বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ি রাস্তায় টহলরত একদল পুলিশ, সাথে সার্ভিস জীপ। পাশে চাওমিনে নাস্তা সেরে নিচ্ছেন রিমতিক পুলিশ স্টেশনের অফিসার সায়ন বোস। এ সময় থানা থেকে ফোনকলে জানাল, রাস্তার পাশের এক বাড়ি থেকে কোনো এক মহিলার চিৎকার কানে আসায় প্রতিবেশী কেউ থানায় বিষয়টি জানিয়েছে। ঐ বাড়িতে কী হয়েছে তা গিয়ে দেখে আসতে হবে। কেউ কি বিপদে পড়েছে নাকি অন্য রহস্য সেটি নিশ্চিত হতে সায়ন বোস চাওমিনের প্লেট সমেত জীপে চড়ে বসলেন ব্যাপারটি দেখে আসার জন্য। এরপর ড. প্রশান্ত চৌধুরীর বাড়ির কাছে আসা মাত্র নিজেও শুনলেন কারো চিৎকার ভেসে আসার আওয়াজ। দর্শকের জনরা আগে থেকে না জানা থাকলেও এতটুকু দেখার পর নিশ্চয়ই বুঝে ফেলার কথা যে ‘খোঁজ’ থ্রিলার ঘরানার ফিল্ম। যাকগে, অতঃপর সায়ন বাড়ির আশেপাশে খোঁজ করে জানতে পারে- এ বাড়ি থেকে মাঝে মাঝেই তারা এক নারীকণ্ঠের চিৎকার শুনতে পায়। কিছুক্ষণ বাদে চিৎকার আবার থেমেও যায়। অথচ তাকে প্রতিবেশী কেউই অনেকদিন থেকে দেখেনি।
I was just pushing an injection.
Things are all fine, inspector!
পরিচালক হিসেবে এটি অর্ক গাঙ্গুলির প্রথম সিনেমা হলেও সেটার কোনো অনভিজ্ঞতার ছাপ তিনি এতে পড়তে দেননি। প্লট বর্ণনায় বেছে নিয়েছেন বৃষ্টিভেজা ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘে মোড়া রূপকথার রাজ্যের মতো এক শহর। খোঁজের টান টান উত্তেজনাময় গল্পের চিত্রনাট্যে জমজমাট থ্রিলারের মশলার সাথে রয়েছে মানানসই আবহসংগীত। শব্দ ব্যবহারে যেমন মাধুর্য রয়েছে, তেমনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিটেইলিংয়ে রয়েছে যত্নের ছোঁয়া। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- লাশের পাশে পোকামাকড় উড়ে বেড়ানোর শব্দ দিয়ে অদেখাকে দেখানো গেছে। একইসাথে সিনেমার দৃশ্যগ্রহণও চমকে দেবার মতো! বাংলা ছবিতে পাহাড়ের প্রান্ত ঘেঁষা মনোরম এমন সব লোকেশন— মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশা, রোদ যেভাবে রিপন চৌধুরী তার ক্যামেরায় ধরেছেন তা সত্যিই শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর। দর্শক হিসেবেও দেখার জন্য বেশ স্বস্তিদায়ক হবার কথা ছিল। কিন্তু থ্রিলারের কাজটি যে ঠিক তার উল্টো! মানে সাসপেন্স আর অস্বস্তির পারস্পরিক যোগসাজশ সৃষ্টি। সেদিক থেকেও সফল নির্মাতা ও তার টিম। কারণ, ছোটখাট কিছু ত্রুটি বাদ দিলে রহস্যঘেরা গা-শিরশিরে থ্রিলারের জন্য আদর্শ আবহ সৃষ্টি করে নির্মাতা তা ধরে রাখতে পেরেছেন শেষ অবধি।
খোঁজের সিনেমাটোগ্রাফিক ভাষা খুবই শৈল্পিক এবং অর্থবহ। ডাক্তার প্রশান্তের স্ত্রী জোনাকির বান্ধবী রোজের সাথে ডাক্তারের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্যধারণে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের আভাস সিনেমাটোগ্রাফিতেই দেয়া ছিল। একইভাবে আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা কিংবা পাইন বনের মৃদু আলোয় লাশ খুঁজতে যাবার দৃশ্য শৈল্পিকতায় মুগ্ধ করেছে! আগুনে পোড়া লাশের দৃশ্যতে এক অ্যাঙ্গেলে উঁচু ঢিবি দেখিয়ে দর্শকদের জানিয়ে দিয়েছে- কত কাছেই না ছিল তাদের খুঁজে ফেরা জোনাকির সন্ধান। অবশ্য এখানে কৃতিত্ব আরেকজনেরও প্রাপ্য। যেহেতু চিত্রসম্পাদকের ভূমিকার কারণেই চিত্রগ্রাহকের পারদর্শিতা এখানে এতটুকু ম্লান হতে পারেনি। বরং তা আরও বেশি আলো ছড়িয়েছে। সর্বোপরি, শুরু থেকে শেষপর্যন্ত অসাধারণ সমন্বয় ধরে রেখেছে টেকনিক্যাল প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট।
প্রটাগনিস্ট সায়ন বোস এবং ড. প্রশান্ত চৌধুরী নিজেদের চরিত্র চমৎকারভাবে তুলে ধরলেও এক্ষেত্রে অফিসার সায়নকে সামান্য পিছিয়ে রাখব অবশ্য। সূক্ষ্মভাবে দেখলে কিছুটা জড়তা, কিছুটা আত্মবিশ্বাসহীনতা, আর মাঝে মাঝে অসহায় হয়ে পড়ায় চিত্রনাট্যের সাথে অভিনয়ের বোঝাপড়ার একটা ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার প্রয়োজনমাফিক অভিব্যক্তির অভাব চোখে পড়েছে। চিত্রনাট্যে ডাক্তার প্রশান্তের একটি দৃশ্যের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বক্তব্য প্রযোজ্য। চিত্রনাট্যকে একটু বাস্তবিকভাবে যদি ভেবে দেখি, তাহলে শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করার ঠিক পরের দিনই রক্তাক্ত জামায় ঐ অবস্থায় কেউ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে পারে কি? তদ্রুপভাবে, যিনি মূল সন্দেহভাজন, তার ওপর অফিসারের একটু বেশিই নির্ভরশীল হওয়া হয়তো খানিকটা দৃষ্টিকটু। তবে অপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রোজ এবং জীভন এদিক থেকে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল। তারা তাদের প্ল্যানমাফিক কীভাবে অগ্রসর হতে হবে, কীভাবে ডাক্তার পরিবারকে বিপদে ফেলতে হবে তার ছক কষে রেখেছে নিখুঁতভাবে।
থ্রিলার ছবি হিসেবে গল্পের শুরুতে দর্শককে একজনের উপর সন্দেহ চাপিয়ে দিয়ে এরপর আস্তে আস্তে তার ওপর থেকে সন্দেহ অন্যদিকে সরিয়ে নেবার মুন্সিয়ানা ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে দুর্দান্ত লেগেছে। এ মুগ্ধতা আরও বেড়েছে ক্রমাগত গল্প একদম ভিন্ন বাঁকে একেবারে ১৮০ ডিগ্রীতে ঘুরিয়ে দেয়াতে। শুরু থেকে থ্রিল ছিল, পূর্বানুমান করতে পারার মতো পর্যাপ্ত ক্লুও দেয়া ছিল, এবং গল্পের মোড় সেদিকেই ঘুরছিল। এতে দর্শক হিসেবে গল্পের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে ভালোই সুবিধে হয়েছে। যদিও গল্পের পরিণতি অনুমেয় হয়ে যাবার একটা শঙ্কাও উঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু এখানেই খেলা জমিয়ে দিয়ে যাবতীয় রসদের সবটাই প্রয়োগ করে উঁকি দেয়া শঙ্কাকে বুড়ো আঙুল দেখায় খোঁজ। যার খোঁজে এই গল্প, সেই জোনাকির নিঃশেষ হয়ে যাবার অধ্যায় এমন সহজে পড়ে ফেলা গেলে কী আর চলে! রহস্য তো তবে আর জমলোই না। এত সহজেই সব রহস্য সমাধান হয়ে যাবার মধ্যে কোথাও যে একটা খটকা আছে তা আঁচ করতে পারে অফিসার সায়ন বোসও। অথচ তার আঁচ করা ধারণাও আবার স্পষ্ট নয়। কারণ, হাতে নেই প্রমাণ বা সন্দেহ করার মতো অপরাধীর ফেলে যাওয়া ভুলের কোনো চিহ্ন। রোজ কীভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল দর্শক তা ভাবতে ভাবতেই শুরু হয় ফ্ল্যাশব্যাক। এবার পর্দার এ পাশে অডিয়েন্স সারিতে বসে সত্যি সত্যি ভিমড়ি খাবার পালা। আরে, যেমনটা ভাবছিলাম তেমন তো নয়! পাহাড়ি রাস্তায় সরলরৈখিক ভাবনা চলে না সেটাই যেন দৃশ্যমান করতে চাইল অর্ক গাঙ্গুলির ডেব্যু ফিল্ম।
শেষ চমকটি কেবল বাকি তখন। ততক্ষণে আমরা, মানে দর্শকরা, ফ্ল্যাশব্যাক থেকে পেয়ে গেছি গল্পের খোঁজ। কিন্তু অফিসার সায়ন বোস তখনও জানে না আমাদের জেনে যাওয়া গল্প। একরাশ হতাশা মাখা পিনপতন নীরবতা নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে কী হবে তা দেখার অপেক্ষা শুধু। মনে মনে একটাই চাওয়া— যেন জোনাকির সন্ধান সায়নও পেয়ে যায়। এদিকে যৎসামান্য আলোয় জোনাকির বাঁচার আকুতি গ্রাস করতে শুরু করছে ততক্ষণে। শেষে কী হতে চলেছে তবে! সত্যিই কি খোঁজ মিলবে? নাকি খোঁজের গল্পে চিরতরে নিখোঁজ হবে ডাক্তারের হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী? এমনই এক ম্যাজিক মোমেন্টে এসে গল্পের আনুষ্ঠানিক ইতি টেনে শেষে আক্ষেপ বাড়িয়েছেন অর্ক গাঙ্গুলি। রহস্য সমাধানের দ্বারপ্রান্তে এসে দুদিকে সমান সংশয় এবং সম্ভাবনা জাগিয়ে প্রশ্ন করেছেন দর্শককে। কেননা, অমীমাংসিত রহস্যের চিত্রনাট্য সম্পন্নের দায়িত্ব যে এখন দর্শকের ওপরই বর্তায়।
Sweetheart, I see a sun beam swinging in your eyes.
Sweetheart, does a swan sing just before she dies?