পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রের ফ্যান্টাসি অনুধাবন করতে হলে জানতে হবে ইসলা ডি মুয়ের্তা নামের এক অভিশপ্ত দ্বীপের কথা। স্প্যানিশ এই শব্দটির অর্থ হলো মৃতের দ্বীপ- Island of the Dead। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এই দ্বীপের অবস্থান এবং কোনো মানচিত্রেই এর অবস্থান নেই। কতিপয় জলদস্যু ব্যতীত কেউই জানে না এই দ্বীপটির অস্তিত্বের কথা। এটি সম্বন্ধে জলদস্যুদের মাঝে বিভিন্ন গল্প-উপকথা প্রচলিত আছে। একটি উপকথা হলো এই দ্বীপে লুকানো আছে হেরনান কর্টেজ-এর অভিশপ্ত গুপ্তধন। তিনি কীভাবে এ ধন পেলেন এবং কেন এগুলো অভিশপ্ত হলো তার পেছনে কিছু কারণ আছে।
হেরনান কর্টেজ ছিলেন একজন শক্তিশালী স্প্যানিশ যোদ্ধা। যুদ্ধও করতেন আরো শক্তিশালী এই তলোয়ার নিয়ে। একসময় আক্রমণ করে বসেন অ্যাজটেক সাম্রাজ্যে। বর্তমান মেক্সিকোতে ছিল তৎকালীন অ্যাজটেক সাম্রাজ্য। তার জাদুকরী তলোয়ার এবং একদল সাহসী সৈন্য নিয়ে পরাজিত করে ফেলেন অ্যাজটেকদের। এতে তার নিজের দলের সৈন্যও মারা পড়ে বেশ। এতে তার রাগ উঠে যায়। রাগ এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে পরাজিতদের ধরে গণবলি দিতে উদ্যত হলেন। এমতাবস্থায় তাদের বাঁচানোর জন্য অ্যাজটেকরা তাকে ৮৮২টি স্বর্ণখণ্ড প্রদান করলেন। কিন্তু তাতে রাগ কমার বদলে আরো বেড়েছে, স্বর্ণ যেন তার আগুনে আরো ফুঁ দিয়েছিল।
তার এমন অবিবেচনাপ্রসূত রাগে ক্ষিপ্ত হলেন অ্যাজটেকদের দেবতা। তিনি অভিশাপ দিয়ে দিলেন সেই স্বর্ণখণ্ডগুলোর উপর। জীবিত কোনো মানুষ যদি এই স্বর্ণগুলো থেকে একটি খণ্ডও অপসারণ করে তাহলে সারা জীবনব্যাপী জঘন্য অভিশাপে অভিশপ্ত হবে। সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো তারা কখনো মরতে পারবে না। মরতে না পারা তথা যুগের পর যুগ বেঁচে থাকাকে প্রথম বিবেচনায় ভালো কিছু বলে মনে হতে পারে। কিন্তু অন্যান্য বিষয় যুক্ত হলে দেখা যাবে এটি জঘন্য শাস্তি ছাড়া মোটেও ভালো নয়।
যা খাবে সেগুলোর কোনোটিতেই খাবারের স্বাদ পাবে না। যা মুখে দেবে তাতেই চলে আসবে ছাইয়ের স্বাদ। জীবনভর তৃষ্ণার্ত ও পিপাসার্ত থেকে যাবে। কোনো শরবত, কোনো পানীয়তেই তৃষ্ণা মিটবে না। জগতের কোনো সঙ্গীই তাদের যৌনতার স্বাদ পূরণ করতে পারবে না। কোনো নারীর উষ্ণতাই তাদের তৃপ্ত করতে পারবে না। বাস্তবিক অর্থে বেঁচে থাকা ছাড়া কোনোকিছুই অনুভব করতে পারবে না। এমনকি পানির ফোঁটা এসে ত্বকে লাগলে কিংবা বাতাসের ঝাঁপটা এসে গায়ে লাগলেও তা অনুভব করতে পারবে না। ঠাণ্ডা লাগছে নাকি গরম লাগছে তার কিছুই বুঝতে পারবে না। রাতের বেলা তাদের স্বাভাবিক দেহও থাকে না। চাঁদের আলোতে নোংরা কংকাল সদৃশ তাদের আসল রূপ বের হয়ে আসে।
এভাবে দিন পার করতে করতে যখন তারা আর সইতে পারবে না, তখন মনেপ্রাণে মরতে চাইবে। কিন্তু চাইলেও আর মরতে পারবে না। তখন থেকে তারা আরেক তৃষ্ণায় ভুগবে, মৃত্যুর তৃষ্ণা। মনেপ্রাণে মৃত্যু চাইলেও মৃত্যু আর তাদেরকে সঙ্গ দিতে আসবে না। এভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী চলতেই থাকবে অভিশাপ।
তবে একটি উপায় আছে এ অভিশাপ থেকে বাঁচার। ৮৮২টি স্বর্ণখণ্ডের সবগুলো একত্র করে ঐ দ্বীপের একটি বিশেষ স্থানে নিয়ে গিয়ে মানুষের রক্ত উৎসর্গ করলে কেটে যাবে অভিশাপ। আবারো তারা ফিরে যেতে পারবে স্বাভাবিক জীবনে। পাবে খাবারের স্বাদ, মিটবে পানীয়ের তৃষ্ণা, আসবে যৌনতার তৃপ্তি এবং ধীরে ধীরে ঝুঁকবে মৃত্যু নামক আশীর্বাদের দিকে।
কিন্তু এ অভিশাপটিকে জলদস্যুরা একটি পৌরাণিক গল্প বা উপকথা হিসেবেই দেখে। তারা বিশ্বাস করে না এই স্বর্ণের মাঝে এমন অভিশাপ থাকতে পারে। তারা খুঁজে বেড়ায় এ স্বর্ণ কোথায় আছে এবং কীভাবে সেসবকে পাওয়া যাবে। এরকম বিশ্বাসে বিশ্বাসী একজন লোকের নাম হলো ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো। তিনিই এ সিরিজের নায়ক। এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতা জনি ডেপ। এরকম অদ্ভুত চরিত্র নিয়ে জনি ডেপের আরো কতগুলো চলচ্চিত্র আছে। অদ্ভুত চরিত্রগুলোতে তাকে খুব মানায়ও। এখানে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর অধীনে বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল একটি জাহাজ আছে, নাম ব্ল্যাক পার্ল। ব্ল্যাক পার্লকে নিয়ে ভিড়েছেন ইসলা ডি মুয়ের্তা দ্বীপে যেখানে লুকানো আছে গুপ্তধন।
কিন্তু সেখানে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে হেক্টর বারবোসা নামে এক বিদ্রোহী কর্মী। জ্যাক স্প্যারোকে ঐ দ্বীপে নির্বাসন দিয়ে গুপ্তধন ও অন্যান্য কর্মীদের নিয়ে চলে আসে বারবোসা। তখন অবৈধভাবে সে হয়ে যায় ক্যাপ্টেন। কিন্তু পরবর্তীতে তারা ঠিকই বুঝতে পারে যে অভিশাপ আসলেই আছে, গুপ্তধনটি নিয়ে আসা উচিৎ হয়নি। জাগতিক সবকিছুই তাদেরকে প্রশান্তি দিতে ব্যর্থ।
অভিশাপের ব্যাপ্তি নিয়ে আরো কাহিনী আছে। ক্যাপ্টেন বারবোসা যখন ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলো তখন জাহাজের সকলেই তাতে সমর্থন দিলো। শুধু দিলো না একজন, তার নাম বিল টার্নার। তাকে বুটস্ট্র্যাপ নামেও ডাকা হয়। তো তার বিরুদ্ধচারণ সফল না হওয়াতে সে চাইলো সকলের সাথে প্রতিশোধ নিতে। সে স্বর্ণ থেকে একটি খণ্ড তার ছেলে উইলিয়াম টার্নারের কাছে দিয়ে তাকে জাহাজ থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন।
নিয়ম অনুসারে সবগুলো স্বর্ণের খণ্ড একত্র করে রক্ত উৎসর্গ করলেই অভিশাপ সরে যাবে। কিন্তু বিল টার্নার যেহেতু তার ছেলের মাধ্যমে একটি খণ্ড সরিয়ে ফেলেছে তাই যতদিন সে খণ্ড পাওয়া না যাবে ততদিন পর্যন্ত অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে স্বর্ণখণ্ড। যদি ছেলেটিকে কোনোদিন না পায় তাহলে সারাজীবন অভিশপ্তই থেকে যেতে হবে। এভাবে সে তার বিপক্ষ দলের সকলকে সারাজীবন ব্যাপী শাস্তির মাঝে ঢুকিয়ে দিলো। ব্ল্যাক পার্ল নামের জাহাজের সকলেই অভিশপ্ত। এখান থেকেই চলচ্চিত্রের নাম এসেছে ব্ল্যাক পার্লের অভিশাপ- দ্য কার্স অব দ্য ব্ল্যাক পার্ল।
এদিকে বিল টার্নারের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে যায় ক্যাপ্টেন বারবোসা এবং তার কর্মীদল। রাগান্বিত হয়ে তাকে একটি কামানের অগ্রভাগে বেঁধে গোলা ফাটিয়ে উড়িয়ে দিলেন সমুদ্রের বুকে। কিন্তু সে-ও যেহেতু অভিশপ্ত তাই অভিশাপের কারণে এতে মৃত্যু হলো না তার। জীবিত অবস্থায় তলিয়ে গেল সাগরের বুকে। তলদেশের কর্দমাক্ত অন্ধকার পরিবেশে থাকতে হলো দিনের পর দিন। অক্সিজেনের অভাবে নিঃশ্বাসের কষ্ট পেতে হলো দিনের পর দিন। এগুলো পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান চলচ্চিত্রের আগের টাইমলাইনের ঘটনা।
এদিকে স্বর্ণ বিক্রি করে উল্লাস উন্মাদনা করে কাটানোর কিছুদিন পর যখন যখন তারা অনুধাবন করতে পারলো এসব আনন্দ ধীরে ধীরে মাটি ও ছাই হয়ে যাচ্ছে তখন তারা সবগুলো স্বর্ণ একত্র করতে লাগলো। যুদ্ধ, খুন, লুট ইত্যাদির মাধ্যমে সবগুলো খণ্ড সংগ্রহ করতে পারলেও একটি খণ্ড তখনো বাকি থেকে যায়। সে একটি হলো বিলের ছেলে উইলিয়ামের কাছে থাকা খণ্ডটি।
এদিকে কোনো এক উপায়ে দ্বীপ থেকে বের হয়ে এসেছে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো। জ্যাক স্প্যারোকে এমনভাবে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল যেন তার অবধারিত মৃত্যু হয়। এখানে বেঁচে থাকার মতো কিছু নেই, কোনো মানুষের যাতায়তও নেই, অন্তত হেক্টর বারবোসার তা-ই ধারণা। তাকে দিয়ে এসেছিল একটি পিস্তল এবং তাতে ছিল একটি মাত্র গুলি। পিস্তল দেবার কারণ, ক্ষুধায় যখন অসহ্য হয়ে যাবে তখন যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য যেন পিস্তলের একটি গুলি ব্যবহার করে নিজেকে মেরে এই যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার হতে পারে। জাহাজের কাপ্তানের জন্য এটি খুবই অপমানজনক ব্যাপার। এতে অপমানিত হয়েছেও জ্যাক স্প্যারো। সে এরপর থেকে সবসময় বয়ে চলেছে সে পিস্তল। ঐ গুলিটি খরচও করেনি কখনো। চরম বিপদের মুহূর্তেও ব্যবহার করেনি সেটি। গুলিটিকে যত্ন করে রেখে দিয়েছে একজনের জন্য। সে হলো ক্যাপ্টেন বারবোসা। এই গুলিটিকেই প্রবেশ করাতে চায় তার বিশ্বাসঘাতক ক্যাপ্টেন বারবোসার বুকে।
এদিকে ক্যাপ্টেন বারবোসা সন্ধান পেয়ে গেছে কোথায় আছে সেই সর্বশেষ খণ্ডটি। ঘটনার ক্রমে ঐ খণ্ডটির বাহক ছেলেটি বড় হয়ে গেছে অনেক। ঘটনাক্রমে সেই এলাকাতেই অবস্থান করছিলেন জ্যাক স্প্যারো। ঐ ছেলের সাথে দেখাও হয়ে গেছে তার।
একদিকে বারবোসা চায় স্বর্ণ ফিরিয়ে দিয়ে অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে আর অন্যদিকে জ্যাক স্প্যারোও চায় তার প্রতিশোধ নিতে। এর মাঝে পেঁচিয়ে গেছে উইলিয়াম টার্নার এবং তার ভালোবাসা নারীটি। সে নারীর সাথে পেঁচিয়েছে তার পরিবার। মেয়েটি রাজপরিবারের হওয়াতে জড়িয়ে গেছে পুরো রাজ পরিবার ও রাজ্যের সকল সৈন্য ও নাগরিক। এভাবে ঘটনা পরম্পরায় চমৎকার এক ফ্যান্টাসি গল্পের সৃষ্টি হয়েছে কার্স অব দ্য ব্ল্যাক পার্ল চলচ্চিত্রে।
গল্পের দিক থেকে বিবেচনা করলে বলতে হবে গল্প খুবই বিস্তৃত ও গভীর ছিল। অভিনয় এবং দস্যুদের সাজ সজ্জায় মুগ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। গল্পের ভিলেন ক্যাপ্টেন বারবোসার ভৌতিক চেহারা, ভৌতিক দাঁত, ভৌতিক কথাবার্তা সবচেয়ে চমৎকার ছিল এখানে।
চলচ্চিত্রে মূল্যবান দুটি চরিত্র হলো পিনটেল ও রাজেটি। তারা গুরুত্বপূর্ণ কোনো চরিত্রে নেই, কিন্তু সমস্ত সিনেমায় থেকে থেকে হাস্যরস যোগানোর মাধ্যমে সিনেমার উপভোগ্যতা আরো অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজেটির একটি চোখ নষ্ট। চোখের গোলক নড়েবড়ে, এটা ওটার সাথে লেগে লেগে কোটর থেকে বের হয়ে যায় বারবার। বের হলে খুঁজে খুঁজে বের করে সেটিকে এবং কাপড়ে কয়েকটি ঘষা দিয়ে এবং সামান্য থুতু দিয়ে আবার লাগিয়ে নেয় চোখের কোটরে।
সিনেমার পরবর্তী কাহিনী নিয়ে পরবর্তীতে আরো কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ৫টি চলচ্চিত্র বের হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো হবে। পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে আরো লেখা হবে পরবর্তীতে।
ফিচার ছবি- ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্স/MFoxes