বাংলা সাহিত্যের বলিষ্ঠ নারী চরিত্র

নারীরা সমাজের অর্ধেক হলেও প্রাচীন ইতিহাসে তাদের ঠাঁই মিলেছে অল্পই। তেরো শতকের গোড়ায় ইন্দো মুসলিম শাসন পত্তনের সময় পর্যন্তও এই অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়নি। শুধু পুরুষের অনুপ্রেরণাদাত্রী হিসেবে নয়, বাঙালি নারী অন্তরালে না থেকে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত হয়ে অবদান রেখেছে বহুক্ষেত্রে। বাংলা সাহিত্যের লেখকদের এ সমস্ত নারী চরিত্রকে বিভিন্ন আঙ্গিকে তুলে আনা একধরনের দায়বদ্ধতাই ছিল বটে। 

মৃণাল: হোক প্রতিবাদ 

রবি ঠাকুরের ছোট গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’-এর মৃণাল বাংলা সাহিত্যের বলিষ্ঠ নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে একটি। গল্পটি প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র মাসিক পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যায়। কলকাতার সাতাশ নাম্বার মাখন বড়ালের গলির কোনো এক বাড়ির মেজো বউ মৃণালের লেখা চিঠিই মূলত ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্প। মৃণালের আশ্রিতা বিন্দিকে পাগলের সাথে বিয়ে দেয়ার ফলে বিন্দির আত্মহত্যা মৃণালকে রুখে দাঁড়াতে শেখায়। সাদামাটা এক গৃহবধূ লিখেছে তার স্বামীকে, প্রশ্ন করেছে প্রচলিত রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে- যে প্রশ্ন শুধু মৃণালের স্বামীকে নয়, এ প্রশ্ন সমগ্র পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে। প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী প্রতিবাদী নারী চরিত্র মৃণাল চিঠির ইতিতে “তোমাদের চরণতলাশ্র‍য়ছিন্ন মৃণাল” লিখে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, তা বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন হাওয়া এনে দিয়েছিল বৈ কি! 

সুবর্ণলতা: স্বপ্নময় হোক ঝুলবারান্দা  

অল্প বয়সে ঠাকুরমার জোর করে দেয়া বিয়ে সুবর্ণলতাকে যে শ্বশুরবাড়িতে একখানা সংসার দিয়েছিল, সেই সংসারে সুবর্ণলতা ছিল আধভাঙা পোড়োবাড়ি বেয়ে ওঠা একখানা সবুজ সতেজ লতাগাছের মতো। বই আর কবিতাপ্রেমী সুবর্ণ, প্রতিবাদমুখর সুবর্ণ, আকাশ আর ঝুলবারান্দার আকাঙ্ক্ষাময় সুবর্ণ- এক অঙ্গে বহুরূপ সুবর্ণলতার। ‘সুবর্ণলতা‘ বাড়ির বউয়ের জীবনভর যুদ্ধের আখ্যান। এর প্রথম পর্ব ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ এবং তৃতীয় কিংবা শেষ পর্ব ‘বকুল কথা’ যেখানে সত্যবতী অর্থাৎ সুবর্ণলতার মা এবং সুবর্ণলতার মেয়ে বকুলকে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম প্রতিশ্রুতি ট্রিলজির তিনটি চরিত্র বাংলা সাহিত্যের বলিষ্ঠ নারী চরিত্র তো বটেই, সেই সাথে লেখিকা আশাপূর্ণা দেবীও কম যান না। তিন বলিষ্ঠ নারী চরিত্রের স্রষ্টা সংসারের সমস্ত কাজ সেরে লিখতে বসতেন রাতের বেলায়।

Image Source: Amazon

দীপাবলি: অন্তর হোক আলোকময়                                   

সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার, তথাকথিত নিয়মকানুন আর বদ্ধমূল চিন্তাধারার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আপোষহীন অনন্য নারীচরিত্র দীপাবলি। দীপাবলি নিজের কর্মের মাধ্যমে নামকে করতে পেরেছিল সার্থক, অন্তরকে জ্ঞানের আলোয় করে তুলেছিল আলোকিত। বিংশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে পুরুষশাসিত সমাজে দীপাবলি ছিল একধরনের বৈপ্লবিক চরিত্র যে হারতে শেখেনি, থামতে শেখেনি। সমরেশ মজুমদারের লেখায় দীপাবলি জ্বলে উঠেছিল আত্মমহিমায়, হয়ে উঠেছিল হাজারো পাঠকের অনুপ্রেরণা। বাল্যকালের বৈধব্য, দারিদ্র্য কিংবা পালিত বাবার মৃত্যুতেও যে থমকে দাঁড়ায়নি। শুধু ইচ্ছেশক্তি আর আত্মসম্মানবোধ পুঁজি করে জয়ী হতে পেরেছিল জীবনযুদ্ধে।

শ্রবণা: প্রতিষ্ঠিত হোক সত্য  

Image Source: Amazon

কোনো এক ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যেয় টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনে চার যুবক শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে এক গৃহবধূর। সেখানে আশেপাশের মানুষ যখন নীরব দর্শক, তখন সেই গৃহবধূকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে আরেক নারী, শ্রবণা। পরবর্তীতে নির্যাতিতার পক্ষে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল হয় শ্রবণা। সামাজিক আর মানসিক চাপকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে সে নামে প্রতিবাদে। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কলমের আঁচড়ে ‘দহন‘ উপন্যাসের শ্রবণা  হয়ে ওঠে এমন এক নারীচরিত্র যে যেকোনোকিছুর বিনিময়ে চায় সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে, চায় স্বাধীনতা আর ন্যায়বিচার।

জমিলা: নিশ্চুপ মুখ হোক বাঙ্ময়

Image Source: Goodreads

জমিলা চরিত্রটি লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সৃষ্টি এক যথার্থ আদর্শবাদী চরিত্র, যাকে দিয়ে ঘুনেধরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের মুখে থুতু দিয়েছিলেন তিনি। নারীর মুখ বুজে সয়ে যাওয়ার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত জমিলা। ধর্ম ব্যবসায়ী স্বামী মজিদের ভণ্ডামি আর অন্যায়-অত্যাচারের সামনে বার বার বঙ্কিম প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় জমিলা, ঝড় তোলে কথার। রহিমার মতো চুপ থাকতে শেখেনি সে। জমিলা চরিত্রের তেজ আর রুখে দাঁড়াবার এই মনোভাব অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয় ‘লালসালু’ উপন্যাসকে। 

শিল্প-সাহিত্যে বলুন কিংবা হেঁশেলে, ধর্ম, দর্শন কিংবা রাজনীতিতে নারীদের বিকল্প হিসেবে একমাত্র নারীরাই দাঁড়াতে পেরেছে। কখনো হাজার চুরাশির মা আদর্শিক সুজাতা হিসেবে, কখনো বা হাসিমুখে অনুপ্রেরণাদাত্রী স্ত্রী মাধবীলতা হিসেবে, আবার কখনো সংশপ্তকের বেপরোয়া ও হার না মানা হুরমতি হিসেবে। বাংলা সাহিত্যের এ সমস্ত বলিষ্ঠ নারী চরিত্র আসমান থেকে পড়েনি, চরিত্রগুলো যে বাস্তবে আমাদেরই মা-বোন-ঠাকুমা তা বুঝতে কারোরই নিশ্চয়ই দুবার ভাবতে হয় না।

This is a Bengali article about the wonder women in Bengali literature.
Feature Image Courtesy: হিরক ইসলাম

Related Articles

Exit mobile version