জেএফকে। রাজনৈতিক অঙ্গন কিংবা ইতিহাসের পাতায় বিচরণ থাকল এই সংক্ষিপ্ত শব্দটি পরিচিত থাকার কথা। জেএফকে তথা জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম রাষ্ট্রপতি। ১৯৬১ সালে ৩৪তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার বিদায় নিলে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে সে বছরেই শপথ গ্রহণ করেন তিনি।
২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের ঠিক ১০৩৬ দিনের মাথায় ১৯৬৩ সালের ২২শে নভেম্বর, শুক্রবার, টেক্সাসের ডালাসে আনুমানিক দুপুর ১২.৩০ এর দিকে আততায়ীর গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন কেনেডি। সেখান থেকে নিকটস্থ পার্কল্যান্ড হসপিটালে তাকে নিয়ে যাওয়া হলে ৩০ মিনিট পর কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তার মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মাথায়ই লি হারভি অসওয়াল্ড নামে এক ব্যক্তি আততায়ী হিসেবে অভিযুক্ত হয় এবং ধরাও পড়ে পুলিশের হাতে। তবে, পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ এবং আদালতে বিচারের প্রারম্ভেই তাকে প্রাণ হারাতে হয় জ্যাক রুবি নামের আরেক আততায়ীর হাতে, যে কিনা ডালাসের অন্ধকার জগতে জুয়া, মাদক চালান, নারী দালালি প্রভৃতি দুষ্কৃতির জন্য পরিচিত ছিল। অসওয়াল্ডের মৃত্যুর সাথে সাথে রাষ্ট্রপতির মৃত্যু রহস্য উদঘাটনের সরল সোজা পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতির মৃত্যু এবং ক্ষণকাল পরে তার হন্তারকেরও মৃত্যু সবটা মিলিয়ে আশ্চর্য এক ধুম্রজালের সৃষ্টি হতে থাকে।
কেনেডির সময়ে উপ-রাষ্ট্রপতি থাকা লিন্ডন জনসন তার মৃত্যুর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আর্ল ওয়ারেন এর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠনের আদেশ দেন এবং কমিশনকে এই ঘটনার সুচারু তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেন।
১৯৬৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ওয়ারেন কমিশন রাষ্ট্রপতি জনসনের কাছে ৮৮৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় এবং তিন দিন পর এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। যাবতীয় তথ্য প্রমাণাদি নিরীক্ষণ করে কমিশন এই উপসংহারে পৌঁছায় যে, আততায়ী অসওয়াল্ড একাই এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী আর এর সাথে অন্য কোনো চক্রান্ত জড়িত নেই। উদঘাটিত হয় কেনেডির হত্যারহস্য।
কিন্তু আসলেই কি উদঘাটিত হয় রহস্যটি? সেই ঘটনাই ব্যক্ত হয়েছে অলিভার স্টোনের পরিচালনায় নির্মিত JFK (1991) চলচ্চিত্রে। সত্য ঘটনার ওপর নির্মিত এই চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা কেভিন কস্টনার। তারকায় ঠাসা ১৮৮ মিনিটের (ডিরেক্টরস কাট ২০৬ মিনিট) এই চলচ্চিত্রে পার্শ্ব চরিত্রে আরও অভিনয় করেন গ্যারি ওল্ডম্যান, টমি লি জোন্স, জো পেসচি, ডোনাল্ড সাদারল্যান্ড, জ্যাক লেমন প্রমুখ। গল্পের চিত্রনাট্য লেখা হয় প্রধান চরিত্র নিউ অরলিন্সের ডিসট্রিক্ট এটর্নি জিম গ্যারিসন রচিত On the Trail of the Assassins এবং জিম মার্স রচিত Crossfire: The Plot That Killed Kennedy এ দুই বইয়ের ওপর ভিত্তি করে।
মুক্তি পাওয়ার পর প্রাথমিকভাবে এটি স্বল্পগতিতে আয় করা শুরু করলেও কিছুকাল পরে আলোচক সমালোচক দর্শক নির্বিশেষে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। মুক্তির ১ম সপ্তাহে বক্স অফিসে এর অবস্থান ছিল Beauty and the Beast (1991) এর সাথে যৌথভাবে ৫ম, যা এই চলচ্চিত্রের বাজেটের (৪০ মিলিয়ন ইউএস ডলার) সাথে কোনভাবেই সমার্থক বলা চলে না। কিন্তু, পরবর্তী সপ্তাহেই এটি গতিপ্রাপ্ত হয় এবং দর্শক টানতে শুরু করে। অচিরেই তিন সপ্তাহের মধ্যে নির্মাণাধীন বাজেটকে ছাড়িয়ে ৫০ মিলিয়ন ডলারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় আর শেষ পর্যন্ত সারাবিশ্বে ২০০ মিলিয়নেরও অধিক আয় করতে সমর্থ হয় এবং ক্লাসিক একটি রোমাঞ্চ ঘরানার রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হিসেবে আখ্যা পায়।
কাহিনীসংক্ষেপ
নিউ অরলিন্সের নির্বাচিত রাষ্ট্রপক্ষের বর্ষীয়ান উকিল তথা ডিসট্রিক্ট এটর্নি জিম গ্যারিসন নিজের দপ্তরে বসে শুনতে পান রাষ্ট্রপতি কেনেডির গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর। আততায়ী হিসেবে অসওয়াল্ড অভিযুক্ত হলে তিনি তার অধীন কর্মচারীদের নির্দেশ দেন অসওয়াল্ডের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের জন্য। সেখান থেকে সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে তারা একজনকে ফেডারেল অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রেরণ করলেও অসওয়াল্ডের আকস্মিক মৃত্যু হলে গ্যারিসন এই তদন্ত কার্যক্রমে ইস্তফা দেন।
ইস্তফা দিলেও এটি তার মন থেকে পুরোপুরি যে মুছে যায়নি তা বোঝা যায় তিন বছর পর তিনি যখন হত্যাকাণ্ডের ওপর ওয়ারেন কমিশনের ৮৮৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন নিরীক্ষণ করতে শুরু করেন। আইনের লোক হওয়ার সুবাদে আর এমনধারা তদন্ত কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকার কারণে প্রায় সাথে সাথেই প্রতিবেদনে বেশ কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি তার চোখে পড়ে, যা তাকে একরকম ধাক্কা দেয় এবং পুনরায় তদন্ত শুরু করতে উৎসাহ যোগায়। সেখান থেকেই এগোতে থাকে সিনেমার গল্প।
এ চলচ্চিত্রে বহুল আলোচিত কেনেডি হত্যাকাণ্ড এবং এর বিশ্লেষণকে দেখা যাবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও একগুঁয়ে ধরনের মানুষ জিম গ্যারিসনের চোখ ও মন দিয়ে। এই চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা যেকোনো রাষ্ট্রেরই একজন সচেতন সাধারণ নাগরিককে অনেক প্রশ্নের যোগান দেবে, তার অবস্থান ও অধিকার সম্বন্ধে ভাবতে শেখাবে।
আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী
রোমাঞ্চ ঘরানার ১৮৮ মিনিটের এই চলচ্চিত্রে শ্বাসরুদ্ধকর কোনো দৃশ্য নেই, নেই দুর্দান্ত কোনো ক্লাইম্যাক্স অথবা মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত কোন টুইস্ট। কিন্তু, তারপরও ১৮৮ মিনিটের পুরোটাই গল্পের সাথে আটকে থাকতে বাধ্য হবেন দর্শক, এমনভাবেই করা হয়েছে এর বুনন। দৃশ্যের গঠন এবং পটের পরিবর্তনে নিপুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। এতে করে একবার মজে গেলে শেষ দৃশ্য অতিক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত দর্শক নড়তে চড়তেও ভুলে যাবেন, এমনই এর আবেদন।
একবার দেখে ফেলার পর এর গুণবিচারে দর্শককে আশ্রয় নিতে হবে আসল ঘটনাক্রমের, বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে নিজের বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী, এবং এ দিকটাই এই চলচ্চিত্রটিকে করে তুলেছে অতুলনীয়। গল্পের ছলে এগোনোর পাশাপাশি এটি আসলে দর্শককেও ভাবাবে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন করবে তাকেও। সর্বোপরি, দর্শক নিজেকে আবিষ্কার করবেন পরিচালকের কাঠগড়াতেই।
পুরস্কার এবং মনোনয়ন
চলচ্চিত্রটি অস্কারে ৮টি বিভাগে মনোনয়ন পায়- সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পার্শ্ব চরিত্র (পুরুষ), সেরা পরিচালক, সেরা আবহসঙ্গীত, সেরা সাউন্ড মিক্সিং, সেরা চিত্রগ্রহণ, সেরা চলচ্চিত্র সম্পাদনা এবং সেরা অনুলিখিত চিত্রনাট্য (অ্যাডাপ্টেড স্ক্রিনপ্লে)। সেরা চিত্রগ্রহণ এবং সেরা চলচ্চিত্র সম্পাদনা এ দুটি বিভাগে অস্কার জিতে নেয় ১৯৯১ সালের ২০ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটি।
আলোচনা ও সমালোচনা
যেকোনো সত্য ঘটনা কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনার ভিত্তিতে নির্মিত কোনো চলচ্চিত্রের জন্য প্রধান না হলেও অন্যতম একটা শর্ত থাকেই যেন তথ্য উপাত্তের সন্নিবেশে কোনো কারচুপি করা না হয় এবং এ দিকটিতে একেবারে ত্রুটিহীন নয় এই চলচ্চিত্রটি। মুক্তি পাওয়ার পর অনেকেই এর পরিচালক স্টোনকে দুষেছেন এর স্পর্শকাতর বিষয়বস্তু এবং সংলাপের জন্য, অনেকে তার বিবেক বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করতেও পিছপা হননি। এমনকি মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই এত বড় আকারে এটি নিয়ে মিডিয়াতে জোর সমালোচনা চলছিল যে পরিচালককে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পাশাপাশি এর থেকে উৎপত্তি হওয়া সমালোচনার জবাব দেয়ার জন্যও সময় রাখতে হয়েছিল।
এত সব ঘটনার পরও মুক্তি পাওয়ার পর সামগ্রিকভাবে দর্শকরা এটিকে ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করে এবং সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটি ক্লাসিকের মর্যাদা লাভ করতে সমর্থ হয়। কেননা, চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র গ্যারিসনের মতোই পরিচালকও আসলে পুরোটা সময় জুড়ে হত্যাকাণ্ডের পেছনে দায়ী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীটিকে নয়, বরং এর জন্য দায়ী কারণটি বা কারণগুলোকেই অনুসন্ধান করে ফিরেছেন, বুঁদ হয়ে থেকেছেন সত্যের নেশায়, বসবাস করতে চেয়েছেন ভয়ডর বিহীন সমাজে। আর চেয়েছেন একই ভাবনা বহমান হোক দর্শকের মনের গহীনে।