আমাদের প্রত্যেকের জীবনের একটা গোপনীয়তা থাকে। সেই গোপনীয়তাকে সযত্নে লালন করতে হয়। সেটা তার নিজস্ব, একান্ত আপন। মধুর একটা সম্পর্ক আছে সেই গোপনীয়তার সাথে তার। কিন্তু যে মুহূর্তে আট-দশজন যখন সে গোপনীয়তার সাথে পরিচিত হয়ে যায়, তখন তা কদর্যতায় রূপান্তরিত হয়। কারণ, সেই গোপনীয়তার সাথে সেই বাকি দশজনের সম্পর্কটা কিন্তু মধুর নয়, সেন্টিমেন্টটা জড়িয়ে নেই সেখানে।
অনল মোবাইলে পর্নসহ স্কুলে ধরা পড়লে তার মাকে শিক্ষকদের সামনে অপমানিত-অপদস্থ হতে হয় ছেলের কর্মের জন্য। ঘটনার ব্যাপারে মা-বাবাকে বিস্তারিত বলে ছেলের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করলে, ঐদিন রাতে অনলের বাবা ছেলেকে রুমে ডেকে আনেন। চেষ্টা করেন কৈশোরের এ মানসিক সংকট থেকে উত্তরণের সুবিধার্থে উপরোক্ত বক্তব্যের বাস্তবতার সাথে পরিচয় করাতে।
পরিচালক কৌশিক কর তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবিপর্ণমোচীতে টিনেজারদের গল্পে সেক্স এডুকেশন, চাইল্ড সাইকোলজি এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্সের সাথে দর্শকদের ভিন্ন আঙ্গিকে পরিচয় করাতে কাহিনীকে যে কৌশলে সাজিয়েছেন তা প্রশংসার দাবিদার। মুভিটির জোরালো বিষয়বস্তুতে বয়ঃসন্ধিতে অনলের ‘সেক্স’ নিয়ে নিছক কৌতূহল, এবং পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে কিশোর-মনে যে অহেতুক পাপবোধ জন্মে তা নিয়ে গল্প ফেঁদেছেন পরিচালক।
সদ্য কৈশোরপ্রাপ্ত ছেলেরা লুকিয়ে লুকিয়ে যা যা করে, যেমন: ফোনে পর্ন দেখা, স্কুলে ধরা পড়ে মায়ের কাছে তুমুল বকুনি খাওয়া, পাড়ার বখাটে পানুদার কাছে গিয়ে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়া— তার সব এলিমেন্ট কৌশিক রেখেছেন সিনেমায়। তবে তা তিনি করে দেখিয়েছেন শৈল্পিক ছোঁয়ায়। সাথে সাবপ্লটে যোগ করেছেন আরো কিছু বাস্তবিক অনুষঙ্গ। যেমন: অনলের বাবা হতে চেয়েছিলেন একজন ফিল্ম ডিরেক্টর, কিন্তু তা কোনো না কোনো কারণে আর হয়ে ওঠেনি। যা শুরুর একটি দৃশ্যে অনলের বাবার রুমে ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, ফ্রান্সিস কপোলার দ্য গডফাদারের পোস্টার দেখে টের পাওয়া যায়। সেই দৃশ্যে পাশে সযত্নে তুলে রাখা অ্যান্টিক ক্যামেরা, অতঃপর বাবা এবং তার পেছনে উপরে চার্লি চ্যাপলিনকে আশ্রয় করে মেইন সাবজেক্টের অব্যক্ত হতাশা ফুটে ওঠে লেন্সে। হতাশাচিত্রকে এমন দক্ষতায় ভিজুয়্যাল প্রেজেন্টেশনের জন্য সিনেমাটোগ্রাফার সৌরভ ব্যানার্জির প্রশংসা না করলেই নয়।
অনলের বাবা ফিল্মে ক্যারিয়ার গড়তে পারেননি সত্য, কিন্তু এখনও তার সুপ্ত ‘ডিরেক্টর সত্তা’ মাঝে মাঝে জেগে ওঠে। এজন্যই তিনি তার ছেলেকে ক্যামেরার হ্যান্ডেলিং শেখাবে বলে কথা দেয়। এমনকি তিনি মনে মনে আজও ফিল্ম বানানোর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দেখেন। অদ্ভুত সুন্দরভাবে বাবা-ছেলের আলাপনে উঠে আসে ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিস, সেভেন্থ সিল, মেঘে ঢাকা তারা, কাসাব্লাঙ্কার মতো বিখ্যাত সব সিনেমার নাম।
আরেক সাবপ্লটে বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে ছেলে-মেয়েরা যেরকম পরিবেশে বেড়ে উঠছে— তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন নির্মাতা। কারণ, বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছে নিজেদের প্রকাশটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তের প্রকাশ। সেখানে নিজস্ব ও ব্যক্তিগত বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু একময়ে এসে মানুষ নিজস্বতাকে অনুভব করে, যা ব্যক্তির মধ্যে অনভিপ্রেত অস্তিত্ব সঙ্কট তৈরি করে বলে পর্ণমোচী বলতে চেয়েছে।
ছবিটির সিনেমাটোগ্রাফিতে লক্ষ্যণীয় কিছু এক্সপেরিমেন্ট বিমুগ্ধ হয়ে দেখেছি। শেষদিকে বাড়ির হলুদ দেয়ালে অনলের ছায়ার সাথে তার মায়ের কথোপকথন, কিংবা সাইকেলে বাড়ি ফিরতে গিয়ে কিশোরীর দৃশ্যে ক্যামেরার মুনশিয়ানা দেখা যায়। তদ্রুপ, পানুদার পিটুনি খেয়ে ঘুপচি গলি দিয়ে বের হয়ে এসে উদাম নাচে মণ্ডপে এসে মেতে ওঠা, এবং ওখান থেকে টিল্ট করে ক্যামেরা ওপরে উঠে যাওয়াও চমৎকার ক্যাপচার। সাথে ছিল রবিরঞ্জন মৈত্রের ফার্স্ট ক্লাস এডিটিং। মাতাল অবস্থায় ধর্ষক পেটানোর কল্পনা থেকে পুলিশ অফিসার মি. ঘোষের স্ত্রীর ডাকে বাস্তবে ফিরে আসার দৃশ্য— এর মাঝে অন্যতম। মি. ঘোষ এবং মিসেস ঘোষের মিলন দৃশ্যে ঘড়ির টিকটিক ধ্বনিতে ব্যবহৃত হয়েছে ‘মিউজিক্যাল মন্তাজ’র টেকনিক। আর্ট ডিরেকশনের নিপুণতা ফুটে ওঠে অনলের বাবার মৃত্যুর পর ইতালিয়ান সিনেমা বাইসাইকেল থিফের পোস্টারে। অনুরূপভাবে, অনলের ফ্যান্টাসির জগত থেকে জীবনের অপ্রত্যাশিত সত্য জানার পর অনুশোচনা দৃশ্যে দেয়ালে সাঁটানো ইডিপাসের ছবি অর্থবহ হয়ে ওঠে। তবে ছোট্ট ত্রুটিও নজরে এসেছে। মি. ঘোষ তার মেয়েকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে যে মোড়কে মুড়িয়ে ল্যাপটপ উপহার দেয়। তা যখন হাতবদল হয় এবং সবাই নেড়েচেড়ে দেখে, তখন মোড়কে আবৃত ল্যাপটপের বাক্সের ওজন স্বাভাবিক ওজনের থেকে অনেকটা কম মনে হয়।
এই ছবির কয়েকটি ডায়ালগ বেশ ইন্টেলেকচুয়াল! অনলের বাবার কথাগুলো দিয়েই যদি শুরু করি। বেশ আবেগঘন এবং হৃদয়ের গভীর থেকে ভারী গলায় বলা সেসব কথা। যা শুনতে সত্যিই ভীষণ লাগছিল। “এ বয়সে বান্ধবীদের প্রতি আকর্ষণ, সেক্সের প্রতি আকর্ষণ থাকাটা স্বাভাবিক। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেরই একটা গোপন অধ্যায় থাকে। গোপন বাক্স থাকে। এগুলোর সাথে সময় কাটাতে হয়। তখন সারা পৃথিবীটা নিজের মতো করে ধরা দেয়। একান্ত নিজের প্রাণসম্পদগুলো জমানো থাকে সে বাক্সে। এগুলো সবার সাথে শেয়ার করা যায় না, করতে নেই। করলে কিন্তু কর্পূরের মতো ভ্যানিশ হয়ে যাবে…।” আবার শিক্ষকদের আড্ডার দৃশ্যে পর্নের মতো করে ‘প্রন’ উচ্চারণ করে বুদ্ধিদীপ্ততায় চিংড়ি দেখিয়ে দিয়ে সংলাপে কমিক রিলিফের অস্তিত্বও প্রমাণ করে।
পুলিশ চরিত্র মি. ঘোষ ধর্ষকদের থার্ড ডিগ্রি দিলেও, বাড়িতে তার স্ত্রীর প্রতি বিরূপ আচরণ করেন। এখানে পরিচালক মানবচরিত্রের দ্বিচারিতার মুখোশ উন্মোচন করেছেন। আবার যে শিক্ষক অনলের মোবাইল কেড়ে পর্ন মুভি দেখার কারণে ধিক্কার জানান স্টাফরুমে, সেই একই টেবিলে বসে পর্ন মুভিটি অন্য শিক্ষকের সঙ্গে শেয়ার করে বিকৃত যৌনাচারে তৃপ্তির রসদ খুঁজে পান। এ যেন হিপোক্রেসির চূড়ান্ত নমুনা!
সবশেষে বলব- পর্ণমোচী চলচ্চিত্রটি তার কাহিনী, সংলাপ, চিত্রগ্রহণ, চিত্রসম্পাদনা, শব্দ ও সংগীতের পাশাপাশি নামকরণেও সার্থকতার প্রমাণ দিয়েছে সারমর্ম বিচারে। ছবির শেষে বাবা ছেলেকে যখন পর্ণমোচী-র মানে জিজ্ঞাসা করে। ছেলে তখন ফ্যালফ্যাল চোখে বাবার উত্তরের অপেক্ষা করলে বাবা নিজেই বলে দেন,
যে সকল গাছ পুরনো পাতাকে ঝরিয়ে আবার নতুন পাতায় সেজে উঠে, সে গাছই পর্ণমোচী। আর আমাদের জীবনটাকে এই পর্ণমোচীর মতো করেই ভাবতে হবে।