সত্তর-আশির দশক কলকাতার জন্য ছিল বেশ উত্তাল সময়। একদিকে ’৬৬ সালের খাদ্য ঘাটতিতে সৃষ্ট বিক্ষোভ, অন্যদিকে নক্সালবাদীদের উত্থান- সবটা মিলিয়ে রাজনৈতিকভাবে বেশ কঠিন একটি সময় কাটিয়েছে কলকাতা। আর তার উপস্থাপন দেখা যায় তখনকার শিল্প মাধ্যমগুলোতেও। সাহিত্য থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গা জুড়ে প্রায় সবখানেই তৎকালীন কলকাতার উত্তেজনার আঁচ লেগেছিল। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতের জন্মাবধি বাংলা চলচ্চিত্র এসময় একইসাথে পেয়েছে শতাব্দীর সেরা কয়েকজন চলচ্চিত্রকারকে; যাদের কেবল সৃজনশীলতাই ছিল না, ছিল সমাজ সচেতনতাও। আর সেই দায়বদ্ধতা তথা দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে নির্মিত চলচ্চিত্র শুধু চলচ্চিত্র তৈরির নতুন নির্মাণশৈলীর সাথেই আমাদের পরিচয় করায়নি, বরং সময়ের দীর্ঘ দূরত্বকে ঘুচিয়ে দেখিয়েছে তৎকালীন সমাজের সার্বিক চিত্রায়ন।
১৯৭০ সালে সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ তেমনি একটি চলচ্চিত্র। সমসাময়িক বিষয়গুলোকে চলচ্চিত্রে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সক্রিয়তার অভাবে সমালোচনার সম্মুখীন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের তৈরি প্রতিদ্বন্দ্বীকে তাই অনেকটা সমালোচকদের জন্যে জবাবের মতোই বলা যায়। প্রতিদ্বন্দ্বীকে সত্যজিৎ রায় নিজে তার প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর নির্মাণশৈলী থেকে শুরু করে গল্পের উপস্থাপন, সবখানে উপস্থিত ভিন্নতায় তারই যথার্থতা দেখিয়েছেন পরিচালক।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসকে উপজীব্য করে নির্মিত ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র প্রতিদ্বন্দ্বী সত্যজিৎ রায়ের কলকাতা ত্রয়ীর একটি। প্রধান চরিত্র ২৫ বছর বয়সী যুবক সিদ্ধার্থের ভূমিকায় অভিনয় করেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। বাবার মৃত্যুতে চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র সিদ্ধার্থকে মেডিক্যাল কলেজের পড়া ছেড়ে দিতে হয়। সায়েন্সে স্নাতক শেষ করে পরিবারের ভার নিজ কাঁধে তুলে নিতে চাকরির খোঁজে বেরিয়ে প্রতি মুহূর্তে সে বুঝতে পারে, যোগ্যতার সাথে চাকরি পাওয়ার আশায় ঘুরতে থাকা তরুণদের প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোয় মানিয়ে নিতে পারা ছোট বোন সুতপা ও সমাজ কাঠামোকে ভেঙে সাম্যের ভিত্তিতে সমাজকে প্রতিষ্ঠার আশায় থাকা নক্সালপন্থী ছোটভাই টুনুর নৈতিক ভিন্নতায় মাঝে অবস্থান করে সিদ্ধার্থ। অনুভূতিহীন ও স্বার্থপর হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন যেমন সিদ্ধার্থের নেই, তেমনি নেই কোনো বিপ্লব ঘটিয়ে সমাজে আমূল পরিবর্তন আনার ইচ্ছে। এককথায়, মানসিকতার দিক থেকে মাঝারি অবস্থানে দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থ। আর চলচ্চিত্রে সিদ্ধার্থের এ অবস্থানকে বিভিন্ন দৃশ্যের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের ভাষায় একাধিকবার তুলে ধরা হয়।
চাকরির ইন্টারভিউ থেকে ফেরত আসার পর পার্কের ভেতর দুটো স্তম্ভের মাঝামাঝি জায়গায় বসা কিংবা দুটো দেয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে ‘স্ট্রাইকার ভারসাস নন-স্ট্রাইকার’ লেখার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকা সিদ্ধার্থকে দেখানোটা নির্মাণশৈলীর নৈপুণ্যতাকেই তুলে ধরে। এছাড়া বারবার জাম্প কাট ব্যবহার, ক্যামেরা হাতে রেখে ঝাঁকুনিযুক্ত হ্যান্ড-হেল্ড শট, ফ্রিজ শট, ফ্ল্যাশব্যাক, ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড ও নেগেটিভের মাধ্যমে বিভিন্ন দৃশ্যধারণ নির্মাণশৈলীর নতুনত্বকেই উপস্থাপন করে। যেমন- কলকাতার রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে সিদ্ধার্থের বেড়ানোর শটগুলো পরিচালক হ্যান্ড-হেল্ড শটে ঝাঁকুনির সাথে তুলে ধরার মাধ্যমে বাস্তবের ধারণা ও মনের অস্থিরতাকে ক্যামেরায় বন্দী করেন। এ বিষয়ে পূর্বে মৃণাল সেনের সাথে হওয়া এক বিতর্কে এ ধরনের চলচ্চিত্র ভাষাকে শুধুই দৃষ্টি-আকর্ষণকারী কৌশল হিসেবে সত্যজিৎ রায় উল্লেখ করলেও নিজের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্রেই তার ব্যবহার করেন সত্যজিৎ রায়। তিনি বলেন-
“নির্মাণশৈলীর পার্থক্যের মাধ্যমেও আমি স্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছিলাম যে প্রতিদ্বন্দ্বী আমার প্রথম রাজনৈতিক ছবি এবং আমার পূর্বের সব ছবি থেকেই অন্যরকম একটি ছবি। তাই এই ছবিতে নির্মাণশৈলীর ভিন্নতা প্রদর্শনেই আমি আগ্রহী হয়েছি।”
কখনো ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে, কখনোবা নেগেটিভ করে দিয়ে চলচ্চিত্রে কাহিনীর এগিয়ে চলাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। আবার অন্য ছবির দৃশ্যের উপস্থাপন চলচ্চিত্রটিকে করেছে সেলফ রিফ্লেক্সিভ। ভয়েস ওভারে ন্যারেশন কিংবা অপ্রথাগত ফ্রেমিংয়ের ব্যবহারের মাধ্যমে পরপর দেখানো দুটি দৃশ্যের মধ্যে স্থান ও সময়গত বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে দর্শকের মনে সৃষ্টি করা হয়েছে অস্বস্তির। আবার কখনো বক্তাকে না দেখিয়ে শুধু শ্রোতার অবয়বে অভিব্যক্তি পরিবর্তনের মাধ্যমে দেখানো হয় নির্মাণশৈলীর জটিলতা। এ জটিলতা বারবার মনে করিয়ে দেয়, চলচ্চিত্র শুধু দুপুরের ভাতঘুম সময়ে বিনোদনের জন্যে না, বরং সমাজে ঘটতে থাকা অন্যায় ও অনুভূতিহীনতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলার জন্যে তৈরি করা হয়।
বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় অনৈতিকতা যে তরুণদেরও সমানভাবে স্পর্শ করেছে তা ফুটে উঠে সিদ্ধার্থের ছোট বোন সুতপা ও বন্ধু আদিনাথের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। একদিকে অফিসের বসের স্ত্রী বাসায় এসে অভিযোগ করার পরও সুতপার উদাসিনতা অন্যদিকে রেডক্রসের টিনের কৌটা থেকে আদিনাথের টাকা সরানো, সবই তীব্র ভোগবাদী ও আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। যেখানে একদিকে কলকাতার সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থীর একাংশ শোষণমূলক ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজ কাঠামো ভেঙে ফেলার জন্যে সশস্ত্র বিপ্লবে যোগ দিয়েছে, সেখানে ঐ সময়েরই বহু তরুণ ভোগবাদী ও দুর্নীতিপ্রবণ মানসিকতাকে ধারণ করেছে। একই পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবতার এমন ভিন্ন উদাহরণ নিজ চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করেছেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়।
তবে মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা সিদ্ধার্থ নিজ বক্তব্য কখনো কখনো স্পষ্টভাবেই উপস্থাপন করেছেন। আর তা আমরা দেখতে পাই চলচ্চিত্রের প্রথম ও শেষ দিকের কিছু দৃশ্যে। প্রথম ইন্টার্ভিউয়ে দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে আখ্যায়িত করা এবং যুক্তি দেয়া সে সত্যতাই বহন করে। মাঝামাঝি অংশে প্রশ্নকর্তার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলালে চাকরি পাওয়া সহজ বলে মন্তব্য করলেও শেষে আমরা পুনরায় সিদ্ধার্থকে দেখি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। নিজের তিনটি ডাক্তারি বই বিক্রি করে ছোট ভাইকে চে গ্যেভারার বই কিনে দেয়ার সময় সিদ্ধার্থের পুরনো মানসকেই পুনয়ায় জেগে উঠতে দেখে দর্শক।
শহরের কোলাহলের মাঝে সিদ্ধার্থ খুঁজে ফেরে এক পাখির ডাক- যে ডাক ছোটবেলায় শুনেছিল। পাখির ডাকের কথা জিজ্ঞেস করলে ভোগবাদী বন্ধু কিংবা নক্সালপন্থী বিপ্লবী ছোট ভাই টুনু কেউই বলতে পারে না। প্রকৃতির যে বৈশিষ্ট্য মানুষকে শান্তি এনে দেয়, স্বস্তি দেয় কিছুক্ষণের- তা আজ আর কলকাতার কাউকেই আকৃষ্ট করে না। না এক ভোগবাদীকে, আর না এক বিপ্লবীকে। সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শের দুজন এদিক থেকে ধারণ করে একই মানসিকতা। নান্দনিকতা আর স্পর্শ করতে পারে না তাদের। তবু সেই পুরনো শান্তির খোঁজে একদিন নিউ মার্কেট যায় সিদ্ধার্থ। কিন্তু সেখানে কলকাতায় মানুষের জীবনকেই যেন পুনরায় আবিষ্কার করে সিদ্ধার্থ। খাঁচায় বন্দী বহু পাখির একত্র ডাক তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় কলকাতার কোলাহলকেই। কলকাতায় অবস্থানরত মানুষগুলো যে আশাহীন ও অসহায়ত্বের কারাগারে বন্দী তারই রূপক হয়ে ওঠে খাঁচাবন্দী পাখিগুলো।
কোলাহলময় কলকাতা শহরে অনেকটা নাটকীয়ভাবেই কেয়ার সাথে দেখা হয় সিদ্ধার্থের। ঘর-বাহির সব জায়গায় অস্বস্তি ও অশান্তির মাঝে এক টুকরো শান্তি হয়ে সিদ্ধার্থের জীবনে আসে পূর্ব-পরিচিত কেয়া। রোম্যান্টিকতার বাড়াবাড়ি নেই, নেই কোনো যৌবনের উচ্ছ্বাস। কিন্তু বাসে চড়ে যাওয়ার সময় কিংবা বহুতল ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে দু’জনের মাঝে দু’জন যে শান্তি ও স্বস্তি খুঁজে পায়, সে এক অমূল্য অনুভূতি।
চলচ্চিত্রের শেষে ছোট এক চাকরি নিয়ে কলকাতার বাইরে চলে যায় সিদ্ধার্থ। সেখানে থাকার বন্দোবস্ত বেশ আনন্দের না হলেও পুনরায় সে শুনতে পায় সেই পাখির ডাক। ফ্রিজ ফ্রেমে আটকে যাওয়া দৃশ্যেও পেছনে শোনা যায় পাখির ডাক।
অনেকের মতে, সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রটিকে আরো রাজনৈতিক করে দেখাতে পারতো। সবশেষে কলকাতা থেকে সিদ্ধার্থের চলে আসাকে অনেকে রাজনৈতিক প্রতিবাদের বদলে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও এক্ষেত্রে বলা যায়, চলচ্চিত্রকার অন্যায় আর অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সমাজের একজন মাঝামাঝি মানসিকতার ব্যক্তির একান্ত প্রতিবাদেই বেশি জোর দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আদর্শগত অনুভূতির চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে আবেগগত অনুভূতি।
‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং সত্যজিৎ রায় শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া শিকাগো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ড হুগো পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয় চলচ্চিত্রটি। নির্মাণশৈলী থেকে ঘটনাপ্রবাহ ও কাহিনীর উপস্থাপনের ভিন্নতা প্রতিদ্বন্দ্বীকে করেছে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান এক রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। সময়ের সাথে সাথে চলচ্চিত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আশা সচেতন দর্শকেরা করেছিল, আদতে তা দেখা যায়নি। তবে সময়ের সাথে যুগোপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রতিদ্বন্দ্বী পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে পথিকৃৎ হয়ে উঠবে, এ আশা রাখাই যায়।