ভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে থাকা ব্যক্তিত্বের বহমান চিত্র ‘পরশুরাম’

এক বিঘা জমি। গ্রামের কর্তাবাবুর নিকট থেকে জমির মালিক ২৫ টাকা ধার করেন। সেই ধার এবং এর সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে জমিটা দিয়ে দিতে হয় কর্তাবাবুর (মহাজন) নিকট। নিজের জমিতেই জমির মালিক বনে যান ভাগচাষী। সেই জমিতে প্রতিবছর ১৬ মণ ধান উৎপাদন হতো। মহাজন নিয়ে যেতেন অর্ধেক। ১০ বছরে ৮০ মণ ধান পান সেই মহাজন। ৮০ মণ ধান থেকে চাল হয় ৪০ মণ। যার বাজারমূল্য সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা!

“ইয়ে হ্যায় দুনিয়া কা চাক্কার (এটিই হচ্ছে দুনিয়ার চলমান নিয়ম)”

দুনিয়ার সহজ এই সমীকরণ কেন যেন সহজে বর্ণনা করতে চান না কেউই। সহজ এই ব্যাখ্যা কোথাও স্পষ্টভাবে চিত্রায়নও করা হয় না। কেননা, এতে জড়িয়ে আছে স্বার্থবাদী একটি মহলের শোষণ করার ইতিহাস। তাদের প্রতিনিধিরা আজও টিকে আছেন বহাল তবীয়তে। জোঁকের মতো চুপিসারে সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে খাওয়ার নমুনা আমরা দেখি আবু ইসহাকের ‘জোঁক’ গল্পে। এবার তা আরও সহজে বর্ণনা করলেন সৃষ্টিশীল পরিচালক মৃণাল সেন, তার ‘পরশুরাম’(১৯৭৯) সিনেমায়।

তবে এই সিনেমার মূল উপজীব্য কিন্তু উপরে উল্লেখিত দুনিয়ার এই নিয়মটি নয়। দুনিয়ার আরও একটি জটিল ব্যাপার সহজে উপস্থাপিত করে সিনেমাটিকে প্রাণবন্ত করেছেন পরিচালক মৃণাল সেন। মূলত গ্রাম থেকে শহরে আসা একটি প্রান্তিক মানুষের শহরের প্রান্তিকদের সাথে জীবন কাটানোর গল্প এটি। যেখানে ফুটে ওঠে শহর নিয়ে আমাদের ভাবনার ফাঁক-ফোঁকরে থাকা অবহেলার গল্প। যে গল্প আমাদের চোখের সামনে ঘটে গেলেও মগজে নাড়া দিতে পারে না। ফলে তা সচেতন মগজের ফাঁকে বেরিয়ে যায়। সেই গল্প এঁকেছেন মৃণাল সেন।

সিনেমাটি প্রযোজনা করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কাহিনী লিখেছেন মৃণাল সেন এবং মোহিত চট্টোপাধ্যায়। এতে অভিনয় করেন অরুণ মুখার্জী, বিভাষ চক্রবর্তী, শ্রীলা মজুমদার ও প্রমুখ।

বিভ্রম ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব

“যেদিন এমনি করে পেটাবো না!”

মনিব তার মানিব্যাগ খোঁজ করে পাচ্ছেন না। তিনি তখন তার চাকরকে আচ্ছা মতো মার দিলেন। চাকর নাকি তার মানিব্যাগ চুরি করেছে। তাকে মারতে মারতে উপর তলা থেকে নিচতলায় নিয়ে এলেন। পরে দেখা যায় মানিব্যাগ তার টেবিলেই ছিলো। শুধু শুধু চাকরটাকে মারলেন তিনি। তার পরের দৃশ্যেই দেখা যায় চাকর তাকে উল্টো আসছে মারতে। হাওয়ায় ছুড়ে দিচ্ছে তার হাত। ভয়ে মনিব নিচ থেকে উপরে উঠে গেলেন। চাকরও তাকে তাড়া করে উপরে গেলো। কিন্তু মনিবকে চাকরের এই তাড়া করার ঘটনাটি চাকরের কল্পনা। সে মার খেয়ে বসে বসে কল্পনা করছে সে-ও মারবে।

শুরুর এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় আমাদের প্রতিদিনকার চিত্রকে। সুশীল এক ব্যক্তি এখানে সেখানে সুশীলতার কথা বলেন কিন্তু নিজের বাসায় থাকা চাকরকে বিনাদোষে দোষারোপ করেন। সমাজের বর্তমান অবস্থা এমন যে, কোনো অন্যায় করলেই ধরে নেয়া হয় দলিত কিংবা নিচুশ্রেণীর কেউ এই কাজের সাথে জড়িত। এমনকি অন্যায়টি সংগঠিত না হলেও। আর, কল্পনায় ভাবা সেই দৃশ্যটি যেন এসব অবহেলিত মানুষের মনের ক্ষোভ।  

পরশুরাম সিনেমার পোস্টার; Image source: youtube

২০১৯ সালেরই ঘটনা। বহু টাকার অর্থায়নে দেশের রোগীদের জন্য নির্মিত হয়েছে সরকারি একটি বিশেষ ইনস্টিটিউট। এর একটু দূরেই ফুটপাতে বসত করে গুটি কয়েক পরিবার। ভবঘুরে এই পরিবারের থাকার জায়গা নেই। সেই ইনস্টিটিউটটি উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ করা হলো। যে ফুটপাতে গুটি কয়েক পরিবারের বসতি সেই রাস্তা ধরেই এখানে উদ্বোধন করতে আসবেন দেশের প্রখ্যাত এক ব্যক্তি। তাই আগের দিন ফুটপাত থেকে মেরে সরিয়ে দেয়া হলো সেই পরিবারগুলোকে। উদ্বোধনের পর ফের তারা সেখানে আশ্রয় নেয়।

ঘটনাটি সহজভাবে বর্ণনা করা হলেও এটি বেশ জটিল। কেউ হয়তো তা দেখে মানবতার জন্য তাদের পক্ষে কথা বলবেন। কিন্তু তাদের সরিয়ে দেয়ার মানে হচ্ছে দেশে উন্নয়ন হচ্ছে এমন চিত্র দেশের হর্তাকর্তাদের দেখানো। তাদের দেখলে এই ধারণায় ব্যত্যয় হবে। এমনই এক চিত্র আমরা দেখি ১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘পরশুরামে’।

“এ হচ্ছে ব্যাঙের ছাতা। এই পায়ে দলিয়ে গেলি, তো ফের আরেকখান গজায়ে উঠল”

ফুটপাতে থাকা মানুষদের কয়েকদিন পরপর এসে সরিয়ে দেয়া হয়। তারা কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে তা নির্ধারণ না করেই কিছুদিন পরপর এমন করা হতো। তারা কি দেশের মানুষ নয়? তাদের কি বসবাসের জায়গা পাওয়ার অধিকার নেই? মৃণাল সেন দেখান তারা সেখানে ফের তাদের জায়গা নিয়েছে। তুলনামূলক দৃশ্যের মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তুলেন তিনি।

এভাবে তারা বারবার অবহেলিত হয়েও টিকে আছেন। এরা যেন ব্যাঙের ছাতা। একবার মাড়িয়ে গেলে ফের তারা গজাবেন। ব্যাঙের ছাতা বলার মাধ্যমে এখানে তাদের টিকে থাকার গল্প বলার পাশাপাশি বলা হয়েছে তাদেরকে হেয় হিসেবে উল্লেখ করার বিষয়টি। ব্যাঙের ছাতা হচ্ছে আবর্জনার চেয়ে বাজে একটি বস্তু। সমাজের এসব দলিত কিংবা অবহেলিত মানুষগুলোকে তো আমাদের কাছে ব্যাঙের ছাতার মতোই প্রতীয়মান।

“বিলি হয়ে গেছে”

ফুটপাতে থাকা এসব মানুষদের সাথে এসে যুক্ত হন সেই চাকর। এখানে পরিচালক মৃণাল সেন আরও একটি ব্যাপার চিত্রায়ন করেন। ফুটপাতে থাকা এসব মানুষদের সংখ্যা কত? তারা কি খুবই কম? কিন্তু কুড়াল হাতে আসা চাকরটি সেখানে এসে জায়গা পাননি। ইতোমধ্যেই খালি জায়গাগুলো সব দখল হয়ে গেছে। এর মাধ্যমে পরিচালক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এসব লোকদের সংখ্যা অনেক।

চাকর লোকটির নাম পরশুরাম!

ফুটপাতে থাকা সেই বাসিন্দাদের সর্দার হারান খুঁড়ো চাকর লোকটিকে ‘পরশুরাম’ বলে সম্বোধন করেন। ‘পরশুরাম’ হচ্ছে সেই লোক যিনি তার বাবার হত্যাকারী রাজা এবং সেই রাজার বংশকে কুড়াল দিয়ে নিশ্চিহ্ন করেন। যাত্রার গল্প এটি। চাকর লোকটির হাতে কুড়াল দেখে তাকে এই নাম দেয়া। তারও তো এমন গল্প আছে। গাঁয়ের বাঘ মেরেছে সে। এমন ঘটনা জাহির করে। কিন্তু দেখা যায় একটি ছুঁচো দেখেও ভয় পায় এই পরশুরাম! তার সাহসের গল্প শুনে হাসে সেখানকার বাসিন্দারা।

এভাবেই মরে পড়ে থাকে অবহেলিতরা; Image source: youtube

সরাসরি বাস্তবতা দেখানোর পাশাপাশি মৃণাল সেন রূপকের ব্যবহারও করেছেন। সর্দার যখন পরশুরামের গল্প বলছিলেন তখন দেখা যায় তার চোখে-মুখে ক্ষোভ। আগ্রহের সাথে তার গল্প শুনছেন বাকিরা। কিন্তু তাদের চোখে-মুখে হতাশার চিত্র। কেননা তাদের সবকিছু ছিনিয়ে নেয়াদের শায়েন্তা করতে বাস্তব জীবনে নেই এমন কোনো পরশুরাম। পরশুরামকে দেখে একজন বুড়ো মহিলা যখন বলেন,

“ছেলের আমার অখণ্ড পরমায়ু। তা নাহলে কি এ যাত্রায় আর রক্ষা পেতো? বলি রাখে হরি তো মারে কে?”

সংলাপটির শেষের দিকে ক্যামেরায় পরশুরামকে দেখানোর পরিবর্তে দেখানো হয় ফুটপাতে বসবাস করা একটি ছেলেকে। কিন্তু এই ছেলেকে দেখানো কেন? সমাজের অবহেলিতরা এত কষ্ট সহ্য করেও নিঃশেষ হয়ে যান না, টিকে থাকেন। এই সংলাপ এবং দৃশ্যায়ন যেন তাদের হতাশার চিত্র। জীবিকার তাগিদে এই পরশুরামকেও গঙ্গার তীরে বিত্তশালীদের হাতের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। পয়সা পেতে যুদ্ধ করতে হয়। নিজেদের শ্রেণীর লোকদের সাথেই। এমনকি তার নিকটাত্মীয়দের সাথেও।

“ডাঙ্গায় যুদ্ধ, কাদায় যুদ্ধ, মা গঙ্গার পেটের মধ্যে যুদ্ধ”

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বেশি বিপদে থাকে ফুটপাতে আশ্রয় নেয়া এসব দলিতরা। তাদের অস্থায়ী বাসস্থান তখন বিলীন হবার পথে। আশ্রয় নিতে হয় গোরস্তানে।

আর এদিকে পরশুরাম তার ভ্রম থেকে বের হতে পারছে না। নিজের ডেরায় ঘুমিয়ে আছে সে। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি ও তুফান। ক্যামেরায় দেখানো হয় তার মনিব বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে আশ্রয় নেন পরশুরামের ডেরায়। গিয়ে বসেন তারই পায়ের কাছে। পরশুরাম একটু পর জোরে তাকে লাথি দেয়। কিন্তু আসলে সেখানে ছিলো একটি কুকুর। মনিবকে লাথি দেয়াটা ছিলো তার কল্পনা। সরাসরি আঘাত করতে না পারলেও বিত্তবানদের অবহেলার জবাব দেয়া হয় পরোক্ষভাবে। বঞ্চিত করে রাখা মানুষজনও তাদের কল্পনায় কেটে কুটি কুটি করে সুবিধাভোগী ও অত্যাচারী শ্রেণীকে।  

এদিকে কলকাতার প্রগতিশীলদের কথার ঝলকানি চলছেই। বস্তি কিংবা এখানে সেখানে আশ্রয় নেয়া এসব বাস্তুহারাদের হেলা না করার শপথ নিচ্ছেন তারা। সবাইকে এগিয়ে আসতে বলছেন। বিরোধিতা করছেন বড় বড় ইমারত নির্মাণের। কিন্তু কোনো আলোচনায়ই নেই সমাধানের বার্তা। বড় হলরুমে তাদের কথায় হাততালি পড়ছে অঢেল। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই দৃশ্য যেন খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। এই দৃশ্য দেখানোর সময় মৃণাল সেন কাট শটের মাধ্যমে দেখিয়েছেন শহরের এখানে সেখানে হেলায় জীবন কাটানো লোকদের। তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করে বাস্তব চিত্র দেখান দর্শকদের। এদিকে, তাদের এই অবস্থার বিপরীতে চলছে চোরাচালানের কাজ। হয়তো তাদের জন্যই পাঠানো ত্রাণ সরিয়ে নিচ্ছে সুবিধাবাদী এবং চালাক একটি মহল। 

সিনেমা নির্মাণে বাস্তবতা ও নতুনত্ব দেখিয়েছে মৃণাল সেন; Image source: theweek.in

মৃণাল সেন এই মানুষদের আবেগ, ভালোবাসা এবং সম্পর্কের জটিলতাও দেখিয়েছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে আমরা যেমন পাই, এসব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক। তেমনি ‘পরশুরাম’ সিনেমাতেও প্রায় কাছাকাছি ধারণা পায়। পরশুরামের কাছে এসে আশ্রয় নেয়া মেয়েটি আগেও ছিলো অন্য কোনো দলিত মানুষের ঘরে। তার কাছে নিজের সুখটাই বড়। যে খেতে দেবে তার কাছেই থাকার লোভ পেয়ে বসেছে তাকে। তাই পরশুরামকেও ছেড়ে যেতে দ্বিধা করে না মেয়েটি।

“মরার জাত আমরা, মরা ছাড়া আর কি দাবি করতে পারি?”

সিনেমায় বিভিন্ন দৃশ্যের ফাঁকে দেখানো হয় শহরের বড় বড় ইমারত কিংবা ব্রিজ। উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে শহর। এসব কাঠামো তারই সাক্ষ্য বহন করছে। এই উন্নয়নের ধারায় বিভ্রম হওয়াই পরশুরামের গল্প। যে উন্নয়ন দেখতে বিল্ডিংয়ে উঠে। তাকিয়ে দেখে চারপাশে বড় বড় দালান। অথচ তাকে থাকতে হচ্ছে গোরস্থানে, যেখানে মৃতদের বাস। আর তার সঙ্গীরা থাকছে ফুটপাতে।

শহরের এই বিভ্রম তাকে তাজ্জব করে দেয়। দেখতে দেখতে উঁচু দালান থেকে নিচে পড়ে মারা যায় ‘পরশুরাম’। সেই পরশুরাম, যে রাস্তায় হাত পা ছুঁড়ে শোষকদের কাল্পনিক আঘাত করেছিলো। যে তার কাছের সেই মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া লোকটিকে কল্পনায় আঘাতের পর আঘাত করেছিলো, ঘুষির পর ঘুষি মেরেছিলো। তাকে বিভ্রমের জালে বন্দীই থাকতে হলো। বিভ্রম থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই তার মতো শোষিতদের কারোরই। এমনকি তার মৃত্যুর পরেও মরদেহ দেয়া হয় না সঙ্গীদের।

বলা হয়, এই মরদেহ বেওয়ারিশ। কিন্তু হারান খুঁড়োদের আবেদন, অন্তত মরদেহটা যেন দেয়া হয়। মরা ছাড়া তারা আর কী-ই বা চাইতে পারেন। হারান খুঁড়ো অবলীলায় বর্ণনা করেন মৃত্যুর ঘটনা। মরদেহ নিয়ে বসে থাকার সময় খুঁড়োর সংলাপটি যেন আমাদের তীক্ষ্ণ আক্রমণ করে।

“পাঁচজনে দেখুক, একটা মানুষ যাচ্ছে”

‘পরশুরাম’ চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন অরুণ মুখার্জী। যে কারণে পরবর্তীতে তাকে অনেকে পরশুরাম খেতাব দেন। হারান খুঁড়ো এবং শ্রীলা মজুমদারের অভিনয়ও ছিলো প্রশংসা করার মতো। এই সিনেমায় ক্যামেরার কাজ এবং মিউজিকের কাজে বেশ সৃষ্টিশীলতার ছাপ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রশংসার দাবি রাখে সিনেমার সংলাপগুলো। একেকটি সংলাপ যেন সূচালো প্রতিবাদ কিংবা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। 

 

This Bengali article is mainly the review of the famous Bengali film 'Porshuram'. This film is directed by Mrinal Sen. 

Feature Image Source: biffes.in 

Related Articles

Exit mobile version