পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়ানো প্রাসাদতুল্য প্রকান্ড এক অট্টালিকা। লোকালয় থেকে সুদূরে অবস্থিত এ বাড়ির চারপাশ জুড়ে অজস্র গাছপালায় সমৃদ্ধ বনাঞ্চল। নিষ্প্রাণ এ বাড়ির আশেপাশে ভিড়লেই যেকারো গা ছমছম করে ওঠাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দিনের বেলা সূর্যালোকে বাড়িটিকে অপূর্ব সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ কোনো প্রাচীন স্থাপত্য বলে মনে হলেও, রাতের বেলা চাঁদের আলোয় একে কেমন যেন ক্ষুধার্ত এক দানবের মতো দেখায়।
‘হিল হাউজ’ নামে পরিচিত এ বাড়িটির বহু বছরের পুরাতন স্যাঁতস্যাঁতে শেওলা পড়া পাথরে, আস্তরণ খসে যাওয়া দেয়ালে, মরিচা ধরে যাওয়া সিঁড়ির হাতলে ও ধুলো জমে থাকা আসবাবপত্রে যেন মিশে আছে কোনো এক অজানা করুণ আর্তনাদ। যেকোনো সুস্থ, স্বাভাবিক ও হাসিখুশি মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ ও দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলা এ বাড়ির জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। কোনো এক অতিপ্রাকৃত শক্তি যেন এ বাড়ির বাসিন্দাদের মায়াজালে জড়িয়ে ফেলতে পারতো এক নিমিষে। আর তাই তো, এ বাড়ি আর আট-দশটা সাধারণ বাড়ির মতো না জানা থাকা সত্ত্বেও এর অদৃশ্য বাঁধনে আঁটকা পড়তো অবুঝ বাসিন্দারা। আর এ বাড়ির প্রাচীর ভেঙে বেরিয়ে যেতে পারলে, নিয়তির টানে আবারও ফিরে আসতো বাধ্য হতো। হোক না সেটা অনেক বছর পর। কিন্তু মরণফাঁদ পেতে থাকা এ বাড়ির প্রবেশদ্বার একবার খুলে দেওয়া মানেই হলো, নতুন কোনো জীবনের বলিদান। কখনো কখনো প্রেতাত্মা নিছক একটি ইচ্ছা।
সাম্প্রতিক নিরাশার অপর নাম হলো হরর জনরার চলচ্চিত্র। গত কয়েক বছরে হলিউডে মুক্তিপ্রাপ্ত হরর জনরার সিনেমা নিয়ে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেই যেকোনো সিনেপ্রেমী কথাটা কত শতাংশ সত্য, প্রমাণ পেয়ে যাবার কথা। পুরো দুনিয়াব্যাপী যে হরর জনরার খুব জয়জয়কার চলছে, তাও কিন্তু নয়। তুর্কির হরর জনরার মুভিগুলো বেশ জনপ্রিয় হলেও, সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই ধরনের কাহিনীর বিচরণই সর্বত্র।
১৯৬৮ সালের ‘রোজমেরি’স বেবি’, অথবা ১৯৭৮ সালের ‘হ্যালোউইন’ সিনেমাগুলোর মতো ক্লাসিক হরর জনরার মুভি এ যুগে যেন দুর্লভ। এবছরের ‘দ্য নান’ এর কথাই ধরুন না। হররের ভৌতিকতা থেকে কমেডির হাস্যরস বেশি পাবেন সিনেমাটিতে। অন্যদিকে, হরর জনরার উপর নির্মিত সিরিজের কথা বলতে হলে, প্রথমেই আসবে ‘আমেরিকান হরর স্টোরি’, ‘সুপারন্যাচারাল’, ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ সিরিজগুলোর নাম।
তবে বেশ কয়েক বছর ধরে চলতে থাকা এ সিরিজগুলোর একেক সিজন একেক রকম সাড়া ফেলেছে। কখনো হয়তো দর্শকপ্রিয়তা খানিকটা কমে গেছে, আবার কখনো আগের চেয়েও বেড়ে গেছে। তবুও একঘেয়েমি কাটাতে দর্শক প্রতিনিয়ত নতুনত্বের সন্ধান করে থাকে। আর সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘দ্য হন্টিং অব হিল হাউজ’ যেন এমন এক নতুনত্বের ছোঁয়া নিয়ে এসেছে।
নেটফ্লিক্স অরিজিনালের এ সিরিজটি ১৯৫৯ সালে আমেরিকান লেখিকা শার্লি জ্যাকসনের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে। সুপারন্যাচারাল, হরর ও ড্রামা এই তিন জনরার মিশেলে নির্মিত এ সিরিজটি পরিচালনা করেছেন মাইক ফ্ল্যানাগান। চলচ্চিত্র নিমার্তা ফ্ল্যানাগানের সাথে যারা পরিচিত, তারা জানেন তিনি হরর সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে কেমন পারদর্শী।
২০১১ সালের ‘অ্যাবসেন্টিয়া’, ২০১৩ সালের ‘অকুলাস’, ২০১৬ সালের ‘বিফোর আই অ্যাওয়াক’, ২০১৭ সালের ‘জেরাল্ড’স গেম’ এর মতো সিনেমাগুলোতে পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। আর প্রথমবারের মতো সিরিজের কাজ হাতে নিয়েও সেটাতে করলেন বাজিমাত। দশটি পর্ব নিয়ে গড়ে ওঠা এই সিরিজের প্রথম সিজনের প্রতিটি পর্বের ব্যাপ্তিকাল ৪২-৭১ মিনিটের মধ্যে ছিল। সিরিজটির প্রযোজনায় ‘ফ্ল্যানাগান ফিল্ম’, ‘অ্যাম্বলিন টেলিভিশন’ ও ‘প্যারামাউন্ট টেলিভিশন’ যৌথভাবে নিয়োজিত ছিল। সিরিজটি এ বছরের ১২ অক্টোবর নেটফ্লিক্সের চ্যানেলে রিলিজ পায়।
‘দ্য হন্টিং অব হিল হাউজ’ সিরিজের প্লট গড়ে উঠেছে ক্রেইন পরিবার ও তাদের হিল হাউজে বসবাসকালীন ও পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতার গল্পকে কেন্দ্র করে।
গল্পের শুরুটা হয় ১৯৮২ সালে। সেই বছরের গ্রীষ্মে ক্রেইন দম্পতি অলিভিয়া-হিউ তাদের পাঁচ সন্তান নিয়ে কিছুদিনের জন্য পুরনো এক বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করেন। মূলত ক্রেইন দম্পতির পেশাই ছিল, পুরনো বাড়িগুলো কম দামে কেনার পর, সেগুলোতে গিয়ে ওঠা ও দীর্ঘ সময় ধরে মেরামত করে বাড়িগুলোকে বসবাসযোগ্য করে তোলা। তারপর অনেক দামে বাড়িগুলো বিক্রি করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করা।
আর হিল হাউজ নামের এ নতুন বাড়ি নিয়ে তাদের দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল। কারণ নানা রকম প্রাচীন এবং অভিজাত জিনিসপত্রে পরিপূর্ণ এ বাড়িকে মেরামত করে নতুনের মতো ঝকঝকে করে তোলার পর একে ভালো দামে বিক্রি করতে পারলে তাদের জীবন চিরতরে বদলে যেতে পারতো। এরপর তাদের আর এমন ছন্নছাড়া মানুষের মতো এই জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আস্তানা গড়তে হতো না। পাঁচ ছেলেমেয়েকে নিয়ে একেবারে কোথাও সুখের নীড় বাঁধতে পারতেন তারা। কিন্তু কে জানতো, এ বাড়ি তাদের জন্য কোনো পৈশাচিক অধ্যায় নিয়ে অপেক্ষারত ছিল।
হিল হাউজে পা রাখার পর থেকেই ক্রেইন পরিবার ছোট ছোট অনেক অদ্ভুতড়ে ঘটনার মুখোমুখি হলেও, সেগুলোকে মনের ভুল অথবা কাকতালীয় ব্যাপার-স্যাপার বলে এড়িয়ে যেতে থাকে। প্রথম থেকেই তাদের এ বাড়ির পারিপার্শ্বিক অবস্থা কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছিল। কিন্তু এত বড় বাড়ির খোলামেলা পরিবেশ ও দারুণ দারুণ সব চমক তাদেরকে বাড়িটি সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা করা থেকে দমিয়ে রেখেছিল।
দুঃস্বপ্নের আনাগোনা, দুর্ঘটনার শিকার, অশরীরীর উপস্থিতি, ব্যাখ্যাতীত ঘটনা ইত্যাদি ব্যাপারগুলোর পরিবারের প্রায় প্রত্যেক সদস্যই কোনো না কোনোভাবে সম্মুখীন হলেও, তা তারা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছিল। অনেকটা বাড়িটা তাদেরকে মন ও শরীরকে কব্জা করে ফেলেছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু তারপর? এক কালো রাত তাদের জীবনে হানা দেয়। সেই রাতের সেই মর্মান্তিক ঘটনা তাদের শুধু হিল হাউজ ছাড়তেই নয়, বরং সারা জীবনের জন্য বাড়িটির কালো ছায়া নিজেদের অন্তর- আত্মায় বয়ে বেড়াতে বাধ্য করে।
‘দ্য হন্টিং অব হিল হাউজ’ সিরিজটি মূলত দুটো সময়ের পরিক্রমায় আবর্তিত হয়েছে। প্রথমটি ১৯৮২ সাল, যার কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এর পরেরটি হলো, ২০১৮ সাল। হিল হাউজের সেই ভয়ংকর রাতের ছোবল থেকে বেরিয়ে আসার পর ক্রেইন পরিবারের প্রতিটি সদস্য বর্তমানে কেমন পরিস্থিতিতে আছে, সেটা এ সময়ে চিত্রায়িত হয়েছে। তবে দুটো সময়ের মধ্যে একটি দারুণ অন্তর্মিল রয়েছে। ক্রেইন পরিবার অতীত ও বর্তমান উভয়কালেই পরিবারের একজন করে সদস্যকে হারায়। হিল হাউজ কেড়ে নেয় তাদের পরিবারের দুজনকে। কীভাবে ও কাদের, সেটা রহস্যই থাক।
সিরিজটির সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, এ সিরিজটির গল্প প্রতিটি চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে হিল হাউজ সম্পর্কিত অতীতের অভিজ্ঞতার ফ্ল্যাশব্যাককে পরিকেন্দ্রে রেখে সাজানো হয়েছে। অতীত ও বর্তমানকে সমান্তরালভাবে দেখানোর ফলে দর্শকদের সামগ্রিক সময় ধরে সিরিজে মনোযোগ ধরে রাখাটা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তাছাড়া সিরিজের চিত্রনাট্যে এমন কারিশমা দেখানো হয়েছে যাতে প্রতিটি পর্বে নতুন নতুন সত্য উদঘাটনের মধ্য দিয়ে গল্প সামনের দিকে অগ্রসর হবে। সিরিজটির একেকটি পর্ব আপনাকে একেকটি ছোটখাট হরর সিনেমার স্বাদ দেবে।
তবে সিরিজটির গল্প কিন্তু গতানুগতিক যেকোনো হরর সিনেমা অথবা সিরিজ থেকে কিছুটা ভিন্নধারার গল্পের উপর রচিত হয়েছে। কারণ এ সিরিজে শুধু যে অতিপ্রাকৃতিক শক্তিকে দেখানো হয়েছে তা কিন্তু নয়। এর পাশাপাশি আরও একটি শক্তির প্রভাবকেও তুলে ধরা হয়েছে। আর তা হলো, ভালোবাসার নির্মল শক্তি। ক্রেইন পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের সাথে যে কতটা মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ছিল, সেটা সিরিজ যত সামনে এগোবে ততই দর্শকদের চোখে ধরা পড়বে। প্রথমদিকে পরিবারটিকে অনেকটা খাপছাড়া মনে হলেও, ক্রমান্বয়ে তাদের সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ পাবে।
সিরিজটি সম্পর্কে আরও সূক্ষ্মভাবে জানতে সিরিজের চরিত্রগুলো নিয়ে একটু বিশদভাবে আলোচনা হয়ে যাক।
স্টিভেন ক্রেইন
হিউ ও অলিভিয়ার বড় ছেলে স্টিভেন। প্রথম পর্বটি তার অতীত ও বর্তমানের দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘স্টিভেন সিস আ ঘোস্ট’ নামের সেই পর্বে বাল্যকালের স্টিভেন ও প্রাপ্তবয়স্ক স্টিভেন উভয়ের হিল হাউজ নিয়ে চিন্তাধারা স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে দর্শক। বাল্যকালের স্টিভেন বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে ওইটুকু বয়সেই ছিল দায়িত্ববান ও স্নেহপরায়ণ।
অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্ক স্টিভেন ঠিক তার উল্টো। পরিবারের প্রতি বেশ উদাসীন ও বাস্তববাদী স্টিভেন নিজের জীবনকে স্থিতিশীল রাখতেই ব্যস্ত ছিল। ভূত-প্রেতে নিজে বিশ্বাস না করলেও, ছোটকালের হিল হাউজের অভিজ্ঞতা ও ঘটনাগুলোকে বেচে সে নিজের পকেটে অর্থ ঢোকানোর ধান্দায় নেমেছিল। স্বার্থপরতা ও অবিশ্বাস স্টিভেনের চরিত্রে প্রকটভাবে ধরা পড়ে। তবে তার অতীতের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করার পর দর্শক বুঝতে পারবেন, তার এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পেছনের আসল কারণ।
শার্লি ক্রেইন
ক্রেইন পরিবারের বড় মেয়ে। ছোটকাল থেকেই সব ব্যাপারে অতিরিক্ত রক্ষণশীল ও আবেগপ্রবণ ছিল সে। বর্তমানে হিল হাউজের দুঃসহ স্মৃতিকে মনের ভেতর চাপা দিয়ে বেশ সুখেই ঘর-সংসার সামলাচ্ছিল। কিন্তু হিল হাউজে থাকাকালীন শখের একটি জিনিস হারিয়ে ফেলার পর থেকেই সে মানসিকভাবে কিছুটা জেদি হয়ে উঠে। সবকিছুকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় শার্লির মধ্যে। আর তাই নিজের জীবনের পাশাপাশি ভাই-বোনদের জীবনেও হস্তক্ষেপ করতে থাকে সে। সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব ‘ওপেন ক্যাসকেট’ শার্লির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মেলে ধরা হয়েছে।
থিওডোরা ক্রেইন
পরিবারের মেজো মেয়ে থিও বাকিদের থেকে কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক ও বয়সের তুলনায় পরিপক্ক ছিল ছোটবেলা থেকেই। থিওর এমনটা হবার পেছনে মূলত দুটো কারণ ছিল। একে তো নিজের সমকামী সত্ত্বা, তার উপর বিধাতা প্রদত্ত বিশেষ এক ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল সে। নিজের এই অতিমানবীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে অনেক লোকের উপকার করতে সক্ষম হলেও, এ ক্ষমতা তার নিজের জীবনকে অনেকটাই দুর্বিষহ করে তুলেছিল। পরিবারের প্রতি থিওর ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। তবে সে সেটা বহিঃপ্রকাশে আনাড়ি ছিল। ‘টাচ’ নামের তৃতীয় পর্বে থিওর হিল হাউজে বসবাসকালীন নানা রকম স্মৃতিবহুল ঘটনা ও বর্তমানের দৃশ্যপট অংকন করা হয়েছে।
লুক ক্রেইন: ক্রেইন পরিবারের ছোট ছেলে লুক ছোটকালে কিছুটা চুপচাপ ও হাবাগোবা প্রকৃতির ছিল। জমজ বোন নেল ছিল তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছোটবেলায় হিল হাউজে কাল্পনিক এক বন্ধুর গল্প বানিয়ে বলার ফলে পরিবারের বাকিরা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ভাবতো। কেউ সহজে তার কথাকে পাত্তা না দেওয়াতে ধীরে ধীরে লুকের নিজেকে অনাদর ও অবহেলা শিকার বলে মনে করতে থাকে। কষ্টে জর্জরিত বাল্যকাল কাটানোর পরও সে নিজেকে সামলে নিতে পারে না। আর তাই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে ও পরিবার থেকে দূরে রিহ্যাবে দিন কাটাতে থাকে। ‘দ্য টুইন থিং’ নামের চতুর্থ পর্বে লুক ও নেলের মধ্যেকার ঈশ্বর প্রদত্ত টান দেখানোর মধ্য দিয়ে লুক চরিত্রটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
নেল ক্রেইন: ক্রেইন পরিবারের আদরের দুলালী ছিল নেল। ছোটকাল থেকে বাবা-মা থেকে শুরু করে সব ভাই-বোনেরা তাকে সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে আসছিল। কিন্তু ছোটকাল থেকে প্রতিনিয়ত দেখা একটা দুঃস্বপ্নের কারণে সে কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। পরবর্তী জীবনে সে ঘুমের মধ্যে সাময়িক সময়ের জন্য প্যারালাইজড হয়ে যেতে শুরু করে। এরপর প্রিয় মানুষটিকে অকালে হারিয়ে ফেলার পর তার নিজের জীবনের প্রতি মায়া কমে যায়। আর শেষের দিকে, পরিবারের কাছ থেকে একটু অবহেলাও পায় সে। ক্রেইন পরিবারের আদর্শ মেয়ে ও বোন নেলের শেষ পরিণতি দর্শকদের মানতে ভালোই কষ্ট হবে। পঞ্চম পর্ব ‘দ্য বেন্ট-নেক লেডি’তে নেল চরিত্রটিকে চিত্রিত হয়েছে।
হিউ ক্রেইন: পরিবারের কর্তা হিউ আর আট-দশজন স্বামীর মতোই নিজের স্ত্রীকে মনে-প্রাণে ভালবাসতেন ও সন্তানদের নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে গণ্য করতেন। অতীত ও বর্তমান উভয়েই তিনি সন্তানদের নিরাপদে রাখতে অনেক বড় বড় বলিদান করেছেন। কিন্তু তার সন্তানেরা তার সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা পোষণ করার কারণে তিনি চাইলেও সন্তানদের কাছাকাছি থাকতে পারেননি। হিল হাউজের প্রকৃত সত্য তিনি পুরোপুরি জানলেও কোনো এক অজানা কারণে সেটা কাউকে কখনোই খুলে বলেননি। পর্ব ছয় থেকে নয় পর্যন্ত তার চরিত্রের বিকাশ একটু একটু করে হবার পর, শেষ পর্বে গিয়ে সত্যের উপর থেকে পর্দা ওঠার মধ্য দিয়ে তার আসল রূপ দেখতে পাওয়া যায়। তার প্রতি ভালোই করুণা জাগবে দর্শকদের মনে।
অলিভিয়া ক্রেইন: অলিভিয়া ক্রেইন সিরিজের সবথেকে রহস্যময়ী চরিত্র। সিরিজের প্রথম থেকে সন্তানদের ফ্ল্যাশব্যাকে তাদের মায়ের স্মৃতি ভেসে আসার মাধ্যমে তাকে দেখা যায়। কিন্তু শেষ পাঁচটি পর্বেই মূলত তার ‘কোমলমতী মা’ আবরণের আড়ালে লুকায়িত সত্ত্বাটি বেরিয়ে আসে। অলিভিয়া মা ও স্ত্রী হিসেবে যে একদম সর্বগুণে গুণান্বিত ছিলেন তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু হিল হাউজ অলিভিয়ার আপন সত্ত্বাকে দুমড়ে মুচড়ে তাকে নিজের দাসীতে পরিণত করে। যার ফলাফল হিসেবে অলিভিয়াকে তো মাশুল দিতেই হয়েছিল, এছাড়া তার পরিবারও আজীবনের জন্য হিল হাউজের নৃশংসতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল।
সিরিজটির প্রতি পর্বের বিশ্লেষণধর্মী বর্ণনা তুলে ধরা হলে মজা নষ্ট হয়ে যেতে পারে ভেবে সেদিকে আর যাচ্ছি না৷ তবে কয়েকটা কথা না বললেই নয়। ‘দ্য হন্টিং অব হিল হাউজ’ হয়তো অনেকের কাছেই প্রথমদিকে কিছুটা দুর্বোধ্য ও ধীরগতিসম্পন্ন গল্পের সিরিজ মনে হতে পারে। তবে গল্প যত এগোবে, ততই জমজমাট রূপ নেবে, এটা মাথায় রেখে দেখে যেতে পারলে, দুর্দান্ত কিছু দেখতে পাবেন। সিরিজের গল্প যে শুধু যে আধ্যাত্মিক শক্তিকে মূল উপাদান হিসেবে রেখে সাজানো হয়েছে, তা কিন্তু নয়। মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, মানসিক আঘাত, নির্মম কোনো ঘটনা থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা একজন মানুষকে অথবা একটি পরিবারকে কীভাবে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়, তারও দৃশ্যায়ন করা হয়েছে।
সিরিজের যে দিকগুলো একজন হররপ্রেমীকে তৃপ্ত করতে পারবে, এবার সেগুলোর কথা বলা যাক। সিরিজে ক্যামেরা কাজ ছিল একদম নিখুঁত ও জীবন্ত৷ এতটাই দৃষ্টিনন্দন গা ছমছমে এক আবহ তৈরি করা হয়েছে যে, দর্শক খানিক সময়ের জন্য নিজেকেই হিল হাউজে আবিষ্কার করতে বাধ্য হবেন। বিশেষ করে, শেষের পাঁচ পর্বের ভৌতিক পরিবেশ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও রোমহর্ষক দৃশ্যগুলো আলাদা এক ভাবের উদয় করে। দর্শক খুব সহজেই সিরিজের আলো-আঁধারের লুকোচুরি খেলায় মত্ত হয়ে যাবেন। আর অভিনয়শিল্পীদের প্রত্যেকেই ছিলেন নিজ নিজ চরিত্রে অমায়িক ও সাবলীল। এমনকি শিশু শিল্পীদের অভিনয় দেখেও আপনি বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইবেন। ঘটনাপ্রবাহ ও সংলাপ এককথায় অসাধারণ। কিছু কিছু সংলাপের অন্তরালের মর্মকথা দর্শক হৃদয়কে স্পর্শ করে যাবার মতো। রটেন টমেটোসে ৫৯টি ভোটের ভিত্তিতে ৮২% ও মেটাক্রিটিকে ১৫টি ভোটের ভিত্তিতে ৮১% রেটিং লাভ করেছে সিরিজটি। স্টিফেন কিং এর মতো হরর জনরায় রাজত্ব করা লেখকের কাছ থেকেও ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে সিরিজটি।