“অতীতকে মুছে ফেলার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে স্থান পাল্টানো।”
অতীত নিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই উক্তিটি কম-বেশি আমরা অনেকেই জানি। বাস্তবিকভাবেও স্থান বদলানো হলে অতীত মুছে যেতে পারে, কিন্তু বদলে যায় না। মানুষ চায় অতীতকে ভুলে যেতে, তাকে বদলে দিতে। তবে অতীতকে বদলানো যায় না, নিজেকে বদলানো যায়। অতীতকে মুছে ফেললে কিংবা ভুলে গেলেও শেষ রক্ষা হয় না। অতীত পাপের অনুশোচনার তীরে বিদ্ধ হয়ে করতে হয় প্রায়শ্চিত্ত, যার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে বর্তমানের। ‘জলেশ্বরী’ উপন্যাসে লেখক ওবায়েদ হক প্রায়শ্চিত্ত করা এক পিতার অতীতের মুখোমুখি করছেন তার সন্তানকে।
ওবায়েদ হকের ‘জলেশ্বরী’ একটি সমকালীন উপন্যাস। যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত, মহামারি কবলিত এর জনপদের জীবন ধারা তুলে ধরেছেন। তিনি। পানিতে তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমি, মানুষের বাসস্থান, পানিতে ভাসমান মৃতদেহ, হাহাকার-কষ্টে জর্জরিত এক জনপদ। সেই নিমজ্জিত জনপদের উপর দিয়ে নৌকায় চেপে চলেছে আমেরিকা ফেরত কাজল। তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে উপন্যাসটি।
জলেশ্বরী নামে একটি গ্রাম আছে বগুড়াতে, অন্যটা চাঁদপুরে মেঘনা পাড়ে। অবশ্য গ্রামের মানুষ একে বলে জলছর। অগত্যা গন্তব্য জলেশ্বরী হলেও কাজলের লক্ষ্য এখন জলছর। মেঘনা পাড়ের এই গ্রাম থেকে খুঁজে বের করতে হবে কাল্পনিক ইব্রাহিম গাজীকে। সদ্যপ্রয়াত পিতার আলমারিতে কাজল সন্ধান পায় একটুকরো কাগজের, যাতে মোটা গাঢ় কালিতে লেখা,
“ইব্রাহিম গাজী, আর কত? জলেশ্বরী আর মেঘনাও তোমাকে গিলতে পারেনি! আমাকে কেন ঘুমাতে দাও না, আমি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লেই কি তুমি শান্তি পাবে?”
১৯৮৮ সালের ১২ জুলাই ছ’তলার ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছেন মাহাতাব ভূইয়া। পিতার মৃত্যুতে দীর্ঘ নয় বছর পর লস অ্যাঞ্জেলস থেকে দেশে আসে কাজল। পিতার আলমারিতে রহস্যময় কাগজটা পেয়ে ছায়ামানব ইব্রাহিম গাজীকে খুঁজতে জলেশ্বরীর উদ্দেশে যাত্রা করে সে।
বন্যার পানিতে নিমজ্জিত কষ্ট-হতাশার গ্রাম জলছরে একজন অভিযাত্রী কাজল। সঙ্গী হিসেবে দুই বাচাল মাঝি এবং সিন্দুকভর্তি টাকা। জলছরে সে আশা করেছিল ইব্রাহিম গাজীকে, কিন্তু তার বদলে পেয়েছে একরাশ হতাশা, গ্রামের মানুষের আগ্রাসী মনোভাব এবং দুঃখ-কষ্ট।
প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, খুইয়েছিলেন নবাবি, সাথে নিজের জীবনও। তবে দুই মাঝির বিশ্বাসঘাতকতায় কাজল সবকিছু হারালেও রক্ষা করতে পেরেছিল নিজের জীবন। অতঃপর লেখকের ভাষায়,
“লিয়াকত ও বজলু আমাকে খুন করতে পারেনি। মাঝির বংশ, এতটাও নিষ্ঠুর হতে পারেনি।”
তাই হয়তো তাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল প্রত্যন্ত এক চরে, অনাহার এবং ঠাণ্ডায় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে। কিন্তু আঁধারঘেরা অস্তিত্বে বিলীন হয়ে যায়নি কাজল। এ যাত্রায় তাকে সহায়তা করে তার মতোই এক হতভাগা তরুণী তাপশী। কাদামাটি থেকে তুলে নেয় উঁচু গাছের ডালে। সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে এক বেদে বহর।
বেশ দীর্ঘ এক বেদে জীবন কাটিয়ে নয়নখোলা বাজারে তাদের কাছ থেকে বিদায় নেয় কাজল। সুদীর্ঘ নিমজ্জিত এক পথ পাড়ি দিয়ে আবার যাত্রা করে জলছরের উদ্দেশে। বন্ধুর কাদামাটি পথ পেরিয়ে কাজল পৌঁছায় শিবপুর গ্রামে, যেখান থেকে জলছর অর্ধেক দিনের পথ। নিয়তির ভাঙা-গড়ার মিছিলে আবারও তাপশীর সাথে শিবপুরে দেখা হয় কাজলের। পিসেমশাইয়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত সামান্য চিকিৎসাজ্ঞান নিয়ে সে লড়ে যাচ্ছিল কলেরা এবং গ্রাম্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে কলেরায় আক্রান্ত হয় সে নিজেই। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা তাপশীকে নিয়ে কাজল রওনা হয় সদরের উদ্দেশে। তবে নিয়তির লিখন না যায় খণ্ডন। মাঝনদীতে ডাকাত আক্রমণ করে, আবারও প্রাণে বেঁচে যায় কাজল এবং তাপশী। কাজলকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাকাত সর্দার ‘মাস্টার’-এর কাছে। জলেশ্বরী খুঁজে পেলেও কাজল সন্ধান পায়নি কাঙ্ক্ষিত ইব্রাহিম গাজীর। মাস্টারের কাছে খোঁজ করেও ইব্রাহিম গাজীর সন্ধান পায়নি সে। তবে পেয়েছিল পুরাতন হলদে কাগজে লেখা একটা চিঠি।
“মানুষ নিজেকে বদলাতে পারে, কিন্তু অতীতকে বদলাতে পারে না। আরেকটা জিনিস সহজে বদলাতে পারে না, হাতের লেখা।”
সেই পুরাতন হলদে চিঠিটা ইব্রাহিম গাজীর অস্তিত্ব এবং প্রয়াত মাহাতাব ভূইয়ার রহস্যময় অতীতের জানান দেয়, যার প্রায়শ্চিত্ত তিনি করেছেন ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে।
‘জলেশ্বরী’ উপন্যাসটি লেখা হয়েছে ১৯৮৮ সালের বন্যাকে উপজীব্য করে। পুরো উপন্যাসে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন বন্যায় বিপর্যস্ত জনজীবন এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশা। স্পষ্ট করে দিয়েছেন পাঠ্যপুস্তকে পড়া সুজলা-সুফলা গ্রাম এবং অস্তিত্বের মিছিলে লড়াই করতে থাকা বাস্তবিক গ্রামের পার্থক্য। গ্রাম্য জনপদের চিকিৎসা সংকট, কুসংস্কার, বেদে সম্প্রদায়ের যাযাবর জীবন, বাংলার মানুষের অতিথিপরায়ণতা, অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায় জীবন সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। একীভূত করেছেন ইব্রাহিম গাজী এবং মাহাতাব ভূইয়ার দ্বৈত চরিত্রকে। কাজলকে দাঁড় করিয়েছেন মাস্টার এবং তার সর্দারের অতীত অস্তিত্বের সামনে।
ওবায়েদ হক তার লেখায় বারবার বিমোহিত করেছেন পাঠক সমাজকে। এক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। পুরো কাহিনী জুড়ে লেখক খুব সাবলীলভাবে এগিয়েছেন। অহেতুক কাহিনী লম্বা করেননি কোনো অংশেই। বইয়ের প্রত্যেকটি চরিত্রকে সুগঠিত এবং স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পুরো বই জুড়েই ছড়িয়ে গেছেন মুগ্ধতা, যা আলোড়িত করে পাঠকের হৃদয়। পুরো গল্পই লেখক স্বাভাবিক গতিতে ফুটিয়ে তুলেছে। তিনি পাঠককে বুঁদ করে রেখেছিলেন ইব্রাহিম গাজীর রহস্যে। মূল কাহিনীর সাথে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সুন্দর এক সংমিশ্রণ করেছেন। অহেতুক তাড়াহুড়ো পরিলক্ষিত হয়নি কোথাও।
বইটি সংগ্রহ করতে
বই: জলেশ্বরী
লেখক: ওবায়েদ হক
বিভাগ: উপন্যাস
প্রকাশনী: বায়ান্ন প্রকাশনী