আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোকে প্রতিফলিত করে যে ক’টি অসামান্য আত্মজৈবনিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে তার মধ্যে পান্না কায়সারের ‘মুক্তিযুদ্ধ: আগে ও পরে’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে জাতির যে সব সূর্যসন্তানদের আমরা হারিয়েছি, পান্না কায়সার ছিলেন তাদেরই একজনের স্ত্রী। নিজের শৈশব থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে প্রিয়জন হারানোর বেদনা ভারাক্রান্ত দিনগুলো বইটিতে গভীর অনুভবে বর্ণনা করেছেন তিনি।
পান্না কায়সার ছিলেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী। শহীদুল্লা কায়সারের অনুজ সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকেও খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তার। কাজেই কেবল একটি আত্মস্মৃতিমূলক রচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে দুইজন মহান মানুষকে ধারণ করে বইটি বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করেছে।
সংস্কারহীন উদার পরিবারে পান্না কায়সারের জন্ম। তার বাবা মোসলেহ্উদ্দীন চৌধুরী নারী শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী হলেও চারপাশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশ শিক্ষার পক্ষে অনুকূল ছিল না। এর মাঝে একান্ত মনের জোরে এবং পিতার উৎসাহে নিজেদেরকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তুলতে লাগলেন তারা ছয় বোন দুই ভাই। তার পিতা উদারহস্তে নিজের সব সহায়-সম্পত্তি গ্রামের উন্নয়নে ব্যয় করে ফেললেন। ফলশ্রুতিতে আর্থিক অনটন তাদের শৈশবের দিনগুলোতে নিত্যসঙ্গী ছিল। বইয়ের শুরুতেই লেখিকা তার জীবনের সূচনা পর্বের দিনগুলোর কথা বর্ণনা করেছেন। বলেছেন তার মাইজভাণ্ডারের ভক্ত ঋষি বাবার কথা,
“এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে বাবার আরেকটা দুঃসাহসী কাজের কথা। বাবা গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে আমাদের পূর্বপুরুষের কবরের স্থানে গজল- ভজন গেয়ে বেড়াতেন। মোল্লারা এবং মুরব্বিরা ক্ষেপে বাবার হারমোনিয়াম ভাঙতে এসেছিল। কিন্তু বাবার দৃষ্টি আর ব্যক্তিত্বের সামনে ওরা বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না। বাবা বলতেন, “পূর্বপুরুষরা তো সব সময় দোয়া- দরুদ শোনেন। মাঝে মাঝে গান শুনলে ওঁদের মন ভাল থাকবে। ওঁরা আনন্দ পাবেন।”
এরই মাঝে কলেজে পড়ার সময় তার জীবনে এক ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। মেজ বোনের একান্ত আগ্রহে এবং লেখাপড়াকালীন অর্থাভাব দূর করতে তাকে ঢাকা শহরের এক উচ্চবিত্ত পরিবারে বিয়ে দেওয়া হয়। সেই বিয়ে তার জীবনকে দুর্বিষহ করে দেয়। নপুংসক স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির অমানবিক পরিবেশ থেকে শুধুমাত্র তীব্র মানসিক জোরের বলে তিনি বের হয়ে আসতে সক্ষম হন। সব ধরনের বাধা বিপত্তিকে দূরে ঠেলে ফেলে পুনরায় পড়াশোনা শুরু করে এইচএসসি পাস করেন এবং কুমিল্লা মহিলা কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স পাস করেন। লেখিকা তার জীবনের এই অন্ধকার অধ্যায়টিকে নিঃসংকোচে বর্ণনা করেছেন তার এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থটিতে।
এদিক থেকে এটি শুধুমাত্র বেঁচে থাকার আত্মকথা নয়, বরং তীব্র মানসিক জোরে লড়াই করে এগিয়ে চলার গল্প। তাই এটি পড়ার সময় সব পাঠকের মাঝে, বিশেষ করে জীবন সংগ্রামে লড়াই করে চলা মেয়েদের মাঝে আত্মবিশ্বাস এবং সঞ্জীবনী শক্তি ছড়িয়ে পড়ে। বাঁচার মতো বাঁচতে গেলে কীভাবে লড়াই করে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় সেই বার্তা আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
অনার্স পাসের পর লেখিকা মেজ বোনের বাড়িতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স করেন। ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছেন, এমন সময় ঘটনাচক্রে তার সাথে পরিচয় ঘটে শহীদুল্লা কায়সারের। দেখা হওয়ার প্রথম দিনটি থেকে শুরু করে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত দিনগুলোর স্নিগ্ধ রোমান্টিক বর্ণনা আছে এই গ্রন্থটিতে। লেখিকা সরল সপ্রতিভ ভঙ্গিতে তার মনের উৎকণ্ঠা এবং ভাললাগার মুহূর্তগুলিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল এক দিনে কারফিউয়ের মাঝে বিয়ের দিনটির বর্ণনা দিয়েছেন লেখিকা এভাবে,
“সেদিনের ঢাকার রাজপথ নীরব নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে টহল পুলিশ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি। তবু আমার কাছে মনে হয়েছে এ বিকেল সোনাঝরা বিকেল। বাসন্তী বাতাস কৃষ্ণচূড়া ফুলের সৌরভ নিয়ে আনন্দলোকে আমাদের প্রবেশের পথকে কি মোহনীয় করে তুলেছে! গাড়ি থেকে নামতেই শাশুড়ি মা আমাকে আগলে ধরলেন। আনন্দে ওনার সমস্ত শরীর কাঁপছে, আমি বুঝতে পারছি। আমার কপালে- মুখে স্নেহচুম্বনের সুধা ঢেলে দিয়েও যেন তৃপ্ত নন। …অনাড়ম্বর এ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানও বলা যায় না। কোন আত্মীয় স্বজন নেই। হৈ চৈ নেই। গান বাজনা নেই। চারদিক নীরব নিস্তব্ধ! অথচ আমার মনে ঘুঙুর বেজে যাচ্ছে। কোনো ফুল দিয়ে সাজানো ছিল না ঘর। অথচ মৃদু সুগন্ধ আমার অস্তিত্বে ছোঁয়া দেয়। বাড়ির সবাই আমাকে ঘিরে আছে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে লজ্জা ও ভয়ে বারবার কুঞ্চিত হচ্ছি।”
শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন একজন সৎ, মহান এবং নির্ভীক ব্যক্তিত্ব। তার সংস্পর্শে এসে লেখিকা তার পূর্ববর্তী জীবনের সব দুঃখ- বেদনা এবং দুঃসহ স্মৃতি মুছে ফেলতে সক্ষম হন৷ তাদের সুখী দাম্পত্যজীবনের নানা দিক, কায়েতটুলীতে যৌথ পরিবারের আনন্দময় দিনগুলো, শহীদুল্লা কায়সারের ব্যক্তিত্বময় উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখিকার মুগ্ধতা এবং জহির রায়হান ও শহীদুল্লা কায়সারের মাঝে ভ্রাতৃত্বের দৃঢ় বন্ধন উঠে এসেছে এই গ্রন্থটির মধ্যভাগে।
কিন্তু দু’বছর পেরুতে না পেরুতেই বাঙালি জাতির জীবনে মহাক্রান্তিকাল শুরু হয়ে যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতে শহীদুল্লা কায়সার ঢাকায় অবস্থান করে প্রাণপণে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে কাজ করেন। সেই দিনগুলোর বর্ণনা লেখিকা দিয়েছেন এভাবে,
“দেশের দুর্দিন, নিজের জীবন অনিশ্চিত, মৃত্যু যে কোন সময় ছোবল মারতে পারে। হাস্যোজ্জ্বল চঞ্চলপ্রাণ যে মানুষটি হাসতে ভুলে গিয়েছিল, সে মানুষটি আমার অগোচরে গ্রামে আমার মা আর বড় বোনের খবর নিত নিয়মিত। …অথচ এ ন’মাস শমী- অমির জন্য ঠিকমত দুধ দিতে চাইত না। আমি রাগ করলে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত— আমাদের সন্তানরা না খেয়ে মরবে না। একবার দু’বার দুধ খাওয়ালেই যথেষ্ট। দেশের কত শিশু ক্যাম্পে না খেয়ে মরছে, তাদের কথা একবার চিন্তা কর। ভাব, ওরাও তোমার সন্তান। এখানে বসেও ওদের জন্য অনেক কিছু করার আছে।
বাড়িতে ভাল খাবার-দাবার রান্না করতে দিত না। একটা তরকারি আর ডাল ছাড়া কিছু রান্না করা নিষেধ ছিল। …আমার ছেলে অমিতাভ মার্চ মাসে হয়েছে। দীর্ঘ ন’মাস ওকে একটা নতুন জামা পরতে দেয় নি। প্রয়োজনের বাইরে খরচ করা ওর কড়া নিষেধ ছিল।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় দীর্ঘ ন’মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ওষুধ, কাপড়চোপড় পৌঁছে দেওয়া সহ নানাভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন শহীদুল্লা কায়সার। এরপর যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে আসছে, বিজয়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন তিনি, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটল ভয়ংকর দুর্ঘটনাটি। বিপদের আশঙ্কা অনুভব করে ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সোভিয়েত দূতাবাসে আশ্রয় নিতে বাড়ি থেকে বের হলেও ঘণ্টাখানেক পরে বাড়ি ফিরে আসেন শহীদুল্লা কায়সার। কথা ছিল পরদিন ১৪ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ সোভিয়েত দূতাবাসে আশ্রয় গ্রহণ করবেন। কিন্তু সেদিন সারাদিন কারফিউ না ওঠায় বাড়ি থেকে তিনি আর বের হতে পারেননি। ঠিক সন্ধ্যাবেলায় তাদের কায়েতটুলীর বাড়িতে অকস্মাৎ এসে হাজির হয় রাজাকার- আল বদরের কতিপয় সদস্য। শহীদুল্লা কায়সারকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার নির্মম মুহূর্তটিকে লেখিকা বর্ণনা করেছেন এভাবে,
“আমার চিৎকার শুনে বারান্দার ওপাশের ঘর থেকে ননদ সাহানা দৌঁড়ে এসে বারান্দার বাতিটা জ্বালিয়ে দিল। ইতিমধ্যে ওকে ওরা টানতে টানতে সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। আমিও এক হাত ধরে ওকে টেনে ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ঘাতকরা বেয়নেটের নল দিয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল৷ আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। বেবী এসেও ওদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল। …বেবীকে ওরা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। বেবী পড়ে গেল ঠিকই, কিন্তু এক হাত দিয়ে ওর বড়দাকে তখনও ধরে রেখেছে। ওরা টানতে টানতে ওকে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যাবার সময় শহীদুল্লা আরো জোরে বোনের হাতটা ধরে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু পারল না, হাতটা ছুটে গেল। এ বাড়ির প্রিয় মানুষটিকে ওরা নিয়ে গেল। আমরা কেউ আটকাতে পারি নি।”
অবশেষে দু’দিন পরেই বিজয় এলো, কিন্তু প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষা আর ফুরোল না। হাসপাতাল থেকে রায়ের বাজার বধ্যভূমি অনবরত ছুটে বেড়ালেন পান্না কায়সার। দেশের সূর্যসন্তানদের হারানোর এই নির্মম ও নিষ্ঠুর মুহূর্তটি গভীর বেদনায় চিত্রিত করেছেন পান্না কায়সার। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই করুণতম গল্পটি প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
সময় কেটে যায়, শহীদুল্লা কায়সার আর ফেরেন না। স্বাধীন দেশে বড় ভাইয়ের সন্ধানে বের হয়ে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর এলাকা থেকে হারিয়ে যান জহির রায়হান। আরো এক শোকের পাহাড় বুকের ভেতর পাথর হয়ে চেপে বসে।
এই স্বজন হারানোর গভীর শোকের সাথে পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছে আরো এক নির্মম বেদনা। স্বাধীন বাংলাদেশে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমাঘোষণা এবং পরবর্তীতে দেশের রাজনীতিতে তাদের প্রতিষ্ঠিত হতে দেখায় লেখিকার কষ্ট পাঠককে স্পর্শ করে যায়।
এই গ্রন্থে পান্না কায়সারের জীবনযুদ্ধের গল্প ক্রমে এসে মিশে গেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে। দু’টি যুদ্ধ পরস্পরের সমার্থক হয়ে ওঠায় লেখিকা বইটির নামকরণ করেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ: আগে ও পরে।’ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের দুই প্রবাদ পুরুষের জীবনের নানা দিক এবং বাঙালির জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটিকে চিত্রিত করে এই আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি একটি ঐতিহাসিক মূল্য লাভ করেছে।
১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম প্রকাশিত এই গ্রন্থটির ভূমিকায় এ কথাই লিখেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান,
“পূর্বাপর যে ধারাবাহিকতা আছে এ বইতে, তা হলো পুরুষশাসিত বৈষম্যপীড়িত কুসংস্কারযুক্ত পরিবেশে এক নারীর সংগ্রামের কথা- যে সংগ্রাম একপর্যায়ে এসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের পরেও যে সংগ্রামের শেষ হয় নি।”
এটি পান্না কায়সারের লেখা প্রথম বই হলেও, লেখিকার অনুভবসমৃদ্ধ প্রাঞ্জল বর্ণনাভঙ্গি এটিকে অনন্য রূপদান করেছে। একবার শুরু করলে তাই বইটি শেষ না করে ওঠার কোন উপায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর এক হৃদয়গ্রাহী আখ্যান ধারণ করে এ বইটি ‘ঐতিহাসিক’ তো বটেই, একই সাথে প্রবল অনুপ্রেরণার।
বইটি অনলাইনে কিনতে ক্লিক করুন এখানে- https://rb.gy/z8n6ij