অর্থাৎ ২০২১ এর পর সিনেমাটি মুক্তি পাবে।
প্রায় বিশ বছর পর ব্লেইড ফ্যানরা আবার স্টাইলিশ সেই ভ্যাম্পায়ার হান্টারকে বড় পর্দায় দাপিয়ে বেড়াতে দেখবেন।