নকশালবাদ আন্দোলন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা বিশাল অংশ জুড়ে জড়িয়ে আছে। এই আন্দোলন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ভারতের সাধারণ জনজীবনের অলিগলিতে। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যেও ধাক্কা দিয়েছিল সে আন্দোলন। গড়ে উঠেছিল নকশাল সাহিত্য বলে ভিন্নধর্মী একটি ধারা। নকশাল আন্দোলন জন্ম দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অনেক শক্তিশালী সাহিত্যিকের। অনেক কবি-সাহিত্যিকই নকশাল আন্দোলনকে বুকে ধারণ করে তাদের সাহিত্যের আরাধনা করে গেছেন। তাদের সাহিত্যে নকশাল আন্দোলনকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। নবারুণ ভট্টাচার্য এরকম একজন সাহিত্যিক, যার কলমে উঠে এসেছে নকশালবাড়ির ইতিকথা। নকশালদের নিয়ে তিনি লিখেছেন বেশকিছু রচনা। হার্বার্ট সেরকমই একটি উপন্যাস। তবে সরাসরি নকশাল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নয় বরং নকশাল আন্দোলনের পরবর্তী পটভূমির ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়েছে উপন্যাসটি। আর হার্বার্টকে সিনেমায় রূপ দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। ২০০৫ সালে মুক্তি পায় হার্বার্ট। প্রোটাগনিস্ট হার্বার্টের চরিত্রকে জীবন্ত করেছেন শুভাশিষ মুখার্জি। সিনেমায় আরও ছিলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী, ব্রাত্য বসু, নীল মুখার্জি প্রমুখ।
হার্বার্ট-এর গল্প কলকাতার এক যৌথ পরিবারের ছেলে হার্বার্ট সরকারকে নিয়ে। বাবা ছিলেন ফিল্মমেকার, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। হার্বার্টের বয়স তখন বছর চারেক। পিতৃহীন হার্বার্টকে মাতৃহীন করার ভূমিকাটা পালন করে বাড়ির ছাদের বৈদ্যুতিক লাইন। ভেজা কাপড় মেলতে গিয়ে তড়িতের তীব্র ছোবলে হার্বার্টকে পুরোপুরি নিঃসঙ্গ করে মা-ও চলে যান। খোলা ছাদে মায়ের মৃতদেহের পাশে বসে উন্মুক্ত আকাশে উড়তে থাকা পেটকাট্টির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে ছোট্ট হার্বার্ট। তার জীবনও ততক্ষণে বলগাহীন ঘুড়ি হয়ে গেছে।
এবার নতুন মাও’র সাথে পরিচয় হয় হার্বার্টের। তার জ্যাঠাতো ভাই কৃষ্ণ নকশাল আন্দোলনের সমর্থক। তার কাছ থেকে লেনিনের বই নিয়ে চিলছাদে শুয়ে শুয়ে পাতা ওল্টায় হার্বার্ট। সেসব পড়ে মাওবাদ, লেলিনবাদ নিয়ে তার অপক্ব ধারণা তৈরি হয়। কৃষ্ণদার কিশোর ছেলে বিনু’র সাথে সাথে সেও গলা মেলায়, ‘পুলিশের লাঠি, ঝাঁটার কাঠি, ভয় করে না কম্যুনিস্ট পার্টি’। ততদিনে পড়ালেখা লাটে উঠেছে৷ বাড়ির ফাইফরমাশ খেটে, চিলছাদে কাটা ঘুড়ি কুড়িয়ে আর প্রতিবেশীর মেয়ে বনলতা-কে দেখে দিন কাটে হার্বার্টের।
আপাতদৃষ্টিতে হার্বার্টকে নিরীহগোছের এক এতিম ছেলে মনে হয়। তার আচার-আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক, সে আর দশটা ছেলের মতো নয়। কিছুটা ভীতু প্রকৃতির হার্বার্ট জ্যাঠতুতো ভাই ধন্না’র নির্বিচার অত্যাচারেও মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না। তারপরও অনাদরের এই জীবনের সাথে মানিয়ে নেয় সে, তার যে আর কোথাও যাওয়ার জো নেই।
কলকাতার তরুণ ও নতুন ফিল্মমেকারদের মধ্যে একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে। তারা যখন ফিল্ম বানান, তখন সিনেমার সনাতনী পদ্ধতির খুব একটা ধার ধারেন না। তাদের নির্মাণশৈলীতে স্বাতন্ত্র্য থাকে, সিনেমার ভাষায় যাকে বলে সেল্ফ-রিফ্লেক্সিভিটি। হার্বার্ট-ও একটি সেল্ফ-রিফ্লেক্সিভ সিনেমা। কলকাতার থিয়েটারের পরিচিত মুখ সুমন মুখোপাধ্যায় তার সিনেমায় ব্রেইখশিয়ান মেথডেরও দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে মনে হয়েছে, সুমনবাবু মৃণাল সেনকে গুরু মেনেছেন। হার্বার্ট-এ তিনি দেখিয়েছেন সিনেমার ভেতরে সিনেমার ক্যামেরা, যেটা মৃণালের আকালের সন্ধানেতে আমরা দেখেছি। আবার পুরো সিনেমাজুড়ে ছিল ফ্ল্যাশব্যাক-ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ডের জটিল খেলা, যা অনেকটা মৃণালের আরেক নির্মাণ এক দিন আচানক-এর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তবে নির্মাণশৈলীর এই জটিলতা হার্বার্টকে অবশ্যই একটি সফল রাজনৈতিক সিনেমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
একটি রাজনৈতিক সিনেমা হিসেবে হার্বার্ট কী বার্তা দিয়েছে সমাজকে? আর নকশাল আন্দোলনের সাথেই বা হার্বার্ট-এর কী সম্পর্ক হতে পারে? যেখানে সেসময় নকশাল আর উগ্রবাদ পরস্পরের প্রায় সমার্থক শব্দ, তখন হার্বার্টের মতো গোবেচারা কী করে এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারে? স্রেফ বাড়ির লোকের সাথে নকশালবাড়ির সরাসরি যোগাযোগ আছে বলে তাদের সংস্পর্শে এসে হার্বার্ট নিজেও একজন পাঁড় নকশাল সমর্থক হয়ে গেল? হার্বার্টের যা জ্ঞান, তা দিয়ে বামপন্থী বা মাওবাদের গভীরে গিয়ে তাকে অনুধাবন করা দুরূহ। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভূত-প্রেতে বিশ্বাসী হার্বার্টকে নকশাল আন্দোলনের সাথে জড়ানোর ক্ষেত্রে ভাইপো বিনুর প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। অসংলগ্ন হার্বার্ট বিনুর সংস্পর্শে এসে নকশালদের হয়ে কাজও শুরু করে। কিন্তু একসময় আন্দোলন থিতিয়ে যায়। হার্বার্ট প্রয়াত বিনুর ডায়েরির সুবাদে নিজেকে একজন ভূতবিশারদ বলে প্রচার শুরু করে।
ভূতবিশারদ হার্বার্টের সাথে দেখা করতে অনেক লোকই আসে। তাদের দক্ষিণায় হার্বার্টের দিন ভালোই কাটে। তার এই বুজরুকি তাকে তার পাড়ায় বেশ সম্মানও এনে দেয়। দর্শনপ্রার্থীদের উদ্দেশ্যে আমরা হার্বার্টকে অনেক কথা বলতে শুনি, যা আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে অসংলগ্ন প্রলাপ বা ধাপ্পা বলে মনে হয়। সাদা চোখে দেখতে গেলে হার্বার্টের ক্যাট, ব্যাট, ফিশ, ডগ, ওয়াটার বা পরলোকের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে বাক্যালাপ হেঁয়ালি বলেই বোধ হয়। কিন্তু সিনেমাটা যেহেতু কমপ্লেক্স সুতরাং তার অন্তর্গত বার্তাটিও কোনো নিগূঢ় উপায়ে দেওয়া হবে এমনটাই স্বাভাবিক। বুদ্ধিমান পাঠক নিজের মতো করে সেই বার্তাটা ধরে নেবেন। কোনো এক দর্শনপ্রার্থীকে হার্বার্ট চাঁপাগাছের মৃত্যু বিষয়ে সাবধান করে। বলে, জল না পেয়ে চাঁপাগাছ মরে যাচ্ছে তাই গাছের মালিক পরলোকে কষ্টে আছেন। হার্বার্ট পরামর্শ দেয় গাছটা মরে গেলে তুলে ফেলে নতুন একটা গাছ লাগিয়ে দিতে। আর না মরলে একটু ভালোমতোন পানি দিতে, যেন মৃতপ্রায় গাছটা আবার চাঙা হয়ে ওঠে।
হার্বার্টের গাছ সম্পর্কিত এই পরামর্শ কি শুধুই তার ব্যবসার একটা চালাকি, নাকি বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমস্যাকে ইঙ্গিত করে তার কোনো সমাধানের উপায়? নকশাল আন্দোলন ততদিনে মিইয়ে গেছে। রাষ্ট্রের প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে জিততে পারেনি নকশালরা। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, নকশালবাদী আদর্শটাকে রাষ্ট্র নিশ্চিহ্ন করে দিতে পেরেছে। একটা আদর্শ একবার জন্ম নিলে ও গণমানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে তাকে আর ধ্বংস করা যায় না। হার্বার্ট কি তবে বলতে চাইছে চাঁপাগাছটি রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে আপাত-পরাজিত একটি প্রতিবাদ। হয়তো এই চাঁপাগাছটিই নকশালবাদ। হয়তো সময়ের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক চর্চার এই স্থিতাবস্থাকে ভাঙার জন্য এখন শুধু প্রয়োজন মানুষের অন্তরের প্রতিবাদের সুপ্ত বারুদে একটুখানি টোকা দেওয়ার। হার্বার্ট সে কথাটিই বলতে চেয়েছে তার মতো করে, বাকিটা নিজেদের মতো করে বুঝে নেওয়ার দায়িত্বটা আমাদের।
নকশালবাদ বেশিরভাগ সময়েই কলকাতার সাহিত্যে, সিনেমায় মহিমান্বিত করে দেখানো হয়েছে, হার্বার্টও এ ধারা থেকে বেরোতে পারেনি। যেহেতু প্রোটাগোনিস্ট নকশালবাদের সাথে জড়ি,ত তাই নকশালপন্থীদের প্রতি একটা পক্ষপাতমূলক আবহ সিনেমাটিতে বিদ্যমান। নকশাল আন্দোলন কোনো অবিসংবাদিত কিছু নয়, সুতরাং এই আন্দোলনকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখাটাও দোষের কিছু নয়। হার্বার্ট-এ আমরা কিছু কিছু রাষ্ট্রপন্থী চরিত্রকে নকশাল আন্দোলনের সমালোচনা করতে দেখি, কিন্তু সেই সাথে আবার এটা বলতেও শুনি, ‘স্টেটের টেররও কিছু কম ছিল না’।
সিনেমার শেষ দৃশ্যে এসে পরিচালক তার নিগূঢ়তার খেই হারিয়েছেন। একজন সচেতন দর্শক যদি হার্বার্ট সিনেমাটা বোঝার ন্যূনতম ক্ষমতাও রাখেন, তাহলে তার পক্ষে শেষদিকে দেখানো একটি ঘটনার কারণ না বোঝার কথা নয়। শুধু শুধু তাকে সেই ঘটনার কারণ খোলাসা করে দেওয়া সিনেমার দৈর্ঘ্যবৃদ্ধি ভিন্ন আর কিছু করেনি।
হার্বার্ট চরিত্রে অভিনয় করেছেন শুভাশিষ মুখোপাধ্যায়। নবারুণ ভট্টাচার্যের একসেন্ট্রিক, অ্যাবসার্ড হার্বার্টকে যেন প্রাণদান করলেন শুভাশিষ। চরিত্রের ভেতর ডুবে গিয়ে দারুণ দক্ষতার সাথে হার্বার্টকে পর্দায় তুলে এনেছেন শুভাশিষ। তার মুখভঙ্গি, হার্বাটের অসংলগ্ন সংলাপ বলায় পরিমিত স্বাতন্ত্র্য ও স্বতস্ফুর্ত অভিনয় অবশ্যই সিনেমাটার সাফল্যের পেছনে একটি বড় নিয়ামক। এছাড়া গান্ডু খ্যাত জয়রাজ ভট্টাচার্য তরুণ হার্বার্টের চরিত্রেও পাশ করেছেন। পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে সব্যসাচী চক্রবর্তীর ভূমিকা সিনেম্যাটিক দিক থেকে আহামরি কিছু না হলেও গল্পের গুরুত্বে তার চরিত্রটি হেলাফেলা করার মতো নয়। রাষ্ট্রের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তিনি হার্বার্টের বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার্বার্ট যা বোঝাতে চেয়েছিল তা বুঝতে পেরেছেন। তাই শেষ অব্দি তাকে বলতে শোনা যায়, ‘সে গভর্নমেন্ট বলুন, পুলিশ বলুন আর স্টেট-ই বলুন- কখন কোথায় কীভাবে বিস্ফোরণ হবে সেটা জানতে আমাদের এখনো অনেক বাকি আছে।’ এটাই হচ্ছে আসল কথা। কখন কোথায় কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কার প্রতিবাদ মাথাচড়া দিয়ে উঠবে তা কেউ বলতে পারে না। সেই প্রতিবাদ হতে পারে বিনুর মতো সচেতন কোনো মানুষের পক্ষ থেকে আবার হার্বাটের মতো আপাত-নিরীহ, উপেক্ষিত কোনো উৎস থেকে। তার জন্য শুধু দরকার একটু প্রেষণা, একজন পথপ্রদর্শক।
বই ও সিনেমা সম্পর্কিত চমৎকার সব রিভিউ আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/