খুব বেশি না, আজ থেকে মাত্র এক বছর আগের এই সময়ের দিকেও যদি ফিরে তাকানো হয়, তাহলে দেখা যাবে ‘মহামারী’ শব্দটা আমাদের কারও চিন্তার কোনো অংশ জুড়েই ছিল না। তখন চিন্তায় ছিল পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, পেশাগত সমৃদ্ধি, ব্যবসায়িক উন্নতি, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ক্ষমতার দ্বন্দ্বসহ কত কিছু! অথচ দেখুন, নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, মাত্র এক বছরের মাথায় বিশ্বের সাড়ে সাতশো কোটিরও অধিক মানুষের সবারই চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘মহামারী’ শব্দটি। এমন এক লড়াইয়ে লিপ্ত আজ গোটা মানবজাতি, যে লড়াইয়ে তাদের নামতে হতে পারে, তা কারও দুঃস্বপ্নেও বোধহয় স্থান পায়নি।
অথচ আজ ঠিকই আমরা এক মহামারীর সময় অতিক্রম করছি। এখনও বিশ্বাস হতে চায় না, কিন্তু তারপরেও এটাই সত্য। শিক্ষা, কর্মজীবন, ভবিষ্যত পরিকল্পনা- সবদিকেই কেমন যেন এক অদ্ভুত স্থবিরতা। যে সিদ্ধান্ত একসময় চোখ বন্ধ করেই নেয়া যেত, আজ সেই সাধারণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেও মানুষ কয়েকবার ভেবে নিচ্ছে, সামনে রেখে নিচ্ছে ‘নভেল করোনাভাইরাস’ নামে খালি চোখে দেখা যায় না এমন এক প্রতিপক্ষের সর্বগ্রাসী প্রতিচ্ছবি।
একসময় যখন ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন বই কিংবা জার্নালে মহামারীর কথা পড়তাম, তখন মনে হতো, “ধূর, আমাদের সময় আর এসব আসবে না। আমরা এখন সবদিক দিয়ে অনেক উন্নত।” অথচ ভাগ্যের লিখন এতটাই অদ্ভুত যে, এই মহামারীর ভেতরে বসেই লিখছি ‘মহামারী ইতিহাস’ নামে অত্যন্ত চমৎকার এক বইয়ের রিভিউ!
কী আছে বইটিতে? সেটা জিজ্ঞেস না করে যদি জিজ্ঞেস করা হয় “কী নেই বইটিতে?”, তাহলেই সম্ভবত তা বেশি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন হবে।
মহামারীর বিষয়টি আসলে সবার আগে মাথায় আসে ডাক্তারদের কথা, যাদেরকে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিতে হয় এই যুদ্ধে জয়ের লক্ষ্যে। পাশাপাশি চলে আসবে সেই মহামারী প্রতিরোধে ভ্যাকসিন ও ওষুধ প্রস্তুতিতে নিরলস পরিশ্রম করে যাওয়া গবেষকদের কথাও। কিন্তু সমস্যা হলো, এই গবেষকদের সংগ্রামের কথা, তাদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে প্রাপ্ত নানা তথ্য-উপাত্তের কথা যেসব গবেষণাপত্রে স্থান পায়, সেগুলোর মূলভাব বুঝে ওঠা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। এটা যে শুধু চলমান করোনাভাইরাস মহামারীর বেলায় খাটে তা না, বরং অতীতের অন্য সকল মহামারীর জন্যই সত্য। তাই সাধারণ মানুষকে সেসব মহামারীর ব্যাপকতা বোঝানো, চিকিৎসক-গবেষকদের পরিশ্রম ও অবদানের সার্বিক মাত্রা বোঝানোর জন্য এমন একটি মাধ্যম দরকার, যা সেসব গবেষণার কথা এমন সহজবোধ্য উপায়ে তুলে ধরবে, যেন পড়ে মনে হয় তিনি কোনো গবেষণাপত্রের নির্যাস পড়ছেন না, বরং পত্রিকায় প্রতিদিন যে ধরনের খবর তিনি পড়তে পছন্দ করেন, তেমন সহজ ভাষাতেই সেটা তুলে ধরা হয়েছে।
এদিক থেকে জনপ্রিয় ইতিহাস বিষয়ক লেখক ড. মো: আদনান আরিফ সালিমকে পুরোপুরি সফল বলা চলে, পেশাগত জীবনে যিনি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এমনভাবে পুরো বই জুড়ে মানবজাতির ইতিহাসে আগত সকল মহামারীর আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন যে, সেটাকে কোনো সাধারণ বই বলে মনে হবার অবকাশ নেই, বরঞ্চ মনে হয়েছে বইয়ে উল্লেখিত প্রতিটি মানুষ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে, আমাদের সামনেই তারা মহামারীর হাত থেকে বাঁচবার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে; তারপরও উঠে দাঁড়াচ্ছে, চালাচ্ছে গবেষণা সেই অদৃশ্য শত্রুকে পরাস্ত করতে।
কিন্তু কেন বিশেষত এই বইয়ের লেখককেই সফল বলা হচ্ছে? কারণ বিভিন্ন গবেষণাপত্র ঘেঁটে এবং বিভিন্ন বিজ্ঞাননির্ভর আলোচনা থেকে তিনি ইতিহাসের গল্প এমনভাবেই সকলের জন্য বের করে এনেছেন যে, তাতে শুরু ও শেষের অধ্যায় দুটো বাদে মহামারীর মূল ইতিহাস উঠে আসা বইয়ের আটটি অধ্যায়কে নিছক বর্ণনা মনে হবে না কোনোভাবেই, বরং মনে হবে আটটি জীবনঘনিষ্ঠ গল্প!
যেকোনো কাহিনী শুরুর আগে একটা ভিত্তি গড়ে নিতে হয়। মহামারীর ইতিহাস বইয়ের প্রথম অধ্যায়টি করেছে ঠিক সেই কাজটিই। মানবজাতির ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে আজ অবধি মহামারীর নানাবিধ প্রভাব, সেই সময়গুলোতে গৃহীত নানা পদক্ষেপ, জনগণের সীমাহীন দুর্দশার কথা সংক্ষিপ্ত কিন্তু আকর্ষণীয় ভাষায় উঠে এসেছে এই অধ্যায়ে।
এরপরই শুরু হয়েছে বইটির মূল আকর্ষণ, যার শুরুটা ব্ল্যাক ডেথের হাত ধরেই। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে একে একে এসেছে গুটিবসন্ত, ম্যালেরিয়া, কলেরা, যক্ষ্মা, স্প্যানিশ ফ্লুসহ বর্তমানের করোনাভাইরাসের কথাও। সবগুলো মহামারীর বেলাতেই কিছু ঘটনা যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একই চক্রে ঘটে চলেছে। শুরুতে পাত্তা না দেয়া, এরপর মৃত্যুর হিড়িক পড়লে পাত্তা দিয়েও সামলাতে না পারা, কিছুটা সামলাতে সক্ষম হলে গা-ছাড়া ভাব দেখাতে শুরু করা যার ফলশ্রুতিতে আবারও সেই মহামারীর জেঁকে বসা (অর্থাৎ আজকের দিনে আমরা যেটাকে বলছি সেকেন্ড ওয়েভ)- এসব নতুন কোনো কথা না। বরং সব মহামারীর বেলাতেই দেখা গিয়েছে। সেই সাথে মহামারীকে কেন্দ্র করে রাজনীতি হয়েছে, কুসংস্কারের পসরা সাজিয়ে বসেছে সুযোগসন্ধানীরা, ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে নীতিনির্ধারকেরা, পাল্টে গেছে মানুষের জীবনযাত্রার ধরন।
উপরের অনুচ্ছেদের কথাগুলো পড়ে আপনি কি বর্তমানের সাথে মেলাতে পারছেন? আসলে এই করোনাকালে আমরা যে লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, নিউ নর্মাল, সোশ্যাল ডিস্টেন্সসহ নানা নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হলাম, এসবের কোনো কিছুই আসলে নতুন না। আমাদের পূর্বেই মহামারী প্রত্যক্ষ করা মানুষেরাও ঠিক একই অবস্থার ভেতর দিয়ে গিয়েছে। ঠিক যেন ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি।
ইতিহাসের এই বাঁকবদলের কথাগুলোই উঠে এসেছে ড. মো: আদনান আরিফ সালিম রচিত ‘মহামারীর ইতিহাস’ বইটিতে। সহজ ভাষায়, সংক্ষিপ্ত পরিসরে, সচিত্র বর্ণনার মধ্য দিয়ে লেখক যেভাবে ডজনখানেক মহামারীর প্রাণবন্ত বর্ণনা তুলে এনেছেন- তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
বইটি শেষ করলে এক অদ্ভুত হতাশা ঘিরে ধরে। না, এটা বইয়ের কোনো ত্রুটির জন্য না। বরং আমাদের নির্বুদ্ধিতা ও অতীত থেকে শিক্ষা না নেয়ার প্রবণতার জন্যই জন্ম নেবে সেই হতাশা, যে হতাশা আমাদেরকে দীর্ঘদিনের জানা সেই প্রবাদটিই নতুন করে মনে করিয়ে দেবে, “ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো মানুষ ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নেয় না।”
ভাল বই পড়ুন, ভাল লেখা ও লেখককে উৎসাহিত করুন, তাহলেই গড়ে উঠবে জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ আমাদের স্বপ্নের ভবিষ্যত প্রজন্ম।
…
বই: মহামারীর ইতিহাস
লেখক: মো: আদনান আরিফ সালিম
প্রকাশনী: অন্যধারা
মুদ্রিত মূল্য: ৪৮০/-
“মহামারীর ইতিহাস” বইটি কিনতে ক্লিক করুন।