মায়েস্টার অ্যায়মন ক্যাসেল ব্ল্যাকের বারান্দায় বসে জন স্নো-কে বলেন,
“For love is the bane of honor, death of duty.”
বইয়ের ঠিক মাঝখানে এসে উক্তিটা পড়ার পর পুরো কাহিনীটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। যারা সিরিজটির অন্তত প্রথম সিজন পর্যন্ত দেখেছেন, তারা আমার পরের কথাগুলো সহজেই বুঝতে পারবেন। খেলা যতই সিংহাসনের হোক, এই খেলা কিন্তু ভালোবাসা দ্বারাই পরিচালিত। কাহিনীর শুরু হয় কিংস ল্যান্ডিংয়ে হ্যান্ড অফ দ্য কিং জন অ্যারিনের রহস্যজনক মৃত্যুর মাধ্যমে। এক বিশেষ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তার এই পরিণতি হয়। প্রশ্নের উত্তরও তিনি পেয়ে যান। কিন্তু এই উত্তর পুরো সেভেন কিংডমের শাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে দেবে।
জন অ্যারিন, কুইন সার্সি ল্যানিস্টারের সম্পর্কে একটি গোপন কথা জেনে যান। আর তা হলো- নিজের আপন যমজ ভাইয়ের সাথে অজাচারের সম্পর্ক। এর থেকেও বড় সত্য হলো, সার্সির তিন সন্তান কিং রবার্ট বারাথিওনের না, বরং জেইমি ল্যানিস্টারের। কাজেই রবার্টের পর এই তিন সন্তানের কারোরই সিংহাসনের উপর কোনো অধিকার নেই। এই সত্য যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্যই জন অ্যারিনকে অনেক কৌশলে হত্যা করা হয়। সবাই ধরে নেয়- বার্ধক্যের কারণেই হ্যান্ড অফ দ্য কিংয়ের মৃত্যু হয়েছে। হ্যান্ড অফ দ্য কিং ছাড়া কিংডম চলে না। তাই কিং রবার্ট ব্যারাথিওন সুদূর নর্থে উইন্টারফেল যাত্রা করেন নিজের প্রিয় বন্ধু লর্ড এডার্ড ওরফে নেড স্টার্ককে নতুন হ্যান্ড বানানোর জন্য। আর এভাবেই শুরু হয় এ সং অফ আইস অ্যান্ড ফায়ারের প্রথম উপন্যাস অ্যা গেম অফ থ্রোন্স-এর গল্প।
এমন কোনো গল্প কি আপনার পড়তে মন চাবে, যার সব কাহিনী আপনি আগে থেকেই জানেন? প্রত্যেকটা চরিত্র এমনকি কোথায় শেষ হবে সেটাও আপনি জানেন। যারা একইসাথে কোনো বই আর তার উপর নির্মিত সিরিজ বা মুভি দেখেছেন, তারা এর উত্তর ভালো দিতে পারবেন। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, একটি সিনেমা বা টিভি সিরিজ গল্পের অর্ধেকটাই দেখাতে পারে।
এখানেও তাই আগে থেকে পরিচিত চরিত্রগুলোকে আরো গভীরভাবে চিনেছি। প্রত্যেকটি বক্তব্যের পেছনে যে একটি চরিত্রের নিজস্ব চিন্তা থাকে, তা কোনো মুভি বা সিরিজে দেখানো সম্ভব হয় না। চার মিনিটের একটি দৃশ্যের পেছনে ১০ পৃষ্ঠা রচনা করা হয়। এ কারণেই গল্প পড়ার আলাদা একটা আনন্দ রয়েছে। সিরিজ আর বইয়ের মধ্যে বলতে গেলে ৯০% মিল রয়েছে। কিছু জিনিস সিরিজে অতিরিক্ত দেখানো হয়েছে। আবার কিছু জিনিস আছে যা বইয়ের পাঠকরা ছাড়া কেউ জানতে পারবে না। তবে গেম অফ থ্রোন্স সিরিজের প্রথম সিজনটি অসাধারণ। যেভাবে বইয়ের পাতা থেকে পুরো পরিবেশ বাস্তবে দেখানো হয়েছে তার প্রশংসা করতেই হবে।
মাঝে মাঝে বই পড়ার পর তাই একটু সিরিজ দেখতে বসেছিলাম। তখন আসলেই ভালো লেগেছিল। আর একটা বিষয়, জর্জ আর আর মার্টিন সম্ভবত প্রথম বই লেখার সময়ই তিনি এই গল্পের ইতি কীভাবে টানবেন তা ঠিক করে রেখেছিলেন। বইয়ে আমার সব থেকে প্রিয় অংশটি সিরিজে দেখানো হয়নি। এটি দিয়ে এইচবিও সিরিজের জোড়াতালি দেওয়া এন্ডিংকে অনেকটা জাস্টিফাই করা যায়।
একদম শুরুর দিকের উক্তিটি আবার পড়ুন। এই মানুষটা পুরো গল্পের মধ্যে পাঠকের মন জয় করে যাবে। তার সাথে এই উক্তিটি পুরোপুরি মিলে যায়। যখন ভালোবাসার প্রশ্ন আসে, তখন নিজের নৈতিকতা, সম্মান কোনো কিছুর মূল্য থাকে না। রাজনীতির মধ্যে এসবের কোনো জায়গা নেই। আবেগ আর যুক্তি কখনো রাজনীতিতে একসাথে ব্যবহার করা যায় না। “In the game of thrones, either you win or you die”.
মার্টিন অ্যা সং অফ আইস অ্যান্ড ফায়ারের মূল সাতটি বই ক্যারেক্টার ড্রিভেন চ্যাপ্টার আকারে লিখেছেন। মানে প্রত্যেকটি চ্যাপ্টার একটি ক্যারেক্টারের পার্সপেকটিভ থেকে বর্ণনা করা। আর এখানে কেবল উইন্টারফেলের চরিত্রগুলোকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ধূর্ত চরিত্র, যেমন- সার্সি ল্যানিস্টার, পিটার বেইলিশের মতো ক্যারেক্টারের জন্য আলাদা কোনো চ্যাপ্টার থাকলে ভালো লাগতো। কেবল পজেটিভ ক্যারেক্টারের মাধ্যমে গল্প না বলে এদেরও ব্যবহার করা যেত।
গেম অফ থ্রোন্স আমার পড়া সবচেয়ে বড় বই (প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠা)। ফ্যান্টাসি জনরার ইংরেজি বই মূলত পড়া একটু কঠিন। কিন্তু কাহিনী আর চরিত্রের সাথে আগে থেকে পরিচিত থাকায় খুব একটা অসুবিধা হয়নি। এখানে পাঠকের কল্পনার স্বাধীনতা কিছুটা খর্ব হতে পারে। কিন্তু যারা আগে সিরিজ দেখেছেন তারা এটুকু মেনে নিতে পারেন যে, আপনি যা দেখেছেন তার বিশালত্ব বই পড়ার সময় অতটা কল্পনাও করতে পারতেন না। মধ্যযুগের নানা শব্দের ব্যবহার করায় পড়তে একটু কষ্ট হবে (চার ধরনের ঘোড়ার জন্য ইংরেজি হর্স ছাড়াও আরো অনেকগুলো শব্দ রয়েছে)। আর আগে সিরিজ না দেখা থাকলে চরিত্রগুলো মনে রাখতেও একটু কষ্ট হবে। সেদিক দিয়ে আমি নিজে অন্তত ভালোই ছিলাম।
বইয়ের নাম: অ্যা সং অফ আইস অ্যান্ড ফায়ার || লেখক: জর্জ আর. আর. মার্টিন
জনরা: ফ্যান্টাসি || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম