স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে ২০২১ সালের বিজ্ঞান বিষয়ক সেরা ১০ বই

গত বছরও করোনাই ছিল সংবাদের মূল শিরোনামে, সিংহভাগ জুড়ে। তাই, বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলোতেও ছিল এই মহামারীরই কথা। তা সত্ত্বেও, বিজ্ঞানের জগতে নিত্যনতুন আবিষ্কারের কথাও শুনতে পেয়েছি আমরা। নাসা মঙ্গলের বুকে আরেকটি রোভার নামাতে সক্ষম হয়েছে, নতুন ধরনের এক আদি মানব প্রজাতির সন্ধানে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে একদল বিজ্ঞানী, আর বিজ্ঞানীরা এটাও খুঁজে বের করতে পেরেছেন যে, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই প্রাণী জগতের বিবর্তনও প্রভাবিত হয়ে থাকে। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, সবগুলো টপিকই বই আকারে লিপিবদ্ধ হবার সম্ভাবনা জেগে ওঠায় বিজ্ঞান বিষয়ক বইপ্রেমীদের জন্য এটা সুখবর। তাই, প্রতিবছরের মতো এবারও স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন বছরের সেরা ১০ বিজ্ঞানের বইয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। 

আন্ডার এ হোয়াইট স্কাই: দ্য নেচার অফ ফিউচার – এলিজাবেথ কোলবার্ট 

নতুন রূপে আমরা যে বিশ্ব সাজাচ্ছি সেটাই খুব সূক্ষ্ম আর সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে এলিজাবেথ কোলবার্ট। আর সেজন্যই সে এমন সব জীববিজ্ঞানীদের সাথে কথা বলেছেন যারা বিশ্বের বিরল আর বিলুপ্তপ্রায় মাছ ও মাছের প্রজাতি সংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মোজাভের মাঝে একটি ক্ষুদ্র পুলে এমন সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে। আইসল্যান্ডের ইঞ্জিনিয়াররা কার্বন নিগর্মনকে পাথরে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার, অস্ট্রেলিয়ান গবেষকরা এমন একটি কোরাল বানাতে চাচ্ছেন যেটি উষ্ণতার মধ্যেও টিকে থাকতে পারে। এরকমই অসংখ্য তত্ত্ব ও তথ্যে পূর্ণে কোলবার্টের বইটি। যা নিঃসন্দেহে একজন বিজ্ঞান প্রেমীর জন্য অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুখাদ্য। 

Image Source: amazon.com

দ্য প্রিমোনেশন: অ্যা প্যানডেমিক স্টোরি – মাইকেল লুইস 

বইটি মূলত বেশ কিছু সরকারি কর্মচারী এবং বিজ্ঞানীদের কেন্দ্র করে লেখা; যারা কোভিড-১৯ আসতে দেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রে এবং এর বিস্তার রোধে তারা তাদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারে করে কী কী করেছিল তাই নিয়েই মূলত। একটা ফিকশনে যেমন ভালো আর মন্দ থাকে ঠিক তেমনই বাস্তব জীবনটাও। সেই ভালো-মন্দের ফারাক আর দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন মাইকেল লুইস। এই যে করোনার পূর্বপ্রস্তুতি এটা নিয়েও কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ছিল অযথা অনীহা, এবং এমনকি কাজে বাধা দেয়ার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা। শুধু তা-ই নয়, বরং উন্নয়নটা যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে থাকে সেই বিষয়টাতেও ছিল লুইসের দৃষ্টি। প্রথম খণ্ডে, লুইস কেবল নায়কদের বিবরণ দিয়েছে। আর দ্বিতীয় খণ্ডে, ভাইরাসের সঙ্গে রাজনীতি আর বাদবাকি সবকিছু মিলে গিয়ে কী একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে। 

Image Source: amazon.com

ফাইন্ডিং দ্য মাদার ট্রি: ডিসকাভারিং দ্য উইজডম অফ ফরেস্ট – সুজানে সিমার্দ 

বনাঞ্চল উজাড় করার কারণে প্রতিনিয়তই হুমকির মুখে পড়ছে মানব সভ্যতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও কি থেমেছে প্রকৃতির প্রতি এই অরাজকতা? নাহ! তাই, সুজানে এই বইতে আলোচনা করেছে বনাঞ্চল রক্ষায় সরকারের কী কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত আর কোনটা উচিত নয়! বনজঙ্গলে উদ্ভিদের প্রজাতির বিস্তারেও মাদার ট্রি বলতে একটা ব্যাপার আছে। তাই, এই ব্যাপার নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেছেন সুজানে। যেন মাদার ট্রি রক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রকৃতি ভরে উঠে সবুজে। সুজানে তার এই বৈজ্ঞানিক যাত্রায় তার নিজস্ব অভিজ্ঞতাও খুব সুচারুরূপে বর্ণনা করেছেন পাঠকদের উদ্দেশ্যে। এমনকি নিজের বিবাহবিচ্ছেদ এবং স্তন ক্যানসারের কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। এই সবকিছুর উর্ধ্বে সুজানে পাঠককে এই বিষয়েই সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন যে, বনের জীবনচক্র কী এবং সেটা বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের কী কী করা উচিত! 

Image Source: amazon.com

দ্য জয় অফ সোয়েট: দ্য স্ট্রেঞ্জ সায়েন্স অফ পারস্পারেশন – সারাহ ইভার্ট 

প্রতিনিয়ত কম-বেশি সবাই আমরা ঘামি। নিঃসন্দেহে এটা একটা স্বাভাবিক এবং ভালো ব্যাপার। কেননা, ঘাম আমাদের স্তন্যপায়ী দেহকে গরম থেকে রক্ষা করে; যদিও এজন্য আমাদের শরীরের লবণ অনেকখানিই হ্রাস পায় তবুও। এই বইয়ে বিজ্ঞান বিষয়ক সাংবাদিক সারাহ ইভার্ট শারীরিক প্রবাহের এক অদ্ভুত আর বিস্ময়কর ব্যাপার বর্ণনা করেছেন যা দেহকে ঠাণ্ডা রাখতে এবং নিজের দেহকে আরো গভীরভাবে জানতে সাহায্য করবে। প্রতিটি মানুষেরই কমপক্ষে দুই থেকে পাঁচ মিলিয়ন ঘাম নির্গমনের লোমকূপ রয়েছে, যা আদতে শরীরের অন্তর্নিমিত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের একটি অংশ। এই বইয়ে এমনকি ঘামের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসও উঠে এসেছে- অন্যান্য প্রাণীরা কীভাবে নিজেদের দেহ শীতল রাখে; দুর্গন্ধ দূর করতে কী করে সুগন্ধীর আবিষ্কারসহ আরো নানা ইতিহাস। ঘাম শুধুমাত্রই একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি আমাদের অসুস্থ হওয়ার ইঙ্গিতও বহন করে।  

Image Source: amazon.com

দ্য গড ইকুয়েশন: দ্য কোয়েস্ট ফর অ্যা থিওরি অফ এভ্রিথিং – মিচিও কাকু 

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী মিচিও কাকু তার জীবনের পুরো মিশন সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন এই বইয়ে, যার নাম দিয়েছেন ‘অ্যা থিওরি ফর এভ্রিথিং।’ তার মূল এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য এটাই যে, তিনি এমন একটা সমীকরণ লিখতে বা দেখাতে চেয়েছেন, যেটা সমগ্র পদার্থবিদ্যাকে অন্তর্ভূক্ত করবে এবং বিগ ব্যাং থেকে মহাবিশ্বের শেষ অবধি সম্পূর্ণটা ব্যাখ্যা করতে পারবে। এমন ভাবনা আইজ্যাক নিউটনের ভাবনায়ও এসেছিল, স্তম্ভিত করে দিয়েছিল আলবার্ট আইনস্টাইনকেও; এমন একটি তত্ত্ব যেখানে মহাবিশ্বের সমস্ত ক্রিয়াকলাপের সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলোও অনায়াসেই বুঝতে পারবে যে কেউ। এমন কথাবার্তা যদি খানিকটা ভারী আর দুর্বোধ্য মনে হয়, তাই কাকু পাঠকদের নিজের সাথে বিজ্ঞানের পরিভ্রমণে নিয়ে যান এই বইতে, নিজস্ব বলার ঢঙে এবং সহজ ও সাবলীলতাকে সঙ্গী করে। 

Image Source: amazon.com

ফাজ: হোয়েন নেচার ব্রেকস দ্য ল – ম্যারি রোচ 

রোচ তার এই বইতে সুন্দর করে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন একজন ওয়াইল্ডলাইফ বায়োলজিস্ট কী করে একটি পাহাড়ি সিংহকে ট্র্যাক করে। শুধু কি তা-ই? ম্যারি রোচ ছুটে গেছেন কলারাডোতে, সেখানে তিনি চেষ্টা করেছেন উচ্ছিষ্ট খাবারদাবার ফেলে বাড়িঘরে ভাল্লুকের আক্রমণ বন্ধ করা যায় কিনা; ইন্ডিয়াতে কেন হাতি গ্রামবাসীদের হত্যা করে তা জানতে এসেছিলেন তিনি; আবার ফিরে গেছেন কানাডায়, কী করে গাছ পড়ে পাহাড় আরোহীরা মারা যায় তা দেখতে। রোচ তার স্বভাবগত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রতিটি বিষয়ই বিচার বিবেচনা করে বর্ণনা দিয়েছেন বইতে। পাশাপাশি সহজ ভাষায় পাঠককে বোঝাতে বেশ কিছু উদাহরণও তুলে ধরেছেন। প্রতি বছর ইন্ডিয়াতেই কেবল ৪০ হাজার মানুষ মারা যায় সাপের ছোবলে। আবার প্রজনন ঋতুতে, মিডওয়ে অ্যাটলে ২০০ জন পুরুষ দৈনিক ৬-৭ ঘণ্টা না হলেও ৮০ হাজার অ্যালবার্ট্রসকে হত্যা করে; যেখানে কর্তৃপক্ষ বিমানের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে নির্মাণ করেছে। 

Image Source: amazon.com

দ্য ডিসঅর্ডারড কসমস: অ্যা জার্নি ইনটু ডার্ক ম্যাটার, স্পেসটাইম এণ্ড ড্রিমস ডিফার্ড – চান্দা-প্রেসকড উইনস্টেন 

বইটির শুরুই হয়েছে মানব অস্তিত্বের উৎস সম্পর্কে একটি গল্প দিয়ে, যেখানে আমরা একই সাথে জ্ঞানের রক্ষক ও অনুসন্ধানকারী হিসেবে আবিষ্কার করি। উইনস্টেন পাঠককে নতুন করে আকাশের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়; যেটাকে মহাকাশের কাঠামো হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং মহাজাগতিক আবিষ্কার সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়। তিনি পাঠককে নিয়ে যান বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক ছাড়াও সামাজিক কী দায়িত্ব রয়েছে তা আলোকপাত করে। উইনস্টেন বলেন যে পদার্থ এর চারপাশের স্থান-কালকে আকার দেয়; ঠিক যেমন একজন পদার্থবিজ্ঞানী সমাজের ভবিষ্যতের রূপ নির্ধারণ করে। আর বইয়ে উইনস্টেন এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, বিজ্ঞান কেবল শূন্য থেকে আবিষ্কার হওয়া কিছু না; বরং এটি মানব প্রজাতির একটি অভ্যাসের মতোই। আর রাতের আকাশে চেয়ে থাকা সম্ভবত মানুষের প্রথম এবং সবচাইতে প্রাচীন আদিম সহজাত প্রবৃত্তি। 

Image Source: amazon.com

ডিপ টাইম: অ্যা জার্নি থ্রু ৪.৫ বিলিয়ন ইয়ারস অফ আওয়ার প্ল্যানেট – রাইলি ব্ল্যাক 

মহাবিশ্বের গঠনের পর থেকে শুরু করে সময়ের প্রসারিত ধারণা করা খুবই কঠিন একটা কাজ। তবে এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো বাছাই করতে সাহায্য করে। গ্রেট বিট্রেনের সাথে মহাদেশীয় ইউরোপের সংযুক্তস্থল ডগারল্যান্ডে ডাইনোসরের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস বয়ান করে। আর তার পেছনের ইতিহাসও সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করে। তবে এই বইটি শুধুমাত্র জীবাশ্ম আর ডাইনোসরের সঙ্গেই জড়িত নয়; বরং এটি জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্ব এবং জীববিদ্যার মূল ধারণাগুলোও ক্রমানুসারে অন্তর্ভূক্ত করে। বইটিতে সর্বমোট ৫০টিরও অধিক তথ্যপূর্ণ এন্ট্রি রয়েছে। যা পাঠকদের বোঝায় যে কিভাবে বিজ্ঞানীরা আমাদের গ্রহের বিবর্তনের মূল মাইলফলক স্পর্শ করেছেন। 

Image Source: amazon.com

লাইফ’স এজ: দ্য সার্চ ফর হোয়াট ইট মিনস টু বি এলাইভ – কার্ল জিমার 

আচ্ছা, রক্তকোষ কি জীবন্ত? অথবা ভাইরাসের কথা যদি বলি? অথবা একটা নিষিক্ত ডিম? এমনকি মৃত্যুর ধারণাও এক রকমের অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একটা টার্ডিগ্রেড, যেটা এক ইঞ্চির পনের ভাগের বেশি না, সেটাও শুকিয়ে হিমায়িত করা যায়। কিন্তু জল আর উষ্ণতা দিয়ে সেটাকে কয়েক বছর বা কয়েক দশক পরেও জীবিত করে তোলা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের গ্রহে জীবের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। প্রাচীনতম ফসিলের উপর ভিত্তি করে করা এমন অনুমানটি কীভাবে ঘটেছিল তা কি কেউ জানে? কার্ল জিমার এমনই অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর নিয়ে হাজির হয়েছেন তার এই বইটিতে। 

Image Source: amazon.com

বিলাভড বিস্ট: ফাইটিং ফর লাইফ ইন অ্যান এইজ অফ এক্সটিংশন – মিশেল নিহুই 

Image Source: amazon.com

১৯ শতকের শেষের দিক থেকে সংরক্ষণ আন্দোলনের ইতিহাসের উপর দৃষ্টিপাত করেছেন মিশেল নিহুই। এই বইতে পাঠক জানতে পারবে উইলিয়াম টেম্পল হর্নডে সম্পর্কে, যিনি ১৮৮৬ সালে ডিসি ডায়ারামার জন্য বেশ কয়েকটি বিরল বাইসন হত্যা করে। এই ঘটনা প্রজাতিগুলোকে বাঁচানোর প্রক্রিয়া শুরুরও আগে। এরপর রোজালি এজের গল্প আছে। যিনি ১৯২০ এবং ৩০ এর দশকে র‍্যাপ্টরদের জন্য সমর্থন গড়ে তুলেছিলেন আর হক মাউন্টেন কিনে নিয়েছিলেন, যেটা পেনসিলভনিয়ার পাখি গণনার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এমনকি এখনো হাজারেরও বেশি প্রজাতি বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। এবং গত দুই দশকে ১৮০০-রও বেশি সংরক্ষণবাদী প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমন সব আলোচনাই লিপিবদ্ধ হয়েছে বইটিতে। 

 

 

This article is in Bangla Language. This is a Top 10 Science books list of 2021 from the renowned Smithsonian Magazine. 

Necessary references have been hyperlinked inside the article. 

Feature Image: Illustration by Valerie Ruland-Schwartz/smithsonianmag.com. 

Related Articles

Exit mobile version