সময় কখনো এক মুহুর্তের জন্যেও থেমে থাকে না. কিন্তু কখনও কখনও কিছু কিছু দৃশ্য দেখলে মনে হয়, সময় বুঝি থমকে আছে।
– মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে বাংলা সাহিত্য ছিল অন্ধকারে। এই সময়কালের ঘটনা বা ইতিহাস বা জীবনযাত্রার কোনোকিছুরই প্রতিফলন দেখা যায় না কোনো সাহিত্যকর্মে। এমনকি এখন অবধি ঐ সময়টাকে মানুষ এড়িয়ে চলে। অথচ উপাদানের বিচারে যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়, নাগরিকদের স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা, নিজের দেশে বসেও পরাধীনতার অদৃশ্য শেকলে বাঁধা জীবন, অস্থির আর নোংরা রাজনীতির উত্থান- এসব মোটেই কম কিছু নয়।
জাতির লজ্জাজনক অধ্যায় কি না আর নয়তো কোনো এক অদ্ভুত আর অজানা কারণে এই সময়টাকে এড়িয়ে চলা হয়। তবে এড়িয়ে চলাটা কোনো সমাধান হতে পারে না। কেননা ভুল থেকেই মানুষ শিক্ষা নেয়, নয়তো এড়িয়ে গিয়ে ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করতে থাকে বারবার। এই সময়কালের রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশ্লেষণের পাশাপাশি একটি খুনের তদন্তকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন রচিত কেউ কেউ কথা রাখে বইটির গল্প। বইটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে একটু বই কেন্দ্রিক কিছু বিষয় জেনে নেওয়া দরকার।
আজকের বাংলাদেশ, যা নদীমাতৃক পলিসমৃদ্ধ এক ভূমি, তার জন্মলগ্নের সূচনা বহু হাজার বছর আগে। -রিজিয়া রহমান।
প্লাইস্টোসিন যুগের শেষের দিকে অথবা তৃতীয় হিমবাহ যুগের সময়কালে বর্তমান জনবসতিপূর্ণ এই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। যদিও এই ভূমির সঠিক উৎপত্তিকাল সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে, তবে ধারণা করা হয় আনুমানিক তিন লক্ষ বছর পূর্বে এই ভূমির জন্ম। বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক গঠনে অস্ট্রো-এশিয়াটিক জাতির কথাই উল্লেখযোগ্য, যাদের একটি শাখা স্থলবাসী ছিল এবং একটি শাখা জলবাসী বা নৌকায় ঘুরে ঘুরে জীবনযাপন করত, যাদেরকে আজকের যুগে বেদে বা বাইদ্যা বলে অভিহিত করা হয়।
বাংলার প্রাচীন ইতিহাসে কোনো কালেই এ ভূমি অখণ্ড রাষ্ট্র ছিল না। বঙ্গ, পুণ্ড্র, হরিকেল, বরেন্দ্র এরকম ১৬টি জনপদে বিভক্ত ছিল। বৈদিক যুগে প্রাচীন পুণ্ড্র নগরের বাসিন্দারাই এই দেশে সর্বপ্রথম জনপদ গড়ে তুলেছিল। এরপর থেকে মৌর্যযুগ, পালযুগ, সেন সাম্রাজ্য, সুলতানী আমল, মোঘল সাম্রাজ্য, বিদেশী বণিকদের উপনিবেশ, নবাবী আমল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজত্ব, পাকিস্তানী রাজত্বকাল পার করে এই দেশ এবং এই দেশের জাতি স্বাধীন হয়ে নিজস্ব সত্ত্বা এবং স্বকীয়তা পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু! তোমার স্বাধীন দেশে হায়দাররা বেঘোরে মরে পড়ে থাকে। মিলিদের জীবনস্বপ্ন ধর্ষিত হয়। কিন্তু ইমতিয়াজরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়!
– মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল। স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশটার মানুষগুলো নিজস্ব জাতিসত্ত্বার মর্যাদা পেয়ে খুশিমনেই দিনযাপন করতে শুরু করেছিল। যুদ্ধবিধস্ত দেশটাকে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছিল সবেমাত্র। কিন্তু এরইমধ্যে অরাজকতা দেখা দিল। মিত্রবাহিনীর লুটতরাজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, শহরের রাজপথে আবারো দাঙ্গা-ফ্যাসাদ, খুন-রাহাজানি নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে গেল। ডাকাতি, চোরাকারবারি, ধর্ষণের খবরগুলোতে পত্রিকাগুলো ভারী হয়ে থাকত। খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, গুমের মতো অন্যায় করেও পার পেয়ে যেতে লাগলো অনেকে, অথচ যুদ্ধবিধস্ত দেশটার উন্নতির কথা দিয়ে পত্রিকাগুলো পূর্ণ থাকার কথা ছিল। কিছুদিন আগেও যে লোকেরা নিজের দেশ বলে গর্ব করত, তারাই আবার সেই স্বৈরাচারী পাকিস্তান আমলকেই ধন্য করতে শুরু করলো। বেশিরভাগ মানুষেরই ভাবনা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছু গুছিয়ে নেবেন। আবার অনেকে তাঁকে দোষারোপও করতেন!
সেই সময়টায় মানুষজন তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল ভাবলো- যিনি দেশের জন্ম দিতে ন্যূনতম ভয় পাননি, সকল বাঁধাকে নিজের গাঁয়ে নিয়েছেন, তিনিই হয়তো দেশটাকে গুছিয়ে নেবেন, শুধু তাকে খানিকটা সময় দিতে হবে। আরেকদল ভাবলো- গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচারীতা শুরু হয়েছে, দেশটা সবার; তাই সবার সার্বিক দিকটা দেখাশোনা করাই সরকারের দায়িত্ব; আর তা নাহলে তো পাকিস্তান আমলই ভালো ছিল। অন্য আরেকদল ভাবতো- এই দেশটার কোনো অতীত ছিল না, কোনো বর্তমান নেই এবং কোনো ভবিষ্যতও হয়তো হবে না।
এই তিনদলের একদলের ভাবনাপ্রসূত চিন্তাতেই ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পরও লোকেরা তিনদলে আলাদা হয়ে যায়। একদল- যারা এই কাজ করেছে তাদের পক্ষে সাফাই গাইলো। আরেকদল- নিজেদের অভিভাবকহীন অবস্থায় আবিষ্কার করলো। এবং তৃতীয়দল ঠিক আগের ভাবনাটাই ভাবলো। অথচ এই তিন দলের কেউই স্বেচ্ছায় আগ বাড়িয়ে দেশের জন্যে কিছু করতে আগ্রহী হননি কেবল ভাবনা ছাড়া।
কেউ কেউ কথা রাখে নামটি খুব বেশিই কাব্যিক ঘরানার, কেননা কেউ কথা রাখেনি এই শিরোনামে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি জনপ্রিয় কবিতাই আছে। তবে নাম কাব্যিক হলেও বইটার পটভূমি রচিত হয়েছে একটি খুনের তদন্তের উপর নির্ভর করে। বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে জানা যায়, অস্থির আর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে একটি খুনের তদন্তে জড়িয়ে যায় ভিন্ন মত আর স্বভাবের দুজন মানুষ। অনেক কষ্টে খুনি ধরা গেলেও হত্যারহস্য আর মীমাংসা করা গেল না। এই খুন এবং খুনের তদন্তই বদলে দিল কয়েকজন মানুষের জীবন। দুই যুগ পর এক লেখক ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো সেই হত্যারহস্য উদঘাটনে। প্রকৃতির উপর নির্ভর করা এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হয় লেখক নিজেই। আর সত্য উদ্ঘাটনের পরই কেবল এই ঢালাও অভিযোগের কেউ কেউ কথা রাখে শিরোনামটি পূর্ণতা পেয়েছে।
গল্পপ্রসঙ্গ
গল্পকথক বর্তমান সময়ের মোটামুটি পরিচিত একজন লেখক। দ্বিধা আর জড়তাকে সঙ্গী করে দুই যুগ আগের পরিচিত এক রমনীর সাথে দেখা করতে গেছেন। গল্পকথকের নাম আমরা জানি না। বই লিখে খানিকটা নাম কামালেও একা থাকতেই পছন্দ করেন। ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রী হলেও স্টেটসে গিয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করে কিছুদিন হলো দেশে ফিরেছে গল্পকথকের দুই যুগ আগের বান্ধবী রামজিয়া শেহরিন। বর্তমানে একটি সংস্থা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটায়। কথাবার্তার মাঝে গল্পকথক একটা পান্ডুলিপি দেয় রামজিয়া শেহরিনকে। গল্পকথকের অপ্রকাশিত একটি বইয়ের পান্ডুলিপি। বইটার শিরোনাম – কেউ কথা রাখেনি। বই হাতে নিয়েই রামজিয়া শেহরিন কয়েকটা পাতা দেখে গল্পকথককে জিজ্ঞাসা করে,
এটা কি… মিলির খুনটা নিয়ে?
দুই যুগ আগের ঘটনা। মিলি আর মিনহাজের বিয়ে হয়েছে সবেমাত্র তিন মাস হবে। মিলি খুবই মিশুক আর চটপটে একটা মেয়ে। মিনহাজ একটি ব্যাংকে চাকরি করে। মিলিকে প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসে এবং মধ্যবিত্ত জীবনেও মিলিকে নিয়ে নানা ধরনের স্বপ্ন দেখে। একদিন অফিস থেকে খুশি মনে বাসায় ফিরে দেখে মিলিকে কে বা কারা ধর্ষণের পর খুন করে রেখে গেছে ঘরে। মিনহাজ পুরোপুরিভাবে ভেঙে পড়ে। ঢাকায় তেমন কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই ওর পাশে থাকবে এই দুঃসময়ে। মিলির খুনের তদন্তের দায়িত্ব পড়ে সিনিয়র সাব-ইন্সপেক্টর এস এম হায়দার এবং তার সহকর্মী গল্পকথক; বর্তমানে যিনি লেখক, তিনিই দুই যুগ আগে পুলিশ ছিলেন, তার ওপর। গল্পকথক মিনহাজের এমন মানসিক অবস্থায় সান্ত্বনা দিয়ে খুনীর ফাঁসি কামনা করে। কিন্তু মিনহাজ এমনটা চায় না। মিনহাজ বলে,
ফাঁসি দিলে তো নিমেষেই সব শেষ; মিলি অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গেছে। তাই ওকে সারাজীবন জেলে পচে মরতে হবে। মৃত্যযন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যাবে আমার মিলির খুনি।
যারা বিয়ে করে সুখী হয় তারা স্ত্রী বিয়োগ হবার পর খুব বেশি দিন একা থাকতে পারে না। আবার বিয়ে করে বসে। কারণ, দ্বৈত জীবনে যে সুখী হওয়া যায় সে অভিজ্ঞতা তার আছে। আর যে মানুষটি বৈবাহিক জীবনে অসুখী, সে স্ত্রী বিয়োগের পর আর ও পথে পা বাড়ায় না। দ্বিতীয়বার অসুখী হবার ঝুঁকি নিতে চায় না সে।
– মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন।
এস এম হায়দার বেশ তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন এবং জাহাঁবাজ ধরনের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা একজন বীর। অন্যায় আর অপরাধ কোনোটাই মুখ বুজে সহ্য করতে পারেন না। মুখে না বোঝাতে পারলে রাগে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করেন না, এমনকি সে যদি থানার ওসি হয় তা-ও না। তবে সহকর্মী গল্পকথকের সাথে তার বেশ ভাব। কখনো বন্ধু সমতুল্য আচরণ করেন, কখনো আবার বড় ভাইসুলভ। তবে অমিলটা ঐ এক জায়গাতেই, আর সেটা হচ্ছে যুদ্ধ পরবর্তী দেশের এমন অবস্থার জন্যে কে দায়ী? গল্পকথকের ভাষায়, নেতা ঠিকই সব গুছিয়ে নেবেন, কিন্তু হায়দার সাহেব এই কথায় বিশ্বাস করেন না। কেননা গাছের আগাছা পরিষ্কার না হলে গাছ পরিপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পাবে না, যতই সময় দেয়া হোক না কেন। খুনের তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর বেশিদিন লাগে না। এস এম হায়দারের চৌকস বুদ্ধিতে খুনী ধরা পড়ে যায়।
খুনী মিলিরই এক দূর সম্পর্কের চাচাত ভাই – ইমতিয়াজ শফিক। বিয়ের আগে মিলির পেছন পেছন ঘুরলেও মিলি তেমন একটা পাত্তা দিত না। খুনটা যে ইমতিয়াজই করেছে তার প্রত্যক্ষদর্শী না পেলেও এস এম হায়দার পাড়ার মুদি দোকানীকে জিজ্ঞেস করে জেনে যায় খুনি খুনের আগের কয়েকদিন এখানেই এসে চা-বিড়ি খেয়ে সময় পার করেছে। এরই মধ্যে খুনি ঢাকা থেকে একদম লাপাত্তা হয়ে যায়। কিন্তু এস এম হায়দার নাছোড়বান্দা। কিছুতেই এই খুনিকে বেশিদিন পালিয়ে থাকতে দেয় না। একদিন ধরে নিয়ে আসে থানায়। সুকৌশলে খুনির মুখ দিয়ে খুনের ঘটনা স্বীকার করিয়ে নেয়। কিন্তু খুনি খুন স্বীকার করার পরেও হাসতে হাসতে তার নেতার কথা বলে, যে তাকে এখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। এস এম হায়দার রাগের বসে ইমতিয়াজকে প্রচন্ড মারধর করে। যেকোনপ উপায়েই হোক না কেন ইমতিয়াজকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েই তবেই শান্ত হবেন, তা-ই জানান সহকর্মী গল্পকথককে। কিন্তু নেতার ক্ষমতাবলে ইমতিয়াজ ছাড়া পেয়ে যায় এবং আবারও লাপাত্তা হয়ে যায়।
জীবনে এরকম অনেক সময় আসে, যখন মানুষ তার স্বভাবের বাইরে গিয়ে কিছু করে ফেলে।
– মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন।
খুনের তদন্তে মিলির এক বান্ধবী রামজিয়া শেহরিনের সাথে বেশ ভালো একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে গল্পকথকের। কিন্তু একদিন রিক্সায় করে যাবার সময় হঠাৎ ইমতিয়াজ এসে পথ আগলে দাঁড়ায় এবং কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে গল্পকথকের উপর চড়াও হয়ে পিস্তল তাক করে ইমতিয়াজ। এই কথা এস এম হায়দার কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না। মুহুর্তেই ইমতিয়াজকে নিয়ে এসে জেলে পুরে দেয়, কিন্তু তা-ও বেশিদিনের জন্যে না। এই ঘটনার কিছুদিন পরই ইমতিয়াজ এস এম হায়দারকেও খুন করে পালিয়ে যায়। রাজ্যের দুঃখ এসে ভর করে গল্পকথকের উপর, কিন্তু সেই দুঃখের ঘা শুকানোর আগেই আরেকটি দুঃখ এসে কাঁপিয়ে দেয় গল্পকথককে। তার নেতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। হঠাৎ করেই সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় গল্পকথকের।
গল্পকথকের অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিটা কি শেষমেশ প্রকাশ হয়েছিল? পান্ডুলিপিটার নাম কি হয়েছিল শেষমেশ – কেউ কথা রাখে নি নাকি কেউ কেউ কথা রাখে? মিলির খুনটা কি অমীমাংসিতই রয়ে গেল? কিংবা এস এম হায়দারের খুনটা? আর মিনহাজের কী হয়েছিল? স্ত্রী শোকে লোকটা আত্মহত্যা করেছিল, নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিল, কিংবা স্বাভাবিক জীবনযাপনেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল? রামজিয়া শেহরিন আর গল্পকথকের প্রেমটা কি তবে শেষ পর্যন্ত পূর্ণতা পায়, নাকি মিলির খুনের মতো এটাও অমীমাংসিতই রয়ে যায়? আর সেই খুনি ইমতিয়াজ শফিক? দুই দুইটা খুন করেও যে লোকটা বুক ফুলিয়ে চলতে পারে সেরকম একটা লোক কি করে একদমই হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যায়? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হলে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন রচিত ২৭০ পৃষ্ঠার বইটি পড়তে হবে।
লেখক প্রসঙ্গ
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এর জন্ম ঢাকায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে চারুকলা ইন্সটিটিউটে এক বছর কাটিয়ে অবশেষে গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিষয়ে মাস্টার্শ সম্পন্ন করেন। লেখালেখির শুরুটা অনুবাদ সাহিত্য দিয়েই। সাড়া জাগানো বেশ কিছু অনুবাদ করে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেন অল্প কয়েকদিনেই। দ্য দা ভিঞ্চি কোড, লস্ট সিম্বল, গডফাদার, দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস, ডিসেপশন পয়েন্ট, দ্য কনফেসর, দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্রাগন ট্যাটু এবং ইনফার্নো সহ বিশ্ব সাহিত্যের একাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় মৌলিক থ্রিলার রচনা শুরু করেন। তার প্রথম মৌলিক থ্রিলার উপন্যাস নেমেসিস বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে, যার ফলস্বরূপ বেগ-বাস্টার্ড সিরিজের পরপর আরো চারটি কন্ট্রাক্ট, নেক্সাস, কনফেশন এবং করাচি নামক মৌলিক থ্রিলার আসে এবং সবকটাই বেশ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে জাল, ১৯৫২ এবং এই বইটি রচনা করেন। এছাড়া, তার লেখা রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেন নি বইটি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে, যার দ্বিতীয় পর্ব রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেন নি একযোগে বাংলাদেশ এবং কলকাতা থেকে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশ পাবে।
বাংলার ইতিহাসে শুধুমাত্র ডালে বেশি লবণ দেয়া আর না দেয়া নিয়ে ঝগড়া করে অনেক পরিবার ভেঙে গেছে। তিন-চারটা খুনও হয়েছে মনে হয়।
– মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন।
থ্রিলারের অনেকগুলা শাখার মধ্যে একটি শাখা হচ্ছে পিরিয়ডিক্যাল থ্রিলার। শুদ্ধভাবে বলতে গেলে হিস্টোরিক্যাল থ্রিলার। হিস্টোরিক্যাল থ্রিলার বলতে বিশাল কলেবরে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কিছু ইতিহাস নিয়ে রচিত গ্রন্থসমূহকেই বোঝায়। আর পিরিওডিক্যাল থ্রিলার একটি নির্দিষ্ট সময় বা যুগের উপর নির্ভর করে। এই ধরনের থ্রিলারে ইতিহাসকে পটভূমি রাখা হলেও বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট থেকে তা বর্ণনা করা হয়। ইতিহাসকে ব্যাকড্রপে রেখে বা কেন্দ্র করে বর্তমানের গল্প এগিয়ে চলে।
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এর কেউ কেউ কথা রাখে বইটিও একটি পিরিয়ডিক্যাল থ্রিলার ঘরানার বই। প্রত্যক্ষভাবে খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন (মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী) সামাজিক অবস্থা, প্রশাসনিক আর অর্থনৈতিক কাঠামো, রাজনৈতিক অস্থিরতা এসব নিয়ে গল্প এগিয়ে গেলেও পুরো উপন্যাসের পরোক্ষভাবে বা মূল চালিকাশক্তিই হচ্ছে প্রেম। যদিও এতে সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে গল্পের সাথে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের অস্থির অবস্থা, নোংরা রাজনীতির উত্থান, সামাজিক বিশৃঙ্খলার সূচনা, আদর্শের পতন, নাগরিক স্বপ্নভঙ্গ ইত্যাদি ব্যাপারগুলো বেশ ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে লেখকের লেখনীতে।
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের যে ব্যাপারটি সবচাইতে বেশি ভালো লাগে তা হচ্ছে তার লেখার ধরন। যদিও সবার লেখার ধরনই আলাদা, কিন্তু তার লেখা একটু বেশিই আলাদা। কেননা তার লেখায় কোনো তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করা যায় না। একদম শান্তিশিষ্টভাবে লেখাগুলো লিখে যান। বলা যায়, অনেকটা পরিকল্পনা নিয়েই লিখতে বসেন তিনি, যেন তার লেখার শান্তশিষ্টতার মতোই পাঠক যেন শান্তশিষ্টভাবেই গল্পে ডুবে যান। বইটি নিয়ে অনেকেরই অভিযোগ আছে অবশ্য, কেননা এটি একটি বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত। তবে, লেখকের সার্থকতা এখানেই যে, তিনি সেই গল্পকেই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অস্থির সময়ে উপস্থাপন করেছেন একদম নিখুঁতভাবে। এর আগে লেখকের বেগ-বাস্টার্ড সিরিজ সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।
কেউ কেউ কথা রাখে একটি নিরীক্ষাধর্মী বই। কেননা এই বইটি লেখা হয়েছে আর্জেন্টাইন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক এদুয়ার্দো সাচেরির লা পেহুন্তা দে সুস ওহোস বইটার ছায়া অবলম্বনে। মূল বইটির অবলম্বনে একটি সিনেমাও আছে, যেটা অস্কারের মুখ দেখেছিল। নাজিম উদ্দিনের এই বইটা ঠিক অনুবাদ, নয় আবার পুরোপুরি মৌলিকও নয়, মাঝামাঝি একটি জায়গায় আছে বলেই লেখক একে নিরীক্ষাধর্মী উপাধি দিয়েছেন। মৌলিক হোক আর অনুবাদ- বইটি পড়ে যেকোনো পাঠক তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে বাধ্য।