সুপারম্যানের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ব্যতিক্রমী সংস্করণ

‘সুপারহিরো’ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ও অটুট মনোবলে সমৃদ্ধ এক ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। আর দশটা সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষমতাগুলোর অভাব, তার মধ্যে সেই অতিমানবীয় ক্ষমতাগুলোই আপাদমস্তক বিদ্যমান। নির্ভীক, অকুতোভয়, আচারনিষ্ঠ, দুর্দমনীয় গোছের কাল্পনিক সুপারহিরোদের কাজই হলো পৃথিবীর অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। তা হোক সেই পৃথিবীবাসী সন্ত্রাস কিংবা ভিনগ্রহী প্রাণীর বিরুদ্ধে। আজ থেকে প্রায় ৮২ বছর আগে, ১৯৩৮ সালে প্রথমবারের মতো অ্যাকশন কমিকসের মাধ্যমে, পাঠকরা সুপারম্যানের সাথে পরিচিত হয়। লাল-নীল কস্টিউম সম্বলিত, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম জনপ্রিয় সুপারহিরো হলো সুপারম্যান। তাকে ‘সিম্বল অভ হোপ’ বা ‘আশার প্রতীক’ বলেও ডাকা হয়। শৈশবে কাঁধে গামছা বেঁধে সুপারম্যান হয়ে আকাশে উড়তে চেয়েছে, এরকম মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

সুপারহিরো জঁনরাকে আলোর মশাল দেখিয়ে ৮০টা বছর পার করলেও, তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি একটুও। বরং সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে। সর্বদা সত্যের জয়গান গেয়ে, এক হাতে শত্রুনাশ এবং অপর হাতে ইনসাফের ঝাণ্ডা গাড়ায় খ্যাতি আছে তার। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সুপারম্যানের কিংবদন্তি পুনর্লিখিত হলেও মূল রয়ে গেছে একই। তাই, কমিক-বুক রাইটাররা পাঠকদের রেসিপিতে ভিন্ন-মাত্রার স্বাদ যুক্ত করতে, সুপারম্যানের বিভিন্ন ব্যতিক্রমী সংস্করণকে তুলে এনেছেন বিভিন্ন সময়। সুপারহিরোর জগতে ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তায় শ্রেষ্ঠত্বের আসনের অন্যতম দাবিদার এই সুপারহিরোর কিছু ব্যতিক্রমী সংস্করণই আজ আমাদের আলোচনার মুখ্য বিষয়।

সুপারবয়

সুপারবয় নামে ডিসি ইউনিভার্সে অনেক চরিত্রের অস্তিত্ব বিদ্যমান। যেমন- যুবক ক্লার্ক কেন্ট, প্যারালাল ওয়ার্ল্ড-এর সুপারবয় বা সুপারম্যানের ভবিষ্যৎ সন্তান। কিন্তু এখন আমরা ‘কন-এল’-এর দিকে খানিকটা আলোকপাত করব। সে মূলত কনার কেন্ট নামেও পরিচিত। সুপারবয়কে আসলে সুপারম্যানের কপিই বলা চলে। লেখক কার্ল কেসেল ও শিল্পী টম গ্রামেটের হাত ধরে ১৯৯৩ সালের জুন মাসে ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অভ সুপারম্যান’ এর মাধ্যমে প্রথম সুপারবয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৯৩ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তাকে মেটা-হিউম্যান ক্লোন হিসেবে ডিসি গল্প সাজালেও ২০০৩ থেকে এ পর্যন্ত তাকে ক্রিপ্টোনিয়ান হাইব্রিড হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

সুপারম্যান মারা যাওয়ার পর সবাই ভেবেছিল, তার বিস্তৃত সাম্রাজ্য তারই কোনো এক ক্লোন দখল করবে। অন্যান্য সুপারবয়দের মতো, কন-এল হলো একজন কিশোর, যার মধ্যে এক ক্ষুব্ধ কিশোরের আদ্যোপান্ত বিদ্যমান। ফলে উগ্রতা বাসা বাধে তার স্বভাবে এবং ক্রমে সে হয়ে ওঠে বেপরোয়া। সুপারবয়ের মধ্যে সুপারম্যানের শক্তি থেকে শুরু করে দুর্ভেদ্যতা- মোটামুটি সবই বিদ্যমান। তবু মাঝে মাঝে সে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায়। সুপারম্যান একবার মৃত্যুপুরী থেকে ফিরে এলে সুপারবয় ‘টিন টাইটান্স ‘ও ‘ইয়ং জাস্টিস’-এ যোগ দিয়ে হয়ে ওঠে দলের অতন্দ্র প্রহরী।

সুপারবয়; Image Source: dccomics.com

সাইবর্গ সুপারম্যান

ডিসি ইউনিভার্সে সাইবর্গ সুপারম্যানের মূলত দুটি ভার্সন দেখা যায়। এদের মধ্যে জনপ্রিয় ও প্রথমটি হলো নভোচারী হ্যাংক হেনশ-র কাহিনী। ১৯৯০ সালের মে মাসে অ্যাডভেঞ্চার্স অভ সুপারম্যান-এ সর্বপ্রথম আবির্ভাব ঘটে তার। একবার মহাকাশ গবেষণার সময় সোলার ফ্লেয়ার হেনশ-র নভোযানকে আঘাত করলে তিনি এবং তার দলবল মিউট্যান্ট হয়ে উঠতে শুরু করেন। এই মিউটেশনের প্রভাব এতই শক্তিশালী ছিল যে, পৃথিবীতে ফিরে আসার পর দলবলসহ হেনশ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। সোলার ফ্লেয়ারে শরীর ক্ষয়ে যাওয়ার আগেই নাসার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি ‘চেতনা’ আপলোড করতে সক্ষম হন। বার্থিন ম্যাট্রিক্সের সাহায্যে তিনি একটি সাইবার বডি তৈরি করেন, যাতে সুপারম্যানের সকল ক্ষমতাই ছিল।

পরে হেনশ একসময় বুঝতে পারেন, এই সোলার ফ্লেয়ারের কারণ ছিল খোদ সুপারম্যান। সুপারম্যানের উপর সকল দোষের বোঝা চাপিয়ে সাইবর্গ সুপারম্যান প্রতিশোধের নেশায় হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকেন। আর জর-এল নামে নতুন সাইবর্গ সুপারম্যানের সাথে পাঠকরা পরিচিত হয় ‘নিউ-৫২’ রিলঞ্চের পর। সেখানে সাইবর্গ সুপারম্যান ধ্বংস-প্রায় ক্রিপ্টন গ্রহ থেকে কোনোরকমে বেঁচে যায়। তার মধ্যে সুপারম্যানের প্রায় সকল ক্ষমতাই বিদ্যমান। হেনশ-র মতো সে-ও চায়, সুপারম্যানকে অসহনীয় যন্ত্রণা দিয়ে তিলে তিলে মেরে ফেলতে।

সাইবর্গ সুপারম্যান; Image Source: vocal.media

সুপারম্যান: রেড সন

সুপারম্যান যে কমিক বইয়ের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র, তা মোটামুটি ইন্টারনেট জগতে খোঁজ রাখা সবারই জানা। সকল সুপার-পাওয়ার থাকা সত্ত্বেও সে বরাবরই পৃথিবীর সকল মানবহিতৈষী কাজে এগিয়ে এসেছে। পৃথিবীতে বাঁচতে চেয়েছে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই। ভালো-মন্দের ফারাকটা সে ভালো  করেই জানে। সে কখনোই তার ক্ষমতার অপব্যবহার করতে চায়নি। আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতার গুণাবলী ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে ফুটে উঠতে শুরু করে। সুপারম্যানের এমনই এক ভার্সনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে উপস্থাপন করেছে ডিসি কমিকস। ২০০৩ সালে মার্ক মিলারের হাত ধরে “সুপারম্যান সোভিয়েত ইউনিয়ন বেড়ে উঠলে কেমন হতো?” এই শিরোনামে ‘সুপারম্যান: রেড সন’ পাঠকমহলের সামনে উঠে আসে।

ক্যানসাসে রকেট শিপ ক্র‍্যাশ করার বদলে পতিত হয় ইউক্রেনের এক শস্য খামারে। ইউরোপ জুড়ে তখন বাজছে স্নায়ুযুদ্ধের দামামা। এ গল্পে সুপারম্যান সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতি ও আদর্শ নিয়ে বেড়ে ওঠে এবং বিশ্ববাসী সোভিয়েত ইউনিয়নের গোপন অস্ত্র হিসেবে দেখা পায় এক সুপার-পাওয়ার এলিয়েনের। বুকে ‘S’ আকৃতি লোগোর বদলে থাকে ‘হাতুড়ি-কাস্তে’। এই কমিক বুক মিনি সিরিজটি সমালোচক ও দর্শক উভয় মহলেই জনপ্রিয়তা কুড়ানোর পর ২০০৪ সালে আইজনার অ্যাওয়ার্ড-এ সেরা লিমিটেড সিরিজের তালিকায় মনোনয়ন পায়।

অ্যানিমেশনে সুপারম্যান: রেড সন; Image Source: syfy.com

ক্যালভিন এলিস

ডিসি মাল্টিভার্সের অসীম ব্যাপ্তির দরুন ডিসি কমিকসে লক্ষ-কোটিরও বেশি প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব রয়েছে, যেটি দিয়ে মুহূর্তেই যেকোনো কাহিনী বানিয়ে ফেলা সম্ভব। এর ফলে রিয়েলিটি আর ফ্যান্টাসি বার বার হয়েছে মুখোমুখি। তেমনি ২০০৯ সালের মার্চে, গ্র্যান্ট মরিসন আর ডোগ ম্যাঙ্গের হাত ধরে ফাইনাল ক্রাইসিসের ৭ নং ইস্যুতে আবির্ভাব ঘটে কেলভিন এলিসের। মাল্টিভার্সের ভিন্ন এক পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকে সে। জরেল ও লারার কোল আলো করে ক্রিপ্টনের রাজধানী ভ্যাটলো আইল্যান্ডে জন্ম নেয় কালেল। ক্রিপ্টন গ্রহ তখন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায়, শিশু কালেলকে পাঠানো হয় মাল্টিভার্সের এক মলয়শীতলা পৃথিবীতে। চিরচেনা সুপারম্যানের মতো সে-ও এক গরিব পরিবারে বেড়ে ওঠে। হলুদ সূর্য থেকে শক্তি নিয়ে সে হয়ে ওঠে সুপারম্যানের মতোই শক্তিশালী। সেই সাথে নিযুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে।

ক্যালভিন এলিস; Image Source: themarysue.com

কথিত আছে, কেলভিন এলিসের চরিত্রটি সাবেক যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার থেকে অনুপ্রাণিত। একইসাথে দায়িত্ব ও অসীম ক্ষমতার বোঝা কাঁধে নিয়ে হয়ে এই চরিত্রটি ওঠে মাল্টিভার্সের এক ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব।

সুপারম্যানের প্রতিকৃতির সামনে বারাক ওবামা; Image Source: researchgate.net

সুপারম্যান এক্স

সুপারম্যান এক্স মূলত ৪৩ শতাব্দীতে তৈরি সুপারম্যানের একটি ক্লোন। আসল সুপারম্যানের ডিএনএ-র ক্লোন হওয়ায়, সুপারম্যানের সকল ক্ষমতাই সুপারম্যান এক্স-এ বিদ্যমান, বরঞ্চ আরও কয়েকটা বেশিও আছে। সে এনার্জি ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে এনার্জি শিল্ড, এনার্জি ব্লেড তৈরির পাশাপাশি এনার্জি রেজিস্টেন্সেও সক্ষম। আসল সুপারম্যান ছেলেবেলা থেকে নৈতিকতা পোষণ করে বেড়ে উঠলেও এই সুপারম্যান এক্স একটু ব্যতিক্রম। সে তার ক্ষমতা ভালো কাজেই ব্যবহার করতে চাইলেও, মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর ও বেপরোয়া হয়ে যায়। কার্যসিদ্ধির জন্য সে যেকোনো কিছু করতে রাজি থাকে।

ব্রিয়ানিক- ৫ এর মতে সে হলো একটা ‘লুজ ক্যানন’। তার এই বেপরোয়া স্বভাব নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই সে ‘দ্য লিজিয়ন অভ সুপারহিরোজ’-এ যোগ দেয়। সুপারম্যান এক্সের মধ্যে সুপারম্যানের কোনো দুর্বলতা নেই। ক্রিপ্টোনাইট তো তাকে দুর্বল করতে পারেই না, বরং তার শরীরই ক্রিপ্টোনাইটের রেডিয়েশন থেকে তৈরি। তবে রেড সান রেডিয়েশন এবং জাদুতে সে বিশেষভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।

সুপারম্যান এক্স; Image Source: tejeda.blogspot.com

সুপারম্যান রেড/সুপারম্যান ব্লু

একটা সময়ে মেট্রোপলিস শহরে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেলে, সুপারম্যানকে অনেকে তোয়াক্কা করত না। যেহেতু একজন সুপারম্যানের ভয় শহরের অপরাধীদের গায়ে লাগছে না, তাই দুজন সুপারম্যানের আবির্ভাব ঘটালে কেমন হয়? মোটামুটি এমন মানেরই একটা স্টোরিলাইন ১৯৬৩ সালে ডিসি কমিকসের হাত ধরে উঠে এসেছিল, যেখানে সুপারম্যান দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। পৃথিবীকে অপরাধমুক্ত রাখার পাশাপাশি সুপারম্যান এমন এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিল, যেটা তার বুদ্ধি ও ক্ষমতা দুটোই বাড়াতে সাহায্য করবে। কিন্তু যন্ত্রের অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দরুন সুপারম্যান লাল ও নীল, দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। দুজন ভিন্ন ভিন্ন সুপারম্যানের সুপারপাওয়ারের ফলে, সম্মিলিত সুপারম্যান সত্ত্বাটা হয়ে ওঠে আরও শক্তিশালী।

এছাড়া তারা ওদের শক্তি ব্যবহার করেছে ক্রিপ্টোনিয়ান শহর ক্যান্ডর বড় পরিসরে গড়ার জন্য। তারা পানির নিচে আলাদা নতুন এক জগত তৈরি করে, যা সরাসরি আটলান্টিসের সাথে সংযুক্ত। মূল উদ্দেশ্য একটাই, সকল গুরুতর রোগের প্রতিষেধক বের করা। দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেলেও তাদের মধ্যে প্রেমাবেগের ধারা বয়ে চলছিল অবিরত। এদের মধ্যে রেড সুপারম্যান পছন্দ করত লোয়েস লেনকে, আর অন্যজন ছিল লানা-ল্যাংয়ের জন্য পাগল।

সুপারম্যান রেড/সুপারম্যান ব্লু; Image Source: nerdist.com

সুপারম্যান: দ্য ডার্ক সাইড

ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্রিপ্টন থেকে পাঠানো ক্রিপ্টোনিয়ান শিপ যদি ক্যানসাসে পতিত না হয়ে, অন্য কোনো গ্রহ বা দেশে পড়ত, তবে কেমন হতো সেই কাহিনী? ১৯৯৮ সালে জন ফ্রান্সিস মোরে ও কিয়েরন ডুয়েরের হাত ধরে ডিসি কমিকসে মাসিক লিমিটেড সিরিজ, ‘সুপারম্যান: দ্য ডার্ক সাইড’ আত্মপ্রকাশ করে সেরকমই এক স্টোরিলাইনের মোড়কে। গল্পে কাল-এল এর শিপ পথভ্রষ্ট হয়ে ডার্কসাইডের শাসিত গ্রহ ‘অ্যাপোক্যালিপ্স’-এ গিয়ে পৌঁছে। ডিসি কমিকসের অন্যতম সেরা এই ভিলেন পেলে-পুষে নিজ হাতে বড় করে তোলে কাল-এলকে। এমনিতেই সাধারণ সুপারম্যান কোনোরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই কত শক্তিশালী! তার উপর যদি ডার্কসাইডের মতো সুঠাম, প্রশিক্ষিত মার-কাটারি ভিলেনের থেকে শিক্ষা নেয়, তাহলে ব্যাপারটা কী ভয়ানক হতে পারে, তা ভাবাও যেন দায়। ক্রমে ক্রমে সুপারম্যান হয়ে ওঠে ধ্বংসযজ্ঞের এক চরম হাতিয়ার। যেন ডার্কসাইডের অশুভ এক ছায়া ছেয়ে যায় সুপারম্যানের অন্তরাত্মাকে।

দ্য ডার্ক সাইডকে সুপারম্যানের মন্দ দোষেই দোষারোপ করা যায়। শক্তপোক্ত স্যুটের বদলে গায়ে ফোলা-ফাঁপা এক স্যুটই হয়ত অশুভ কুহেলিকার হাতছানি দেয়। বুকের মধ্যে ‘S’ আকৃতির লোগোর বদলে থাকে ‘SS’, যা অনেকটা বিজলির মতো দেখায়। অশুভ শক্তি ধীরে ধীরে মনকে আচ্ছাদিত করে ফেলায় তাকে ‘গড অভ ইভিল’ও বলা হতো। সকল ক্রিপ্টোনিয়ান ক্ষমতার পাশাপাশি মাস্টার কম্ব্যাটেন্ট ও মাস্টার সোর্সম্যানেও সে ছিল সমানভাবে দক্ষ। যে কারণেই হোক, সুপারম্যান একটা সময় বুঝতে পারে, সে ভুল পথে আছে এবং মনে সুবুদ্ধির উদয় হয়। ফলে সে ডার্কসাইডকে হারানোর সিদ্ধান্তে মনস্থির করে ফেলে। ডার্কসাইডকে হারানোর পর সুপারম্যান হয়ে ওঠে ‘অ্যাপোক্যালিপ্স’ গ্রহের শাসক, এরপর সে মনোনিবেশ করে বংশবৃদ্ধিতে।

সুপারম্যান দ্য ডার্ক সাইড; Image Source: villains.fandom.com

ইনজাস্টিস: গডস অ্যামং আস সুপারম্যান

ডিসি কমিকস এ পর্যন্ত যে যে স্টোরিলাইন পাঠকদের উপহার দিয়েছে, এর মধ্যে ‘ইনজাস্টিস: গডস অ্যামং আস’-কে অন্যতম সেরাদের কাতারে ফেলা যায় অনায়াসে। এরকম মাস্টারপিস স্টোরিলাইন পুরো কমিক জগতের ইতিহাসে খুব কমই এসেছে। গল্পটা মূলত পথভ্রষ্ট হয়ে বেপরোয়া বনে যাওয়া সুপারম্যানকে থামানো প্রচেষ্টা নিয়ে। ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সের সেকেন্ড ইনস্টলমেন্ট ও ম্যান পভ স্টিল-এর সিকুয়েল ‘ব্যাটম্যান ভার্সাস সুপারম্যান: ডন অভ জাস্টিস’ মুভিতে পরিচালক জ্যাক স্নাইডার এমন কিছুরই প্রতিফলই ঘটিয়েছিলেন।

সেখানে গোথাম শহরের অতন্দ্র প্রহরী, অপরাধীদের দুর্ধর্ষ যম ব্যাটম্যান, সুপারম্যানকে একজন ওভার-পাওয়ার এলিয়েন হিসেবে মূল্যায়ন করে দমানোর চেষ্টা চালায়। তবে এ মুভিতে ন্যায়বিচারের উত্থান-পতনের পাঠ চুকানোর আগে, তা অত্যন্ত চমৎকারভাবে ‘ইনজাস্টিস: গডস অ্যামং আস’ কমিকের বিভিন্ন ইস্যুতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কমিক জগতের দ্বিমাত্রিক রং-তুলিতে আঁকা কার্টুন থেকে তা ভিডিও গেমের জীবন্ত চরিত্রে রূপান্তরিত হলে বিশ্বব্যাপী আরও অধিক জনপ্রিয়তা ও তুমুল প্রশংসা কুড়িয়ে নেয়।

‘ইনজাস্টিস: গডস এমং আস’ ভিডিও গেমে সুপারম্যান; Image Source: geekinsider.com

সুপারম্যান তার সবচেয়ে হিংস্র ও সর্বগ্রাসী রূপটা এখানে একেবারে জ্বলন্ত আগুনের ন্যায় তুলে ধরেছে। জোকার পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে মেট্রোপলিস শহরকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার পর, সুপারম্যানকে দিয়ে লোয়েস লেন ও তার অনাগত শিশুকে হত্যা করালে, সুপারম্যান হয়ে ওঠে আগের চেয়েও শতগুণ বেশি বিধ্বংসী, দেখিয়ে দেয় হিংস্রতার চূড়ান্ত রূপ। পিটিয়ে তুলাধোনা করে অনেক ভিলেনকে। জোকারকেও খুব নিষ্ঠুর ও বাজেভাবে খুন করে বসে সে। তার নির্মমতার যাঁতাকলে পড়ে প্রাণ দিতে হয় স্বয়ং  হারকিউলিসকেও। শক্তিশালী শ্যাজামের সাথে বাঁধে তার তুমুল সংঘর্ষ, ছাড় দেয় না তাকেও। সেই অপ্রতিরোধ্য সুপারম্যানকে থামানোর জন্য ব্যাটম্যানের উঠে-পড়ে লাগা নিয়ে এত সুন্দর একটা গল্প উপস্থাপন করতে পেরেছে ডিসি কমিকস।

সাথে নিয়েছে গ্রিন ল্যান্টার্ন কর্পস, হার্লে কুইন, জন কন্সট্যান্টিন, স্প্রেক্ট্রর, জ্যাটানা, ডেডম্যান, মিরর মাস্টার, ডক্টর ফেইটের মতো শক্তিশালী ও জনপ্রিয় কিছু চরিত্র। আগুনে ঘি ঢেলে উস্কে দিতে আরও যুক্ত হয়েছে প্রাচীন গ্রিক দেবতারাও। মাস্টারপিস না হয়ে যায় কোথায়? একসময় ইয়োলো ল্যান্টার্স কর্পসকে দলে ভিড়িয়ে ধীরে ধীরে সে নিজেও ইয়োলো ল্যান্টার্নে পরিণত হয়। সুপারম্যান তার ক্ষমতা ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে, কতটা হিংসাত্মক, উগ্র ও উন্মাদ হতে পারে, তা এই স্টোরিলাইনে সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে।

জোকারের কলিজা খুবলে নিচ্ছে সুপারম্যান; Image Source: denofgeek.com

সুপারবয় প্রাইম

সুপারম্যানের এই ভার্সনটি অন্যান্য ভার্সন থেকে খানিকটা জটিল। অনেকে মাঝে মাঝে সুপারবয় প্রাইম আর সুপারম্যান প্রাইম ওয়ান মিলিয়নের মধ্যে গুলিয়ে ফেললেও, দুটির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। সুপারবয় প্রাইম অল্টারনেট আর্থ বা প্যারালাল আর্থের এক বাসিন্দা, যা মূলত ‘আর্থ প্রাইম’ নামে পরিচিত। ইলিয়ট এস! ম্যাগিন এবং কার্ট সোয়ানের হাত ধরে ডিসি কমিকসে সে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাসে, ডিসি কমিকস প্রেজেন্ট-এর ৮৭ নাম্বার ইস্যুতে। তাকে পাঠানো হয়েছে ধ্বংসপ্রায় ক্রিপ্টন গ্রহ থেকে বা তার নাম কাল-এল, এসবের আদৌ কোনো বিষয়ে অবগত ছিল না সে। ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত সে অন্য দশটা কিশোরের মতো সহজ ও স্বাভাবিক জীবন অতিবাহিত করলেও ধীরে ধীরে তার মধ্যে সকল ক্রিপ্টোনিয়ান ক্ষমতা প্রকাশ পেতে থাকে।

ইনফিনিটি আর্থগুলোতে দুর্যোগের সময়, ডিসির দুর্ধর্ষ সুপার-ভিলেন অ্যান্টি-মনিটর যখন গ্রহগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে শুরু করে, তখন  সুপারবয় প্রাইমের আসল রূপ উন্মোচিত হয়। সুপারবয় প্রাইম তখন রিয়েলিটি ব্যারিয়ার চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলায়, পুরো ডিসি মাল্টিভার্সে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। সুপারম্যানের অন্যান্য ভার্সনের মতো কিছু জিনিসে তার দুর্বলতা নেই বললেই চলে। যেমন, ক্রিপ্টোনাইট বা ম্যাজিক তার উপর বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। কারণ এক ইউনিভার্সের ক্রিপ্টোনাইট অন্য ইউনিভার্সে কাঠখোট্টা নিষ্প্রাণ মামুলি এক পাথর মাত্র। ‘ক্রাইসিস অন দ্য ইনফিনিট আর্থ’-এর সময় আর্থ-প্রাইম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলে সে ‘প্যারাডাইজ’ নামে এক ডাইমেনশনে গিয়ে পতিত হয়, যেখান থেকে সে আর আগের জীবনে ফিরে যেতে পারে না।

এভাবেই অপ্রতিরোধ্য শক্তি, সুপার-স্পিড, পূর্বাভাসের ক্ষমতা সম্পন্ন দুনির্বার এক সুপারহিরো পরিণত হয় দুর্ধর্ষ এক সুপার-ভিলেনে। নির্মমতার চূড়ান্ত পর্যায় তাকে আচ্ছাদন করলে সে ছাড় দেয়নি জাস্টিস লিগকেও। পিটিয়ে করেছে তুলাধুনা। ডিসি ইউনিভার্সের অন্যতম কুখ্যাত কিছু সুপার-ভিলেনের দল যেমন, ‘লিজিয়ন অভ সুপারভিলেনস’, ‘লিজিয়ন অভ ডুম’, ‘রেড ল্যান্টার্ন কর্প্স’, ‘ব্ল্যাক ল্যান্টার্ন কর্প্স’ এর মতো দলের হয়েও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে সে। তাই সুপারবয় প্রাইম মূলত, সুপারম্যানের সুপারহিরো থেকে সুপারভিলেন হয়ে ওঠারই গল্প।

সুপারবয় প্রাইম; Image Source: wallpapersafari.com

বিজারো সুপারম্যান

এখন সুপারম্যানের ব্যতিক্রমী একটি ক্লোন, বিজারো সুপারম্যান নিয়ে আলোচনা করা হবে। বিজারো সুপারম্যানের জীবনকাহিনী ও অরিজিন দুটোই সাধারণের তুলনায় বেশ জটিল। তার উদ্ভাবন প্রক্রিয়াটাও ছিল বেশ অদ্ভুত। ডাল্টন নামে এক প্রফেসর সুপারবয়ের উপর ডুপ্লিকেশন রশ্মি প্রয়োগ করে তার একটি কপি তৈরি করতে চাইলে, সেখান থেকে দুর্ঘটনাবশত বিজারোর জন্ম হয়ে যায়। তবে বিজারোর সৃষ্টি নিয়ে ডিসি কমিকসে আরও একটি অরিজিনের সন্ধান পাওয়া যায়, যেটির স্রষ্টা হলো ডিসির জনপ্রিয় ভিলেন লেক্স লুথার। লেক্স লুথারের মনে সবসময় একটা শয়তানি ইচ্ছা লুকিয়ে ছিল সুপারম্যানদের দিয়ে একটা সেনাদল গঠন করার, যাদের উপর শাসন কায়েম করে সে ইচ্ছামতো ফুটফরমাশ খাটাতে পারবে।

সুপারম্যানের এই বিজারো ভার্সনের মাথায় এক ছটাক বুদ্ধিও ছিল না। সেজন্য তাকে অনেকে ‘স্টুপিড সুপারম্যান’ও ডেকে থাকে। বুকে খচিত উল্টা ‘S’ লোগোই সেই আহাম্মকির পরিচয় আরও বড়সড়ভাবে প্রকাশ করে। বিজারো সুপারম্যানের এই আহাম্মকি বৈশিষ্ট্যের জন্য লেক্স লুথারকেই অনেকাংশ দায়ী করা যায়। সুপারম্যানের ক্লোন হওয়ায়, তার মধ্যে সুপারম্যানের প্রায় সকল ক্ষমতাই বিদ্যমান। কিন্তু সে যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে বেশি যান্ত্রিক আচরণে অভ্যস্ত। ঘটে বুদ্ধি সুপারম্যানের চেয়ে কম।

তবে সাধারণ সুপারম্যানের চেয়ে তার মধ্যে নিহিত থাকা কিছু ক্ষমতা আসলেই নজর কাড়ে। যেমন, গ্রিন ক্রিপ্টোনাইট দ্বারা তার কোনো ক্ষতি হয় না, তবে ব্লু ক্রিপ্টোনাইট দিয়ে তাকে ধরাশায়ী করা যায়। সে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে আগুনের হলকা ছাড়তে পারে। চোখ দিয়ে লেজার ছাড়াও ‘আইসবিম’ ছুঁড়তে পারে। সাধারণ সুপারম্যান তার এক্স-রে ভিশন অ্যাবিলিটি দ্বারা সীসার মধ্যে কী আছে তা দেখতে না পেলেও, বিজারো সুপারম্যান দেখতে পায় ঠিকই। নীল নক্ষত্রের আলোতে সে তার মতো ডুপ্লিকেট কপি তৈরি করতেও সক্ষম। তবে নীতি-নৈতিকতা বোধের অভাব এবং হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হওয়ায়, সে মানব উপকার থেকে অপকারেই এসেছে বেশি।

বিজারো সুপারম্যান; Image Source: comicvine.gamespot.com

আল্ট্রাম্যান

সুপারম্যানের গোটাকতক খলনায়ক চরিত্রের মধ্যে আল্ট্রাম্যান অন্যতম। ১৯৬৪ সালের আগস্ট মাসে ‘জাস্টিস লিগ অভ আমেরিকা’- এর ২৯ নম্বর ইস্যুতে প্রথম ডেব্যু ঘটে সুপারম্যান-রূপী এই মারমুখী ভিলেনের। সেই থেকে কমিক-বুকে তার মন্দ চরিত্রটাই প্রতিবার পাঠকদের কাছে প্রতিফলিত হয়েছে। যেখানে সে ক্ষমতালোভী ক্ষুধার্ত রাক্ষসের মতো নিজস্ব দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বগলদাবা করে রাখতে চাইত। এ অংশে মূলত ‘দ্য নিউ ৫২ রিবুট’-এর ‘আর্থ-৩’তে বসবাসকারী আল্ট্রাম্যানকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে। কাহিনীর উত্থান ঘটে স্বার্থান্বেষী ও স্বার্থপরতার অশুভ ছায়ায় ছেয়ে যাওয়া অল্টারনেট ভার্সনের এক ক্রিপ্টন গ্রহ থেকে। এখানে তার ক্রিপ্টন গ্রহ ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় ছিল না। ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী সত্ত্বা হয়ে ওঠার প্রতিহিংসা পুষে রাখার জন্য, যুবক কাল-এলকে পাঠানো হয় পৃথিবীতে। পৃথিবীতে তাকে আশ্রয় দেয়া মা-বাবাকে মেরেই সে কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। ক্রমেই সে পরিণত হয় অতিশয় পরাক্রমশালী এক ভিলেনে।

ক্রিপ্টোনাইট তাকে তো দুর্বল করতে পারেই না, বরঞ্চ সে ক্রিপ্টোনাইটের সংস্পর্শে এসে আরও নতুন ক্ষমতা অর্জন করতে থাকে। ‘কসমিক অ্যাওয়ারনেস’ তাকে অন্য সব সুপারম্যান থেকে আলাদা করে তুলেছে। ডায়মেনশনাল ব্যারিয়ার ভেঙে ওপারের কলকাঠি দেখার বিস্তারিত দেখার ক্ষমতা পায় সে।

একসময় ‘ক্রাইম সিন্ডিকেট’ নামে এক অপরাধী দল গঠন করলে সেটা দিয়ে জাস্টিস লিগ, জাস্টিস সোসাইটির মতো সুপারহিরো টিমের সাথে দ্বন্দ্ব বাধাতেও দ্বিধা-বোধ করে না। আশি দশকের কমিকগুলোতে সে আর্থ-১ এর লেক্স লুথার এবং আর্থ-২ এর অ্যালেক্সি লুথারের সাথে যোগ দিয়ে পুরো পৃথিবীতে এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। এভাবেই ক্রাইম সিন্ডিকেট নামক এক সন্ত্রাসী সংঘটন গঠন করে সে পুরো বিশ্বে তার শাসন কায়েম করতে উদ্বুদ্ধ হয়।

আল্ট্রাম্যান; Image Source: supermanrebirth.fandom.com

সিলভার-এজ সুপারম্যান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, আমেরিকায় আর্থনীতিক মন্দা শুরু হলে, কমিক-বুকের বাজারে পুরোদস্তুর ধস নেমে যাওয়ায় ‘দ্য গোল্ডেন এজ অভ কমিক বুক’ বা কমিক সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের পতন ঘটে। কমিকের প্রতি পুনরায় পাঠকদের আকর্ষণ ফেরাতে ডিসি কমিকস তাদের পুরোনো জনপ্রিয় চরিত্রগুলোকে নতুন গল্প ও অরিজিনের মোড়কে পাঠকদের সামনে উপস্থিত করে।

প্রথমে ঘটা করে আনা হয় ফ্ল্যাশ এবং এর পর সুপারম্যানকে। সিলভার-এজ সুপারম্যানকে সুপারম্যান ভার্সনের মধ্যে পুরোপুরি ওভার-পাওয়ার্ডই বলা যায়। কারণ শক্তিমত্তা আর ক্ষমতায় তাকে টেক্কা দেয়ার মতো সমসাময়িক কেউ ছিল না। যেকোনো সোলার সিস্টেম আর গ্যালাক্সি ধ্বংস করা তার কাছে নিছক ছেলেখেলা ছিল মাত্র। প্রি-ক্রাইসিসে সিলভার-এজ সুপারম্যান একবার হাঁচির মাধ্যমে পুরো সোলার সিস্টেম ধ্বংস করে ফেলেছিল। এছাড়াও সে যেকোনো গ্রহকে কক্ষচ্যুত করে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারত অনায়াসে। সে সুপার কম্পিউটার থেকেও দ্রুত ডাটা প্রসেস করতে পারত।

সুপারগার্ল, ক্রিপ্টো, স্ট্রিকি, লিজিয়ন অভ সুপারহিরোজ-এর মতো জনপ্রিয় দল ও চরিত্রগুলো ওই সময়ই সুপারম্যান ফ্র‍্যাঞ্চাইজিতে যোগ দিয়েছিল। দুর্বলতা বলতে খালি ছিল ওই গ্রিন ক্রিপ্টোনাইট। এছাড়াও লাল সূর্যের আলোও তাকে কাবু করে ফেলতে পারত। সকল রোগ থেকে সে সুরক্ষিত থাকতে পারলেও ক্রিপ্টনের ‘ভাইরাস এক্স’ তাকে দুর্বল করে ফেলত। গোল্ডেন-এজে সুপারম্যানের অরিজিন আর্থ-২ এ শুরু হলেও, সিলভার-এজ এ তা হয়েছে আর্থ-১ এ। ব্রোঞ্জ এজে প্রবেশ করার পর ডিসি সুপারম্যানের ক্ষমতা খানিকটা কমিয়ে দিয়ে অন্যান্য চরিত্রের সাথে লড়াইয়ের উপযোগী করে তুলেছিল।

সিলভার-এজ সুপারম্যান; Image Source: aminoapps.com

সুপারম্যান প্রাইম ওয়ান মিলিয়ন

পৃথিবীতে থাকার সময় সুপারম্যান মনে অনেক আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন বাসা বুনেছিল। এর মধ্যে কতগুলো পূরণও হয়েছিল। যেমন, পৃথিবীতে মানুষের আশা ভরসার প্রতীক হয়ে থাকা, লোয়েস লেনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, ইনসাফের তুলাদণ্ড জাস্টিস লিগের দলপতি হওয়া ইত্যাদি। এভাবে সুখে-শান্তিতেই কাটছিল তার জীবন। কিন্তু সেই সুখে জল ঢেলে দিল ‘মৃত্যু’ নামক শব্দটি। প্রাকৃতিক নিয়মেই পৃথিবীতে সুপারম্যানের সকল প্রিয় ও কাছের মানুষজন মৃত্যুবরণ করলে সে হতাশা ও বিষণ্নতার সাগরে পুরোপুরি ডুবে যায়। তাই শেষমেশ বাধ্য হয়েই তাকে একসময় পৃথিবী ত্যাগ করতে হলো।

একবিংশ শতাব্দী থেকে শুরু করে ৭০০ তম শতাব্দী পর্যন্ত সে ঘুরে বেরিয়েছে নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে। দীর্ঘ এই ভ্রমণে যাদের সাথে তার দেখা হয়েছে, তাদের কাছ থেকেই কোনো না কোনো কৌশল সে শিখে নিয়েছিল, লুফে নিয়েছিল অফুরন্ত শক্তির আধার! যার ফলে সে হয়ে উঠেছিল দেবতা সমতুল্য। সুপারম্যান ওয়ান মিলিয়ন প্রাইমে সুপারম্যানের ক্ষমতার কোনো লিমিট নেই, যাকে সোজা বাংলায় বলা যায়, ‘অসীম ক্ষমতা’। সূর্যের কেন্দ্রে থাকা ‘ফোর্ট্রেস অভ সলিচ্যুড’কে নিজের আস্তানা করে তোলে।

ফোর্ট্রেস অভ সলিচ্যুডে সুপারম্যান; Image Source: comicsverse.com

অফুরন্ত শক্তি শোষণ করে নেয় এখান থেকে। সোর্স ওয়াল ভেঙে ফেলে দীক্ষা নেয় ‘দ্য সোর্স’-এর কাছ থেকে। এই শক্তিমত্তা ব্যবহার করে সে নিয়ন্ত্রণ করে শিখে পঞ্চম ডাইমেনশন, এবং এনে ফেলতে পারে যেকোনো পরিবর্তন। দীর্ঘ ৭০০ বছর শিক্ষা-দীক্ষার পর, একসময় সে পৃথিবীতে ফিরে এলে তার শরীর পুরোপুরি সোনালি রং ধারণ করে। সে এতটাই শক্তিসাধন করে ফেলে যে, ক্রিপ্টোনাইট ও ম্যাজিক তাকে বিন্দুমাত্র কাবু করতে পারে না। নতুন প্রাণ তৈরির ক্ষমতাও ছিল তার কাছে, সেই সাথে তার জন্মস্থান ক্রিপ্টনকেও সে পুনরায় গড়ে তোলে। সুপারম্যান প্রাইমকে ‘লাস্ট সন অভ ক্রিপ্টন’ বা ‘গোল্ডেন গড’ বলেও অভিহিত করা হয়। নিঃসন্দেহে সে কমিক-বুকের অন্যতম সেরা ক্ষমতাসীন সুপারহিরো।

সুপারম্যান ওয়ান মিলিয়ন প্রাইম; Image Source: knowyourmeme.com

থট রোবট/কসমিক আর্মর সুপারম্যান

এ পর্যন্ত সুপারম্যানের যে সকল ভার্সন কমিকের পাতায় রিলিজ হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভার্সন ধরা হয় থট রোবট বা কসমিক আর্মর সুপারম্যানকে। থট রোবট মূলত সুপারম্যানের ‘ফোর-ডি ভার্সন’। কমিকসে তাকে বেশি দেখার সৌভাগ্য হয়নি পাঠকদের। গ্র‍্যান্ট মরিসন ফাইনাল ক্রাইসিস স্টোরিলাইনে তাকে নিয়ে আলোচনা করেছে। অরিজিনাল সুপারম্যান আর আল্ট্রাম্যানের সাহায্যে মনিটর নামে একজন তাকে তৈরি করেছিল ম্যানড্রাককে হারানোর জন্য। কিন্তু কেউ হয়তো আঁচও করতে পারেনি, অন্য সকল ভার্সনকে টেক্কা দিয়ে কসমিক আর্মর সুপারম্যান হয়ে উঠবে সুপারম্যান ফ্র‍্যাঞ্চাইজির হর্তাকর্তা-বিধাতা। অনেকগুলো ইউনিভার্স ও মাল্টিভার্স এক তুড়িতে ধ্বংসের ক্ষমতা রাখে সে। তাকে তুলনা করা যায় মার্ভেল কমিকসের অন্যতম শক্তিশালী চরিত্র ‘ইটার্নিটি’র সাথে।

সম্ভবত ওভার মনিটর ছাড়া ডিসি মাল্টিভার্সে তাকে টেক্কা দেয়ার মতো আর কেউ পারদর্শী নয়। সে লুসিফার মর্নিংস্টার, মাইকেল ডেমিউরগস মতো চরিত্রের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। ইউনিভার্সের উত্থান-পতনের ক্ষমতা রাখে বলে, তাকে মাল্টি ইটার্নিটি ক্যারেক্টার হিসেবে গণ্য করা হয়। সকল ক্রিপ্টোনিয়ান অ্যাবিলিটি ধারণ করার পাশাপাশি, তার মধ্যে কিছু ঐশ্বরিক ক্ষমতা যেমন, শক্তি শোষণ, ডায়মেনশন ম্যানিপুলেশন, কসমিক অ্যাওয়ারনেসের মতো দুর্দান্ত কিছু ক্ষমতাও ছিল। এছাড়াও ভবিষ্যত দেখতে পারত বলে বিপদের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখত, বা সব ঘটনাকে আবার ঠিকমতো সাজিয়ে ভবিষ্যতে ঘটা দুর্ঘটনা ঠেকিয়ে দিতে পারত। ম্যানড্রাককে হারানোর পর থট রোবট পুরো মাল্টিভার্স শাসনের চিন্তাভাবনা করে। কারণ, মেটাভার্সাল সত্ত্বা হওয়ায় সে ছিল মাল্টিভার্সের ঊর্ধ্বে।

থট রোবট/ কসমিক আর্মর সুপারম্যান; Image Source: pinterest.com

৮০ বছরের অধিক সময় ধরে সুপারহিরো মহল দাপিয়ে বেড়ানো এই সুপারহিরো বহুরূপে, বহুবার পাঠক ও দর্শকদের কাছে হাজির হয়েছে। পূরণ করেছে পাঠক ও দর্শকদের চাহিদা ও প্রত্যাশা। ‘আশার প্রতীক’ এই হিরো জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে এসেছে, ছড়াচ্ছে এবং ছড়িয়ে যাবে বলেই আশা রাখা যায়।

Related Articles

Exit mobile version