দক্ষিণ কোরীয় পরিচালক লী চ্যাং-ডংকে বলা হয় সিনেমার গ্রেট পোয়েট অফ ডিজাপয়েন্টমেন্ট। পরিচালনায় আসার পূর্বে তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক এবং ঔপন্যাসিক। ব্যক্তিগত সুখবোধ এবং পরিতৃপ্তি অর্জনের পথে সমকালীন দক্ষিণ কোরীয় সমাজের লোকজন তাদের চিরকালীন নীতি প্রথার সাথে যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাত অনুভব করে, সেই দ্বন্দ্বই তার সিনেমাসমূহের মূল উপজীব্য। ফলে তার সিনেমায় বার বার ঘুরে-ফিরে আসে নৈতিকতা, ন্যায়পরায়ণতার মতো ব্যাপারগুলো। লেখালেখি বা সিনেমা, উভয় শিল্পকেই তিনি দেখেন যোগাযোগ এবং অনুসন্ধানের মাধ্যম হিসেবে। এসবের মাধ্যমে তিনি ঐসকল লোকজনের সাথে যোগাযোগ করেন, যাদের নাম তিনি জানেন না; অনুসন্ধান করেন নবতর পরিবেশ বা প্রতিবেশের। সিক্রেট সানশাইন (২০০৭) বা পোয়েট্রি (২০১০)-এর মতো সাম্প্রতিক সিনেমাগুলোতে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে তিনি গভীর দৃষ্টিতে অবলোকন করেছেন মনোবিজ্ঞানের রহস্যময়তা এবং মানুষের আচার-আচরণের প্রত্যয়কে। এবং নিজ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পটভূমির বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করেছেন এগুলোর যথার্থতা।
আজ আমরা পর্যালোচনা করব ‘পেপারমিন্ট ক্যান্ডি’ সিনেমা নিয়ে। এর মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ান লী। একে তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বললে একটুও অত্যুক্তি করা হবে না। কারণ, ১৯৯৯ সালে নির্মিত এই সিনেমার মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক আর্ট ফিল্ম মানচিত্রে স্থান করে নেন তিনি, পান অঁতরের মর্যাদা। এখানে লী দৃষ্টিনিবদ্ধ করেন ইতিহাস এবং সমাজের উপর। একে আবার ন্যাশনাল সিনেমার একটি মডেলও বলা চলে, যেখানে গল্পের মূল চরিত্রের কাহিনীর মাধ্যমে দৃষ্টিপাত করা হয় বিগত দুই দশকের দক্ষিণ কোরীয় সমাজের উপর। নতুন সহস্রাব্দের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তার দেশ যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হওয়ার উৎসব উৎযাপনের, ঠিক তখনই লী তার দর্শকদের স্মরণ করিয়ে দেন— যুদ্ধপরবর্তী সামরিক শাসন এবং নিগ্রহের ইতিহাস সহসাই মুছে যাওয়ার নয়।
ফিল্মমেকিংয়ের ব্যাকরণ মেনে পেপারমিন্ট ক্যান্ডিতে লী তার উদ্ভাবনী চিন্তার সবচেয়ে সুষ্ঠু প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। সিনেমার স্ট্রাকচারের ক্ষেত্রে তিনি শরণাপন্ন হয়েছেন বিট্রেয়াল নামক ১৯৭৮ সালের একটি নাটকের। হ্যারল্ড পিন্টারের এই নাটকের মূল বিষয়বস্তু বিবাহবিচ্ছেদ, যেখানে শুরুতেই এক দম্পতির বিচ্ছেদের দৃশ্য মঞ্চায়িত হয়। পরবর্তীতে যে দৃশ্যগুলো দর্শকেরা দেখতে পায় সেগুলোর সবই অতীতের। প্রতিটি দৃশ্য ইতিমধ্যে প্রদর্শিত ক্লাইম্যাক্সের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে। ফলে দর্শক নাটকের শেষে কী ঘটবে সেটি নিয়ে ভাবিত না হয়ে বরং ঠিক কোন ঘটনার ফলে নাটকের দম্পতির ছাড়াছাড়ি হয় তার দিকে মনোযোগী হয়। পুরো নাটকজুড়ে বিরাজ করে প্রবল যাতনা এবং নিয়তির কাছে পরাজিত হওয়ার মর্মন্তুদ আবহ।
সিনেমার প্রারম্ভে ১৯৯৯ সালের বসন্তে কিম ইয়ং-হোকে (সল কিয়ং-গু) আমরা দেখতে পাই একটি ইয়ুথ ক্লাবের ২০ তম রিইউনিয়নে। ক্ষ্যাপা এবং উন্মত্ত অবস্থায় স্খলিতপদে সে যোগ দেয় তার পুরনো বন্ধুদের সাথে। অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পরও তার মাঝে স্থবিরতার লেশমাত্র দেখা যায় না, মিশতে পারে না কারো সাথে। বরং খানিক পরেই তাকে আমরা আবিষ্কার করি ক্রমশ কাছে আসতে থাকা একটি ট্রেনের সামনে। সঞ্চরণশীল যানটি যখন তাকে পিষে ফেলবে, ঠিক তখন হঠাৎ করে কিমের মুখের উপর স্ক্রিন ফ্রিজ হয়ে যায়। এবং সে চিৎকার করে বলে উঠে, “আমি আবার ফিরে যেতে চাই!”
কিম অতীতে ফিরে যেতে চায়, আর লীও ঠিক সেই কাজই করেন। গোটা সিনেমায় আমরাও ফিরে যাই তার জীবনের বিগত ২০ বছরের ঘটনায়। আর নির্ণয় করার চেষ্টা করি ঠিক কী কারণে আত্মহত্যার পথে পা বাড়ালো কিম। ট্রেন এখানে ব্যবহৃত হয়েছে রূপক হিসেবে। প্রত্যেকটি ফ্ল্যাশব্যাক শুরু হয়েছে ট্রেনের পেছন থেকে শ্যুট করা শটের মাধ্যমে। এবং একে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে মনে হয়— ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছে আর আশপাশের সবকিছু পিছিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে যেন প্রগতি বা উন্নয়নের ব্যাপারে লীর মনোভাবও ফুটে ওঠে। এছাড়া রেলগাড়ি যেমন একটি সরলপথে চলে, তেমনি কিমের ভাগ্যেরও গন্তব্য একটাই। প্রত্যেকটি ফ্ল্যাশব্যাকই তাকে জীবনের করাল সমাপ্তির দিকে এক ধাপ এগিয়ে দেয়। এতে পরিবর্তন আসার কোনো সুযোগ নেই। এসব ফ্ল্যাশব্যাকের প্রত্যেকটি আবার দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর টাইমলাইনের সাথে মিলে যায়।
পরবর্তী সিকোয়েন্সে, অর্থাৎ প্রথম ফ্ল্যাশব্যাকে আমরা উপনীত হই রিইউনিয়নের তিন দিন আগে। এ সময় আইএমএফ ক্রাইসিস হয় এবং এশীয় অর্থনীতিতে নেমে আসে মন্দাভাব। তার দেশের মতো কিমের অবস্থাও বিপর্যস্ত। পরিবার, সহায়-সম্পদ হারিয়ে সে যখন সবকিছু শেষ করে দেবে ভাবে, ঠিক তখনই এক লোক আসে তার সাথে দেখা করতে। তার আগমনের ফলে কিমের জীবন কোনদিকে মোড় নেয়, কী হয় তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, তা-ই দেখানো হয়েছে এই অংশে।
দ্বিতীয় ফ্ল্যাশব্যাকের সময় ১৯৯৪, যখন তার দেশ অর্থনৈতিক উন্নতির তুঙ্গে অবস্থান করছে। এ সময়ে কিমের পেশা ফার্নিচারের ব্যবসা। নিজের পেশার পাশাপাশি হৃদয়ের ব্যাপারেও সে যে একজন পুরোদস্তুর ক্যাপিটালিস্ট, তা ফুটে ওঠে এই অংশে। এছাড়া, নিজের স্ত্রীর প্রতি আচরণে তার চরিত্রের দ্বিমুখীভাবও ফুটে ওঠে এখানে। আর দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেক্ষাপটে এই সময়টি রাজনৈতিক পালাবদলের, ৩০ বছরের মিলিটারি রাজে এক স্বৈরাচারীর পতনের পর অন্য স্বৈরশাসক আসার অপেক্ষায় ইতিহাস। অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি এ সময় আসে নবতর স্বাধীনতাও। কিন্তু লী এই ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ, তার মতে এই দেশ জনগণের উপর এতটাই জুলুম আর অত্যাচার করেছে যে জনগণ নতুন পাওয়া অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং স্বাধীনতার ব্যবহার কীভাবে করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। আর নির্বোধের মতো ভোগবাদে মজে যাওয়া বা দমিত আকাঙ্ক্ষার প্রশমনও এ ব্যাপারে খুব একটা সহায়তা করতে পারে না।
এরপর পেপারমিন্ট ক্যান্ডি আমাদেরকে নিয়ে যায় ১৯৮৭ সালে, যখন মিছিল-মিটিং-প্রতিবাদে উত্তাল দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল। কারণ জেনারেল রোহ তে-উ ক্ষমতাসীন দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন, ১৯৮০ সালে গণহত্যার আদেশ দিয়ে নিজের হাত রক্তে রঞ্জিত করেছেন যিনি। এ সময়ে কিম ছিল পুলিশের সদস্য। উপরমহলের আদেশে আন্দোলনকারীদের উপর পাশবিক অত্যাচার করা ছাড়া তার মাঝে আর কোনো উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি না আমরা। তার এই পাশবিকতা সংসারজীবনেও বিস্তৃতি লাভ করে। সে বেশিরভাগ সময়ই কাটায় তার পুলিশ বন্ধুদের সাথে, এবং গোপনে কামনা করে সুন-ইমকে, যে ছিল তার প্রথম এবং একমাত্র সত্যিকারের ভালোবাসা।
পরবর্তী তিনটি ফ্ল্যাশব্যাকের সময় যথাক্রমে ১৯৮৪, যখন তার বাধ্যতামূলক মিলিটারি সার্ভিস শেষ হয়; ১৯৮০, এ সময়ে মিলিটারিতে থাকা অবস্থায় গুয়ানজু গণহত্যার সময়ে তার ভূমিকা দেখানো হয়; এবং ১৯৭৯, যখন তার সাথে সুন-ইমের প্রথম দেখা হয়। ফ্ল্যাশব্যাকসমূহে লী পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্লু এবং হিন্ট দেন দর্শককে, যাতে তারা নিজেদের মতো করে কিমের জীবনের সমাপ্তির কারণ খুঁজে নিতে পারে। শেষের তিনটি টাইম পিরিয়ড সুন-ইমের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে তার যে ধারণা; সেটা জটিল করে তোলে। প্রথমে তাদের সম্পর্ককে যেরকম মনে হয়েছিল, সিনেমার শেষে সেরকম আর মনে হয় না। এমনকি সিনেমার নাম এবং প্রেমিকার সাথে সম্পর্কিত যে পেপারমিন্ট ক্যান্ডি, সেটাও নতুন আঙ্গিকে, অনেক কম নস্টালজিক রূপে ধরা দেয়। আর্মিতে থাকাকালীন কিম তার মনুষ্যত্ব ও সরলতা হারায় আর অর্জন করে হিংস্রতা, কপটতা এবং নির্মমতা। যতক্ষণে তরুণ কিমকে সলজ্জভাবে আমরা গান গাইতে দেখি, ততক্ষণে আমরা এটা বুঝে যাই যে তার চরিত্রের ধ্বংস সম্পূর্ণ হয়েছে।
পেপারমিন্ট ক্যান্ডি দেখতে হলে আপনাকে অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে হবে। কেননা, এখানকার দৃশ্যাবলী আপনাকে পুলকিত করবে না। মানসিক ও শারীরিক, উভয় প্রকারের নির্মমতাকে লী দেখিয়েছেন স্পষ্টভাবে, কোনো লুকোছাপা না করে। তার ক্যামেরা সঠিকভাবে খুঁজে নিয়েছে শহুরে যান্ত্রিক জীবনের অবশিষ্টাংশ। কিম ইয়ং-হো পছন্দনীয় কোনো ক্যারেক্টার নয়, বাস্তব জীবনে দেখলে হয়তো আমরা তার থেকে তফাতেই থাকব। কিন্তু লী আমাদের তার মনস্তত্ত্ব বুঝতে সহায়তা করেন। যেসব বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ কারণে সে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে তা উপস্থাপন করেন। এরপর দক্ষ নির্মাণ কৌশলের মাধ্যমে তাকে পছন্দ-অপছন্দ করার বা তার অমোঘ নিয়তির কারণ নির্ধারণের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন দর্শকের উপর।
পেপারমিন্ট ক্যান্ডিতে প্রকাশিত হয়েছে লীর শিল্পীসত্তার দৃঢ়তা, রাগ এবং মমত্ববোধ। সাউথ কোরিয়ান নিউ ওয়েভের সাথে পরিচিত হতে এই সিনেমার জুড়ি মেলা ভার। তাই সময় করে পাঠক দেখে নিতে পারেন কোরিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই চলচ্চিত্র।