১৯৫৫ সালে যখন ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম রিলিজ পায়, তখনো সত্যজিৎ রায় কোনো সিক্যুয়েল বানানোর কথা ভাবেননি। ‘পথের পাঁচালী’ র ব্যাপক জনপ্রিয়তার পর অপু চরিত্রটি নিয়ে আরও কাজ করার কথা মাথায় এসেছিল সত্যজিতের। তারই ফলস্বরূপ নির্মিত হয়েছে ‘অপরাজিত’। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের শেষ অংশ এবং ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের শুরুর এক তৃতীয়াংশের গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ সিনেমাটি। প্রথম ছবির মতো তিনি উপন্যাসের কাহিনী পুরোপুরি অবলম্বন না করে নিজের মত করে চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন তাঁর এই দ্বিতীয় সিনেমাটির জন্য।
‘পথের পাঁচালী’ সিনেমাটি পুরোটা একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও ‘অপরাজিত’ সিনেমাটি জুড়ে রয়েছে বাংলার গ্রাম, কাশী আর কোলকাতার অলি-গলি। পুরোটাই একটা জার্নির মাঝ দিয়ে যায়, সেইসাথে অপুর মানসিকতাও। ‘অপরাজিত’ সিনেমার প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায়, নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে কাশীর উদ্দেশে যাত্রা করা ট্রেনের জানালা দিয়ে ছুটে চলা নদী, গ্রাম, ব্রিজ, তেপান্তর। এরপর চলে যায় কাশীর গঙ্গার ধারে, সেখানের জীবনযাত্রাতে। এরপরের দৃশ্যে দেখা যায় পরিচিত মুখ, সর্বজয়াকে (করুণা ব্যানার্জি), কাশীর একটি পুরাতন বাড়ির উঠানের মাঝে।
বৃষ্টির ভয়ে অপরাজিত সিনেমার আর্ট ডিরেক্টর বানসী চন্দ্রগুপ্ত এই উঠানবাড়ির সেট খোলা আকাশের নিচে না বানিয়ে কোলকাতার স্টুডিওতে বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্র, চন্দ্রগুপ্ত আর সত্যজিৎ দু’জনকেই বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে বাইরের আলোটা স্টুডিওতে তৈরি করা সম্ভব না। কিন্তু সত্যজিৎ ছিলেন নাছোড়বান্দা। তাই সুব্রত সিনেমাটোগ্রাফিতে প্রথম বাউন্স লাইটিংয়ের ব্যবহার উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানে আকাশের বদলে সাদা কাপড়ের উপর আলোর রিফ্লেকশনকে ব্যবহার করে খোলা আকাশের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল, যা আগে কখনো সিনেমাতে করা হয়নি।
সিনেমারে হরিহর (কানু ব্যানার্জি) কাশীতে গঙ্গার ঘাটে বেদপাঠ করে রোজগার করেন, আর এখানে স্কুল না থাকায় সারাদিন পাড়া বেড়িয়ে, এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায় অপু (পিনাকি সেনগুপ্ত)। অপু আর সর্বজয়া মন্দিরে সন্ধ্যাপূজা দেখতে গেলে, সর্বজয়া মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে আর তার বিপরীতে অপু অনেকটাই ভাবলেশহীন। মা-ছেলের চিন্তার পার্থক্য স্পষ্ট হয়েছে সিনেমার শুরু থেকেই। এরপর দোসরার দিন সারা ঘর যখন প্রদীপ দিয়ে সাজানো হয়, হরিহর ঘরে ফিরেই শুয়ে পড়েন অসুস্থ বোধ করায়। অপু এলে হরিহর ছেলেকে নিজের কাছে ডেকে নেন। এ দৃশ্যে হরিহর আর অপুর সম্পর্ক অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যজিৎ। পরদিন সকালে সর্বজয়ার নিষেধ সত্ত্বেও ঘাটে যায় হরিহর, সেখান থেকে ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে যায়। এবং ভোরবেলা গঙ্গার জল মুখে নিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
হরিহরের মৃত্যুকে সত্যজিৎ খুব সহজভাবে দেখিয়েছেন, এমনকি মৃত্যু পরবর্তী কোনো শোকের মাতমও দেখা যায় না। বরং তার থেকে বড় হয়ে যায় যেন বাস্তবতা, বেঁচে থাকার লড়াই।
সর্বজয়া একটা বাড়িতে রান্নার কাজ নেয়, সেখানে অপুকে দেখা যায় কর্তার মাথা থেকে পাকা চুল বেছে দিতে; যার বিনিময়ে দু পয়সা পায়। অপুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে সর্বজয়া রান্নার কাজ ছেড়ে তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের গ্রামে গিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সিনেমার কাহিনীর এই অংশটি বিভূতিভূষণের মূল উপন্যাস থেকে স্বতন্ত্র হয়ে গেছে। মূল উপন্যাসে যে বাড়িতে কাজ করত, সে বাড়ির মেয়ে লীলার একটি চরিত্র আছে, যার সাথে অপুর ভাব ছিল। সত্যজিৎ রায়ের ‘লীলা’ চরিত্রের জন্য বহু অভিনয় শিল্পী খুঁজে একজনকে পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু সেই মেয়েটির বাগদত্তা সত্যজিৎকে শাসিয়ে যাওয়ায় তাকেও বাদ দিতে হয়। পরে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য থেকেই চরিত্রটি বাদ দিয়ে দেন। যদিও তার মনে সন্দেহ ছিল যে, লীলা চরিত্রটি বাদ দিলে কাহিনীতে অসামঞ্জস্য আসতে পারে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার মন থেকে সে সন্দেহও দূর হয়।
গ্রামে যাবার পর অপুর জীবনে আবার ফিরে আসে ছোটবেলার সেই ট্রেন। তাদের নতুন ঘরের দরজায় দাঁড়িয়েই ট্রেনের ছুটে যাওয়া দেখা যায়। পরদিন থেকে অপুর পুরোহিত হবার পাঠ শুরু হয়, কিন্তু সেখান থেকে ফেরার পথে গ্রামের ছেলেদের স্কুলে যেতে দেখে বাড়িতে জিনিসপত্র রেখে সে ছুটে যায় স্কুলের দিকে। রাতের বেলা মুখ ভার করে শুয়ে থাকলে সর্বজয়া তাকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে। অপু জানায় স্কুলে পড়তে চাওয়ার কথা। পুরোহিত হবার পাঠের পাশাপাশি চলতে থাকে অপুর স্কুলে যাওয়া। এর মাঝেই পাঁচ- ছয় বছর কেটে যায় এবং গল্পে দেখা যায় কিশোর অপুকে, যার চরিত্রে অভিনয় করেছেন, স্মরণ ঘোষাল। অপু জেলাতে সেকেন্ড হওয়ায় কোলকাতাতে কলেজে পড়তে যেতে চায়, একথা মাকে জানানোর পর মা-ছেলের মাঝে দেখা যায় মানসিক টানাপোড়েন।
অপু অবাধ্য হলে রাগের মাথায় সর্বজয়া অপুকে চড় মারে, যার কারণে সে রাগ করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। প্রায় সাথে সাথেই সর্বজয়া অনুতপ্ত হয়ে ছেলেকে খুঁজে বুঝিয়ে ঘরে নিয়ে আসে এবং কোলকাতা যাবার অনুমতি এবং শুরুর খরচ দিতে রাজি হয়। সেটা শুনে অপু অনেক বেশি খুশি হয়ে যায়, ‘হুররে’ বলে সে বাইরে এলে অপুর পুরো মুখটা ক্যামেরাতে দেখা যায়। এখান থেকেই মূলত একটি পরিবারের কাহিনী থেকে সিনেমার কাহিনী পুরোপুরি অপুকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।
সর্বজয়াকে সে সদ্য পাওয়া গ্লোবের মাঝ থেকে দেখায় যে, এটা পৃথিবী, আর দাগগুলো একেকটা দেশ আর ক্ষুদ্র একটা বিন্দু হচ্ছে কোলকাতা, সর্বজয়া কিছুই বুঝতে পারে না; কিন্তু বোধ করতে পারে, অপু আর তার পৃথিবী যে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সেটি আরো ভালোভাবে প্রকাশ পায়, অপু চলে যাবার পর সর্বজয়ার মুখের হাসি মিলিয়ে যাবার মধ্য দিয়ে।
এরপর মা-ছেলের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে কাহিনী এগোতে থাকে। কোলকাতা থেকে প্রত্যেকবার ফেরার পর যেন মায়ের থেকে আরও দূরে সরে যেতে থাকে অপু। সর্বজয়া নিজেও বুঝতে পারেন, ছেলে যে তার গণ্ডির মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই, তাই প্রতিবার ফিরলে কোলকাতার সব গল্প শুনতে চান তিনি; কিন্তু, অপুর গল্প বলার আগ্রহ সময়ের সাথে কমে যায়। এদিকে অপুর মনের মাঝেও দায়িত্ববোধের টানাপোড়েন দেখা যায়।
কোলকাতাতে ছাপাখানায় কাজ করে, পড়াশোনা করে মায়ের জন্যই যেন গ্রামে ফিরে আসে, যেখানে তার মন টেকে না একেবারে। সর্বজয়ার জন্যই অপু একবার ট্রেন ছেড়ে আরও একটা দিন থেকে যায় মায়ায় বাঁধা পড়ে। এদিকে সর্বজয়া ছেলের পড়ালেখার ক্ষতি হবে ভেবে নিজের অসুস্থতার কথা জানায় না। যখন অপু জানতে পারে, তখন ফিরে এসে আর সর্বজয়াকে পায় না।
মাকে হারানোর শোকে প্রথম ধাক্কায় কান্নাকাটি করলেও পরমুহূর্তেই বুঝতে পারে। তার সব মায়ার বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে, এ যেন এক অদ্ভুত স্বাধীনতা। পরের দিন সকালেই গ্রাম ছেলে চলে যাবার দৃশ্য দিয়ে সিনেমাটি শেষ হয়।
দেশে ‘অপরাজিত’ সিনেমাটি ‘পথের পাঁচালীর’ মতো জনপ্রিয়তা লাভ না করলেও, দেশের বাইরে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে এই সিনেমাটি। পরিচালক মৃণাল সেন আর ঋত্বিক ঘটকের মতে, সত্যজিতের অন্যতম সেরা কাজ ‘অপরাজিত’ সিনেমাটি। ‘অপরাজিত’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে দুই-দুইটি পুরস্কার পেয়েছে, সেই সাথে নিউইয়র্কে প্রায় আট সপ্তাহ ধরে প্রদর্শনী চলেছে।
বাংলা সিনেমায় সত্যজিতের এই গল্প বলার ধারাটা আগে কখনো দেখা যায়নি, পরিচিত গল্পগুলোই অপরিচিতের মাধুর্যে তুলে ধরেছেন তিনি। সত্যজিতের নানা সন্দেহকে সরিয়ে এই সিনেমা বাংলা সিনেমায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। মায়ের মমতা বা ছেলের বিনয়ের ঊর্ধ্বেও মা ছেলের সম্পর্কের যে গভীরতা, তা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন এই সিনেমাতে। সেইসাথে নিশ্চিন্দিপুরের অপু থেকে পুরোপুরি কোলকাতার অপু হয়ে যাবার যাত্রাও এটি।
সত্যজিৎ রায় এর বই সমূহ দেখতে ভিজিট করুন রকমারি ডট কমে।