অঞ্জন দত্তের নিজের জীবনের গল্পটা শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। ১৯৫৩ সালের ১৯ জানুয়ারি কোলকাতায় জন্মেছিলেন তিনি। পড়ালেখার জন্য মাত্র ছয় বছর বয়সে পাড়ি জমিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ের কুয়াশা-ঢাকা সেই সাদা স্কুলটাতে। সেন্ট পলস স্কুলেই কেটেছে অঞ্জনের পুরো ছেলেবেলা। তার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা সবটাই এই স্কুল থেকে শুরু। ছোটবেলায় পড়ালেখায় মন ছিল না তেমন একটা, খেলাধুলাটাও খুব একটা ভালো লাগত না। কিন্তু তার যে জিনিসটা আসলেই ভালো লাগত সেটা হচ্ছে অভিনয়। এই অভিনয়ের নেশাতে আজ অবধি বুদ হয়ে আছেন।
অঞ্জন দত্তের মিউজিক টিচার ছিলেন মিস ব্ল্যাকলি, যার অনুপ্রেরণাতে স্কুলে থাকা অবস্থাতেই স্কুল প্লেগুলোতে অভিনয় করেছেন নিয়মিত। বয়েজ স্কুল হবার কারণে মেয়েদের চরিত্রগুলো ছেলেদের দিয়ে করানো হতো। অঞ্জন দত্ত ছোট বেলায় বেশ কিছু নাটকে মেয়েদের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, এরপর ধীরে ধীরে বড় ক্লাসে এসে ছেলেদের ভূমিকায় অভিনয় করা শুরু করেন।
পারিবারিক কারণে সেন্ট পলস ছেড়ে তাকে কোলকাতায় ফিরে আসতে হয়, ফেলে আসতে হয় তার পছন্দের স্কুলটাকে, কেবল থেকে যায় স্কুলের সাথে জড়িয়ে থাকা সব স্মৃতি। আশুতোষ কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার সময় ইংলিশ ড্রামা ক্লাস নিতেন উদয় দত্ত। উনার একটা থিয়েটারের দল ছিল, সেখানে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কেননা তাদের সাথে ঠিক বনিবনা হয়নি এবং তার ইচ্ছে ছিল সিনেমাতে অভিনয় করা। যেহেতু পরিবার থেকে ড্রামা স্কুলে পড়তে দেবে না, তাই অভিনয় শেখা এবং চালিয়ে যাবার একমাত্র পথই ছিল থিয়েটার করা।
ইংরেজি থিয়েটার দিয়ে অঞ্জন দত্তের থিয়েটার যাত্রার শুরু। ধীরে ধীরে থিয়েটারটাকে ভালোবাসতে শুরু করলেন। বাদল সরকারের নাটক দেখে মুগ্ধ হয়ে তার কাছেই অভিনয় শেখার বিষয়টা পাকাপোক্ত করেছেন। সেখান থেকে নিজের একটা দল করলেন, নাম দিলেন ওপেন ‘থিয়েটার’। সে সময় তিনি ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকাতে চাকরি করতেন। আর্থিক প্রয়োজনেই মূলত পত্রিকার চাকরিটা নিয়েছিলেন। স্টেটসম্যানে তার আর্টিকেল পড়ে শেখর তার সাথে দেখা করতে আসেন, সেই সুবাদেই শেখরের সাথে পরিচয়। ওপেন থিয়েটারের প্রথম মঞ্চায়িত নাটক ছিল- জা পল সার্ত্র’র নাটক ‘ম্যান উইদাউট শ্যাডোজে’র অনুবাদ নাটক- ‘স্বীকারোক্তি’। নাটকটি ধরণী ঘোষের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার রিভিউতে বেশ প্রশংসা পেয়েছিল।
অঞ্জন দত্ত তার থিয়েটারের মাধ্যমেই সিনেমাতে কাজ করার সুযোগ পান। মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তার থিয়েটার দেখেই অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মৃণাল সেনের আগে তিনি বুদ্ধদেব বসুর চোখে পড়লেও মৃণাল সেনের ‘চলচ্চিত্র’ (১৯৮১) সিনেমাতে এবং ‘খারিজ’ সিনেমাতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন। মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অঞ্জন দত্তের প্রথম সিনেমা ‘চলচ্চিত্র’ ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ক্রিটিকসদের বেশ প্রশংসা লাভ করে।
সিনেমাতে প্রসার লাভ করলেও থিয়েটারটাকে পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি কখনোই। সিনেমার ফাঁকে ফাঁকে থিয়েটার চালিয়ে গেছেন। জার্মান নাট্যকার টাঙ্কেড দস্ত, অঞ্জন দত্তের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকে জার্মানিতে গিয়ে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। ১৯৮২ সালে ‘গৃহযুদ্ধ’ সিনেমা করার পর তিনি সিনেমা ফেলে চলে গিয়েছিলেন জার্মানিতে কেবল থিয়েটারের টানে, ওখানে তিনি তিন বছর ছিলেন। জার্মানিতে অঞ্জন দত্ত থিয়েটার দেখেছেন, করেছেন, শিখেছেন। সেখানে তিনি ব্রেখটের নাটক দেখেছেন। ছোটবেলা থেকে রক মিউজিকের সাথে পরিচিত অঞ্জন দত্ত ইউরোপে গিয়ে সেটার একটা ধারা খুঁজে পেলেন। সেখানে থিয়েটারে লাইভ মিউজিক পরিবেশনা তাকে অভিভূত করেছিল। ব্রেখটের ‘থ্রি পেনি অপেরা’ লন্ডনের গ্যাংস্টারদের নিয়ে করা, সেখানে মিউজিকের ব্যবহার করা হয়েছে, অঞ্জন দেখেছেন কীভাবে সবকিছু লাইভে করছে ইউরোপের নাট্যকাররা। বিশাল বিশাল বাজেটের এইসব থিয়েটার দেখে অঞ্জন বুঝেছিলেন- দেশে এত বড় মাপের থিয়েটার নামানো সম্ভব নয়, সেই থেকে সিনেমা বানাবার কথা মাথায় এসেছিল। জার্মানিতে থাকা অবস্থাতেই তিনি তার থিয়েটার দলের গিটার প্রতিদিন ঘরে নিয়ে এসে গান গাইতেন, সে সময়ই তিনি বেশ কয়েকটি গান লিখেছেন।
পরবর্তীতে দেশে ফিরে এসে সিনেমা বানানোর ভূতটা মাথাতে চেপে গেল, যার সূচনা হয়েছিল জার্মানিতে থাকা অবস্থাতেই। মৃণাল সেনের কয়েকটি মুভিতে অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন, কাজ শিখেছেন। সেই সাথে অভিনয়টাও চালিয়ে গেছেন। এরপর শেষ একটি মিউজিকাল প্রোডাকশন করলেন জার্মান ‘লিলি আইন’ নাটকের বাংলা রূপান্তর ‘কর্ডলাইন’। মূল নাটকের জার্মানির চরিত্রকে নিয়ে আসলেন বাংলার পরিবেশে, নাম দিলেন দূর্গা। তাকে ঘিরেই গড়ে উঠল পুরো নাটকের কাহিনী। ‘গ্রিপস’ এর জর্জ ট্রান্স ছিলেন মিউজিকের দায়িত্বে। প্রচুর জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও সত্তরটা শো-এর পর অঞ্জন দত্ত অনেকটা অভিমান করেই থিয়েটার ছেড়ে দিয়েছিলেন। অঞ্জন দত্তের অভিমানের মূল জায়গাটিই ছিল তার থিয়েটারের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়া।
সব সময় নতুন কিছু করার তাগিদ অঞ্জন দত্তকে অস্থির করে রাখত। থিয়েটারের জন্য ছন্দা দত্ত তার গহনা বিক্রি করেছেন, হেনরিক ইবসেনের ‘গোস্ট’ নাটক নামানোর জন্য। ইবসেনের ‘ডলস হাউজ’, ‘খেলাঘর’ নাম দিয়ে এক বন্ধুর বাড়ির উঠান ভাড়া করে নামিয়েছেন। যেখানে সিনেমাটোগ্রাফার সম্ভিত বোসকে দিয়ে আলোর কাজ করিয়েছেন। পুরো ভিন্ন আঙ্গিকে উঠানকে স্টেজ হিসেবে ব্যবহার করে দর্শকদের ঘরের ভেতরে বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঘরের আলোই ছিল উঠানের একমাত্র আলোর ব্যবস্থা। দ্বিতীয় দৃশ্যের পর পুরো বাড়িতে লোডশেডিং করিয়ে সব জায়গায় মোমবাতি বসিয়ে দেওয়া হয়। এরকম মঞ্চায়নের ভাবনা অঞ্জন দত্ত ছাড়া আর কার মাথাতেই বা আসতে পারে!
কিন্তু এসবের কোনাটারই সঠিক মূল্যায়ন হয়নি, অঞ্জন দত্ত আশাহত হয়েছেন বারংবার। তাই প্রায় চৌদ্দ বছর থিয়েটার করার পর অভিমান করে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তার এই অভিমান যথেষ্ট সমীচীন।
‘শিল্পী’ (১৯৯৩) সিনেমায় চরিত্রের প্রয়োজনে তাঁতের কাজ শিখতে গিয়ে চার মাস তাকে গ্রামে থাকতে হয়েছিল। সেখান থেকেই এক রোগ বাধিয়ে ফেলেছিলেন। আর সেই সিনেমার শুটিং শেষে সিনেমার কাজ থেকে ইস্তেফা নিয়েছিলেন।
অনেকটা অর্থের প্রয়োজনেই অঞ্জন দত্ত গান ধরেছিলেন, এরপর আর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। গান করেই তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন, সেই রেশ ধরে ১৯৯৪ সালে বের করেন তার প্রথম এলবাম ‘শুনতে কি চাও’ (১৯৯৪)। তার এক বছর বাদে ‘পুরনো গিটার’ (১৯৯৫)। এরপর আবার সিনেমাতে অভিনয়ে ফিরেছেন। কয়েকটি সিনেমাতে অভিনয় করেছেন, কিন্তু গানের পাশাপাশি অভিনয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। সেখান থেকে তার মাথাতে সিনেমা বানানোর ভূতটা ফিরে এলো, তার পরিচালনায় প্রথম সিনেমা ‘বো ব্যারাক্স ফরেভার’। এদিকে প্রায় প্রতি বছরই অঞ্জন দত্ত একটি করে এলবাম বের করতে থাকেন, আর সেই সাথে মানুষের মুখে মুখে তার গান ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি বহু সিনেমা বানিয়েছেন, গান লিখেছেন, গান করেছেন দেশে বিদেশে সব জায়গাতে। ’৯০ এর দশকের বেলা বোস, রঞ্জনা আর মেরি এন-কে না চেনে কে! সেই আলীবাবা আর পুরনো গিটারের সুরে একটা পুরো জেনারেশনের বড় হয়েছে। গায়ক পরিচয়ের আড়ালে থাকা থিয়েটারের অঞ্জন দত্তকে জানা হয়ে ওঠেনি অনেকেরই।
এরপর প্রায় দীর্ঘ ১৯ বছর বাদে অঞ্জন দত্ত থিয়েটারে ফিরে এলেন ‘গ্যালিলিও’ নাটক দিয়ে। এই সময় তাকে আর কারো কাছে হাত পাততে হয়নি, নিজ অর্থেই নামিয়েছেন নাটক। ‘গ্যালিলিও’ র পর করেছেন ‘মেধা’ তারপর ‘থ্রি পেনি অপেরা’। ‘তারায় তারায়’ নাটকে তিনি ভ্যান গখের চরিত্রে অভিনয় করেছেন । অঞ্জন দত্তের থিয়েটারের শেষ প্রোডাকশন হচ্ছে ‘সেলসম্যানের সংসার’- যার একটা শো আমাদের বাংলাদেশের, ঢাকার বেইলী রোডের মহিলা সমিতিতে মঞ্চায়ন করা হয়েছিল। সেই সাথে তাকে নিয়ে লেখা সাজ্জাদ হোসেনের দ্বিতীয় বই ‘নাট্যঞ্জনের’ মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন।
এখন অঞ্জন দত্ত আবার থিয়েটারে নিয়মিত হয়েছেন, সেই সাথে সিনেমাও বানাচ্ছেন। বাংলা সিনেমা এবং থিয়েটারের প্রেমে এই বহু প্রতিভার অধিকারী মানুষটি ভালোবেসে কাজ করে গেছেন এবং এখনো যাচ্ছেন।