অল অব আস আর ডেড: কল্পনার পটে আঁকা বাস্তবতা

ধরুন, আপনি একটি শহরে থাকেন। সেই শহরে কোনো এক ভাইরাসের কারণে মানুষ হয়ে পড়েছে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। যে যাকে সামনে পাচ্ছে, তাকেই কামড়াচ্ছে। সুস্থ কাউকে কামড়ালে সেই মানুষও কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে হয়ে উঠছে উন্মাদ। অন্যদের কামড়ানো শুরু করছে সে। এমনটা কি হতে পারে বাস্তবে?  

এই দৃশ্যের চাক্ষুষ বাস্তবতার কথা সত্য না ভাবাই স্বাভাবিক। সেই সাথে আপনি যদি সিনেমাপ্রেমী হন, তবে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনার মাথায় হলিউড সুপারস্টার ব্র্যাড পিটের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড’ আর কোরিয়ান সিনেমা ‘ট্রেন টু বুসান’-এর নাম ঘুরছে। 

আমেরিকান একশন ফিল্ম ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড-এর একটি দৃশ্য; Image Source: empireonline.com

যদি তা-ই হয়, তবে আপনার অনুমানশক্তির প্রশংসা করতে হয়। কেননা আজ আমরা কথা বলব জম্বি নিয়েই। তবে, কোনো জম্বি সিনেমা নিয়ে নয়। আজ আমাদের আলোচনা জম্বি সম্পর্কিত সিনেমার চেয়েও বেশি কিছু নিয়ে। একটা সময় কোনো এক নির্দিষ্ট ধরনকে কেন্দ্র করে সিনেমা নির্মাণ করা হতো। সেই নির্দিষ্ট ধরনের সিনেমা মানুষের চাহিদাও পূরণ করত অনায়াসে। তবে, সে সময় আজ আর নেই। ভোগবাদী সমাজব্যবস্থা মানুষের চাহিদাকে করেছে অসীম। 

শিল্প প্রধানত সৃষ্টি হয় শিল্পীর ইচ্ছায়। তবে, শিল্পীর ইচ্ছা যে সাধারণ মানুষের ইচ্ছা দ্বারা প্রভাবিত হয়, তা বলাই বাহুল্য! শিল্পের ভোক্তা যেহেতু মানুষ, ফলে এ সময়ের ভোগবাদী চিন্তাধারার মানুষের অসীম চাহিদা মাথায় রেখে আজকাল শিল্প সৃষ্টি করেন অনেক শিল্পী। আর সিনেমা যে এক উৎকৃষ্ট শিল্প, তা আমাদের সবার জানা। 

মানুষের অসীম চাহিদার আঁচ লেগেছে সিনেমাতেও। কোনো এক নির্দিষ্ট ধরনের সিনেমা এখন আর সন্তুষ্ট করতে পারে না আজকের দুনিয়ার অসীম চাহিদার মানুষগুলোকে। চাহিদাই যেহেতু যোগানের সৃষ্টি করে, তাই মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে গত কয়েকবছর ধরে বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে সিনেমার বর্ধিত সংস্করণ- ‘সিরিজ’। 

দর্শকরা নিজেদের সিরিজ দেখার প্রসঙ্গ টেনে হরহামেশাই বলে থাকেন, অমুক সিরিজ আমার জীবনবোধ পরিবর্তন করে দিয়েছে। দর্শকদের এই দাবি নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে এটা সত্য, পরিচালক-প্রযোজকরা এখন সিরিজে জীবন ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। কারো মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, সিরিজে জীবন ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারটা কেমন? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে আমাদের জানতে হবে- জীবন কী?

জীবনের ধ্রুব কোনো সংজ্ঞা নেই। আমরা কেবল এটুকু ধরে নিতে পারি, জীবন হলো একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ হাট। যেখানে হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, রাগ-অভিমান, ভালোবাসা-ঘৃণা, পাপ-পুণ্য, সততা-প্রতারণা, ন্যায়-অন্যায়, বাস্তবতা-পরাবাস্তবতা পসরা সাজিয়ে বসে। এসবের একেকটিকে কেন্দ্র করে আগে নির্মিত হতো সিনেমা। আর এসবের সবকয়টি নিয়ে এখন চেষ্টা করা হয় সিরিজ নির্মাণের।

যে বিষয় কেন্দ্র করে আগে সিনেমা নির্মাণ করা হতো, তা কতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন পরিচালক, তার ওপর নির্ভর করতো সিনেমার সার্থকতা। আর জীবনকে কতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে, তার ওপর নির্ভর করে আজকের দিনের সিরিজের সার্থকতা। এই মানদণ্ডে এক সার্থক সিরিজ বলা যায় ‘অল আব আস আর ডেড’-কে। এটি একটি কোরিয়ান টিভি সিরিজ, যেখানে একটি স্কুল থেকে দুর্ঘটনাবশত ছড়িয়ে পড়া একটি ভাইরাস কীভাবে পুরো একটি শহরকে বদলে দেয়, তা দেখানো হয়। 

জম্বি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব; Image Source: Yang Hae-sung/Netflix

সজ্ঞানে হোক, কিংবা অজ্ঞানে, ‘অল অব আস আর ডেড’ আমাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবীর একটি আভাস দিতে সক্ষম হয়েছে। এই সত্য স্বীকার করত বাধ্য করেছে যে- প্রতিটি মুদ্রারই দুটি পিঠ আছে। যেখানে সুন্দরের পেছনেই অসুন্দর, আর অসুন্দরের পেছনেই সুন্দরের অবস্থান। 

আমাদের সব সৃষ্টিশীলতার সাথেই প্রযুক্তি জড়িত, ফলে এই প্রযুক্তিই আবার হয়ে  দাঁড়িয়েছে ধ্বংসের আঁতুড়ঘর। প্রযুক্তির সহায়তায় আধুনিক জীববিজ্ঞানের সাফল্য কোন পর্যায়ে পোঁছেছে তা আমরা অনেকেই অনুমান করতে পারি। জীববিজ্ঞান আজ এতটাই উন্নত যে, পৃথিবী থেকে হাজার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া প্রাণীকে ফিরিয়ে আনার দ্বারপ্রান্তে বিজ্ঞানীরা। এই বাস্তবতায় এখন বড় প্রশ্ন, যে জীববিজ্ঞান অস্তিত্বহীন প্রাণীকে অস্তিত্বশীল করে তুলতে পারে, সেই জীববিজ্ঞানের কি অস্তিত্বশীল প্রাণীকে অস্তিত্বহীন করার সামর্থ্য নেই? 

যদি থাকে, তবে কি জীববিজ্ঞান ব্যবহার করে কোনো ধবংসাত্মক বা বেখেয়ালি মানুষের ভুলে পৃথিবী থেকে মনুষ্যজাতিরই হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় না? 

‘অল অব আস আর ডেড’ আমাদের এমনই এক বাস্তবতার কথা বলে। যেখানে এক জীববিজ্ঞান শিক্ষকের সন্তান স্কুলে সহপাঠীদের দ্বারা নিয়মিত নিপীড়নের শিকার হয়। সেই শিক্ষক সন্তানকে সব নীরবে সহ্য না করে প্রতি-আক্রমণ করতে উপদেশ দেন। কিন্তু, সন্তান তা করে না। কারণ, নিজের ভেতরে সে পুষে রেখেছে এক সর্বংসহা ভীতু মানুষকে। যে মানুষ জয় করতে দেয় না তার ভয়কে। 

জীববিজ্ঞান শিক্ষক চরিত্র লি বায়ং চ্যান; Image Source: screenrant.com

ফলে সেই শিক্ষক নিজেই দায়িত্ব নেন সন্তানকে সাহসী করে তোলার, যাতে সে প্রতি-আক্রমণ করে নিজেকে রক্ষা এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারে। এই লক্ষ্যে তুমুল মেধাবী সেই জীববিজ্ঞান শিক্ষক আত্মরক্ষায় পারদর্শী ইঁদুরের হরমোন সংগ্রহ করে তা থেকে একটি ভাইরাস সৃষ্টি করে সন্তানের দেহে সঞ্চারিত করেন। কিন্তু, এতে তার সন্তানের যে প্রতিক্রিয়া হয়, তা ছিল তার অনুমানের উর্ধ্বে। 

পরবর্তীতে তিনি সেই বিশেষ হরমোনের অধিকারী ইঁদুরকে নিজের স্কুলের ল্যাবে সংরক্ষণ করেন। একদিন সেই ল্যাবে ঘটনাক্রমে একাকী আসে স্কুলেরই এক ছাত্রী। এবং, দুর্ভাগ্যবশত সে ওই ইঁদুরের কামড় খায়। মুহূর্তেই ইউহসান হাই স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে সেই হরমোন থেকে সৃষ্ট জোহান ভাইরাস। 

ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর আতংক; Image Source: collider.com

তারপর কী হয়? জোহান ভাইরাসে কি স্কুলের সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়? যদি হয়, তাদের দেহে কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়? আর যদি আক্রান্ত না হয়, তবে কেন হয় না? শেষ পর্যন্ত জয় হয় কার- মানুষের, না ভাইরাসের? নাকি উভয়ের?

বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ছাত্রদের প্রতিরোধ; Image Source: screenrant.com

প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে আপনাকে দেখতে হবে ‘অল অব আস আর ডেড’ সিরিজটি। প্রশ্নগুলোর উত্তরের পাশাপাশি টিভি স্ক্রিনে আপনি দেখবেন প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ, বিচ্ছেদ, বেইমানি, বন্ধুত্ব, রাজনীতি, কর্তব্যবোধ আর বিজ্ঞানের মহাসম্মেলন। জানতে পারবেন, মানুষের সাধারণ সূত্র হলো- ভীতু মানুষরা স্বার্থপর হয়, বা স্বার্থপর মানুষরা ভীতু হয়। 

কিন্তু, পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা এই সূত্রের ঊর্ধ্বে। হতে পারে তারা ভীতু, কিন্তু স্বার্থপর নয়। বা স্বার্থপর, কিন্তু ভীতু নয়। কিংবা এ দুটোর কোনোটিই নয়। এবং অর্জন করবেন জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা: বাঁচার অর্থই হলো সংগ্রাম করা! 

এই লেখা পড়ে কারো এমন মনে হওয়া অমূলক নয় যে- এই লেখায় ধান ভানার চেয়ে শিবের গীত গাওয়া হয়েছে বেশি। তবে লেখকের পক্ষ থেকে কৈফিয়ত হলো: এর চেয়ে বেশি ধান ভানতে গেলে তা হয়ে হয়ে যেত স্পয়লার। আর একটা সিরিজের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কাহিনী পড়ার চেয়ে টিভি স্ক্রিনে দেখাটা বেশি উপভোগ্য!

Language: bangla

Topic: This article is a review about the series 'All of Us Are Dead'. 

Featured Image Source:  Screenrant.com

Related Articles

Exit mobile version