ইংরেজি সাহিত্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের পরের আসনটি অনেক সাহিত্য সমালোচক বরাদ্দ করে রেখেছেন তার জন্য। ক্লাসিক্যাল ইংরেজিতে পাঠকের মনে তিনি তৈরি করেছেন জাদু আর মায়ার এক অপূর্ব মিশেল। এরকুল পোয়ারো, মিস মার্পলের মতো অনবদ্য চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। এই দুটি চরিত্রের কথা শুনলেই রহস্য আর অপরাধ ক্যাটাগরির পাঠকদের বুঝে ফেলার কথা, বলা হচ্ছিল আগাথা ক্রিস্টি সম্পর্কে। ব্যক্তিগত জীবনকে একান্ত ব্যক্তিগত রাখতেই পছন্দ করতেন তিনি।
গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তথ্যানুসারে আগাথা ক্রিস্টি বিশ্বের সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের লেখক এবং এক্ষেত্রে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারই কেবল তার সমকক্ষ। তার বিক্রয়কৃত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪,০০,০০,০০,০০০। শুধু তা-ই নয়, এ পর্যন্ত প্রায় ১০৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার বইগুলো। আজ তার ১২৭তম জন্মদিন। সেই উপলক্ষে তার ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি তথ্য সম্বলিত একটি কাল্পনিক সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো আজকের আয়োজনে।
আমি জানি, নিজের প্রচারণা আপনি একদম পছন্দ করেন না। আর এ কারণেই সারাজীবনে হাতেগোনা কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আপনি।
আমি প্রচারণা পছন্দ করিনা সেটা সত্যি। কিন্তু বিদেশি লেখক বা সমালোচকদের সাথে পরিচিত হতে ভালোই লাগে।
আপনার আত্মজীবনীতে লেখা আছে, নামের শেষ অংশটি, অর্থাৎ ক্রিস্টি, আপনার স্বামীর নাম থেকে নেয়া হয়েছে। উপন্যাসগুলোতে আগাথা ক্রিস্টি হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছেন আপনি। আপনার আসল নাম কী ছিল?
ঠিক করে বলতে গেলে, আমার প্রাক্তন স্বামীর নাম অনুযায়ী আমার নাম ক্রিস্টি। এ সম্পর্কে পরে বলছি। আমার আসল নাম আগাথা ম্যারি ক্ল্যারিসা মিলার। ১৮৯০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ পশ্চিম ইংল্যান্ডের ডেভোনে জন্ম হয় আমার।
আপনার ইংরেজি লেখা কিংবা কথা বলার ধরণে ব্রিটিশ টান খুব ভালো করেই বোঝা যায়! আমাদের মতো সাহিত্যিকদের ইংরেজিতে ভুল পেলে নিশ্চয়ই আপনি ঠিক করে দেবেন।
সেটা আমার জন্য খুব আনন্দের ব্যাপার হবে। আসলে আমি ইংরেজির মতো ফ্রেঞ্চ বলতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
ফ্রেঞ্চ ভাষার সাথে আপনার পরিচয় কীভাবে?
আমার বয়স যখন পাঁচ বছর, আমরা সপরিবারে তখন বেশ কিছুদিনের জন্য ফ্রান্সে চলে যাই। সেখানে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকি আমরা। আমার জন্য রাখা হয় একজন ফ্রেঞ্চ পরিচারিকা, তার নাম ছিল মেরি। ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই।
এটি কি সত্যি যে বয়স আট বছর না হওয়া পর্যন্ত আপনার বাবা-মা আপনাকে পড়ালেখা শুরু করতে দেয়নি?
এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি। কিন্তু সেই অভাবটা আমি আমার মতো করে পূরণ করে নিতে পেরেছি। পাঁচ বছর বয়সেই ছাপার অক্ষরের সাথে পরিচয় হয় আমার, এক্ষেত্রে ধন্যবাদের যোগ্য দাবীদার আমার ভাই-বোনরা। বাবা-মাকে লুকিয়ে তারাই আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। আর বাবা-মার ওপর সেই রাগের প্রতিশোধ নিয়েছি সাহিত্যিক হয়ে!
তাহলে বলা যায় লেখালেখিটা আপনার এক প্রকারের জেদের ফসল। স্বামীর পদবি ব্যবহার করে লেখা শুরু করলেন কেন?
আমার জন্ম হয়েছিল সম্পদশালী মধ্যবিত্ত পরিবারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের বছর, আমাদের সব কয় ভাই-বোনকে সাথে নিয়ে মা মিশরে পাড়ি জমান। ১৯১০ সালে আমরা আবার এখানে ফিরে আসি, পরপর কয়েকবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় সে বছরই মারা যান বাবা। তখন ১৯১২ সালে আমার প্রথম স্বামী আর্চি ক্রিস্টির সাথে দেখা হয় আমার। সে তখন রয়্যাল ফ্লাইং কর্পসে যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে আমরা আলাদা হয়ে পড়ি। সে চলে যায় ফ্রান্সে আর আমি চলে আসি ডোভানের টার্কে, আমার জন্মস্থানে। এক হসপিটালে স্বেচ্ছাসেবী নার্স হিসেবে কাজ শুরু করি আমি। সেখানকার অভিজ্ঞতাগুলোই প্রথম ক্রাইম স্টোরি লিখতে আমাকে সাহায্য করেছিল। ১৯১৬ সালে ‘দ্য মিস্ট্রিস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস’ নামক বইটি লিখে সাহিত্যের জগতে পদার্পণ করি আমি। গল্পটির প্রধান চরিত্র ছিল এরকুল পোয়ারো। আমি স্বামীর পদবি ব্যবহার করি কারণ এই বইটি লেখার সময় সে ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আর পরবর্তীতে এই উপন্যাসটিই আমাকে খ্যাতি এনে দেয়। শুরুতে এই পদবিটি আমাকে একটা রক্ষাকবচের মতো ভরসা দিত, পরবর্তীতে প্রকাশকরাও এই নামটি ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাই আর নাম পরিবর্তনের বিষয়টি কখনো গুরুত্ব পায়নি।
পাঠকরা জানে খুব অল্প বয়সেই লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন আপনি। আপনার প্রথম রহস্য উপন্যাসের নায়ক ছিল এরকুল পোয়ারো।
হ্যাঁ, ১৮ বছর বয়সেই আমি প্রথম গল্প লিখি। তাছাড়া আপনারা জেনে থাকবেন, আমার মা চমৎকার একজন গল্পবলিয়ে ছিলেন। গল্প লেখার ব্যাপারে তিনি দারুণ উৎসাহী ছিলেন এবং নিজে বেশ কয়েকটি গল্পও লিখেছেন। আমিও মায়ের মতো প্যাশন থেকেই গল্প লিখি। আমার শুরুটা হয়েছিল ছোট গল্প দিয়ে, ১৯৩০ সালে সেই গল্পগুলো প্রকাশিত হয়।
প্রথম বইয়ের জন্য প্রকাশক খুঁজতে কতদিন সময় লেগেছিল আপনার?
অনেক সময় লেগেছিল। প্রথম লেখাটি লিখতে যেমন আমি দীর্ঘ সময় নিয়েছিলাম, ঠিক তেমনি প্রকাশক খুঁজে পেতেও আমাকে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমার প্রথম বইটি প্রকাশিত হয়। আমার স্বামী তখন আমার সাথে দেখা করতে ইংল্যান্ডে আসেন। পাণ্ডুলিপিটা চারজন প্রকাশকের কাছে পাঠিয়েছিলাম আমি। চতুর্থ প্রকাশক, দ্য বডলি হেডের জন লেন পাণ্ডুলিপিটা ছাপাতে রাজি হন। কিন্তু তিনি আমাকে ঐ গল্পে কিছু পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেন আর পরবর্তী পাঁচটি বইয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ করেন। তার পরামর্শেই গল্পটির রহস্যের সমাধান হয় লাইব্রেরিতে। আমার অন্যান্য জনপ্রিয় বই যেমন ‘দ্য সিক্রেট অ্যাডভারসারি’, ‘দ্য ম্যান ইন দ্য ব্রাউন স্যুট’ এগুলোর ক্ষেত্রেও প্রকাশকের জোরাজুরিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। যেহেতু তিনি একের পর এক শর্ত জুড়ে দিতে থাকেন, আমার এজেন্টের সাহায্যে নতুন একজন প্রকাশক খুঁজে বের করি আমি। হার্পারকলিন্স নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হয় আমার পরবর্তী বইগুলো।
আপনি বেশ কিছু বিদেশি রহস্য উপন্যাসও লিখেছেন, কয়েকটি গল্পের প্লট ছিল মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক। যেমন ‘মার্ডার অন দ্য অরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’, ‘ডেথ অন দ্য নীল’, ‘মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া’ আর ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট উইথ ডেথ’। এই উপন্যাসগুলো লেখার অনুপ্রেরণা কোত্থেকে পেলেন?
আমার জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল অরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে চড়ে ঘুরে বেড়ানো। ১৯২৮ সালে সেই সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যাই, অসাধারণ সেই ট্রেন যাত্রার কথা আমি কোনোদিন ভুলব না। সফরটিকে ধন্যবাদ। বাগদাদের প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু এলাকা ঘুরতে বেরিয়েছিলাম আমি, সেখানেই দেখা হয়ে যায় ম্যাক্স ম্যালন নামক বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিকের সাথে। পরবর্তীতে তার সাথে আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। ঐ ট্রেনে বসে অনেক গল্প করি আমরা, চমৎকার সেই ভ্রমণটিই পরবর্তীতে এই উপন্যাসগুলো লেখার অনুপ্রেরণা দেয় আমাকে।
এরকুল পোয়ারোর মতো অনবদ্য চরিত্র সৃষ্টির অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন?
বলতে গেলে, ফ্রান্সে কাটানো শৈশবের দিনগুলো আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নার্স হিসেবে একটি হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতা এই দুটি জিনিসই ছিল পোয়ারোকে জন্ম দেয়ার অনুপ্রেরণা। বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলগুলোতে বেলজিয়ান শরণার্থীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি, টার্কও তার ব্যতিক্রম ছিল না। পোয়ারো যদিও কোনো বিশেষ ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি নয়, তারপরও আমার মনে হয়েছিল বেলজিয়ান এই শরণার্থী, এক সময়ে যে বিখ্যাত পুলিশ ছিল, আমার গল্পের জন্য সে নিঃসন্দেহে একজন দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা হতে পারে। তার উপর, নার্স হিসেবে বেশ কিছু বিষ সম্পর্কে জানার সুযোগ হয় আমার। কাজেই ক্রাইম স্টোরি লিখতে খুব বেশি বেগ পোহাতে হয়নি।
আধুনিক উঠতি লেখকদের আপনি কি পরামর্শ দেবেন?
আমি বিশ্বাস করি, টিপস আর পরামর্শ কোনো সময় মানে না, সব সময়ের জন্য তা একই থাকে। যখন আমি লেখা শুরু করেছিলাম তখন লেখক এবং আমাদের পারিবারিক বন্ধু এডেন ফিলপোটস আমাকে বলেছিলেন,
‘শিল্পী হলেন সেই জানালা যার চোখ দিয়ে আমরা প্রকৃতি দেখি। জানালা যত পরিষ্কার আর বিশুদ্ধ কাঁচের তৈরি হবে, ততই আমরা পারফেক্ট ছবি দেখতে পাব। নিজেকে কখনো ছোট করে দেখবে না।’
আপনি উপন্যাস কীভাবে লেখেন?
আমি সবসময় সেই বিষয়েই লেখার চেষ্টা করি যা আমি জানি, যা আমার জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। আমার অভিজ্ঞতা, চেনা মানুষ, পরিচিত জায়গা এগুলোই ঘুরেফিরে চলে আসে আমার লেখায়। মাঝে মাঝে তো এমনও হয়েছে যে একটি ডিনার পার্টিতে গিয়ে কয়েকজনের কথা শুনলাম, আর সেই প্লট নিয়ে একটি উপন্যাস লিখে ফেললাম। আমার নাতি সবসময় বলে আমি এমন একজন মানুষ যে কথা বলার চেয়ে শোনে বেশি। তার ভাষ্যমতে আমি নাকি যা দেখি তারচেয়েও অনেক বেশি বুঝি। কাজেই এই পর্যবেক্ষণগুলো নানাভাবে আমাকে সাহায্য করে। যেমন, আমার বড় ফুপুর বর্ণনা থেকে পেয়েছিলাম মিস মার্পলের আইডিয়া। আমি নিজের গল্প হাতে লিখতেই বেশি পছন্দ করি। অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে আমার মাথায় গল্পের চিন্তা আসে, সেটা হতে পারে হ্যাটের দোকানে কিংবা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে।
আপনি একজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এবং ক্যারিয়ারে যা যা চেয়েছেন সবই পেয়েছেন। এই মুহূর্তে কি আপনার কিছু বলার আছে?
এখন আর কী বলব? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আমাকে এমন সুন্দর একটি জীবন দান করার জন্য, এক জীবনে যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি তার জন্য। অন্যান্য লেখকদের জন্য শুভ কামনা রইল।
ফিচার ইমেজ- playbuzz.com