১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের ১৫ তারিখ। বাঙালির ন্যায্য দাবিতে সারা বাংলায় অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গে। বিকাল তিনটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে। ১৫ থেকে ২৫ তারিখ। এই এগারো দিনে লাগাতার বৈঠকের পরও ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসছে না। পাকিস্তানী জান্তা যেকোনো উপায়ে বাঙালিকে শাসন ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে চাইছে। বস্তুত, এটা ছিল ২৫শে মার্চের নির্মম গণহত্যা বাস্তবায়নের লক্ষে সাজানো এক নাটক। এক পৈশাচিক নীলনকশা। কাউকে কিছু না বলে ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা ৫টায় গোপনে ঢাকা ত্যাগ করার আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দিয়ে যান গণহত্যার সবুজ সংকেত। সন্ধ্যার রক্তিম সূর্যের মতো এ রাতে ঢাকার পিচ ঢালা কালো পথ রক্তে লাল হবে তা কে জানত!
২৫শে মার্চের গণহত্যা কি পূর্বপরিকল্পিত ছিল? পাকিস্তানিরা সত্যিই কি এ দেশে গণহত্যা চালিয়েছে? বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সত্যিই কি স্বাধিকার আদায়ের জন্য লড়াই ছিল নাকি ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন? কেনই বা বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে নিল? কেন পাকিস্তানী জান্তা সরকার সত্তরের নির্বাচনে অভূতপূর্ব জয়ের পরও ক্ষমতা হস্তান্তরের তালবাহানা করেছিল? আর কেনই বা ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাঁধভাঙা জয় হয়েছিল? এই সকল ‘কেন’-র উত্তর রয়েছে এন্থনি মাসকারেনহাসের (Anthony Mascarenhas) বই ‘দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ (The Rape of Bangladesh)’-এ।
বইটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত প্রথম কোনো বই যা ১৯৭১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয়। এগারো অধ্যায়ে বিভক্ত বইটিতে রয়েছে ১৯৬৬ থেকে ‘৭১-এর অক্টোবর পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কুটিল ও জটিল রাজনীতির নিরপেক্ষ বিবরণ।
পেশায় সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস এই অঞ্চলের রাজনীতি প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছ থেকে, যা তার লেখায় ফুটে উঠেছে খুব চমৎকারভাবে। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে পাকিস্তানের মিলিটারি ব্যুরোক্রেটিক এলিটের চরিত্র, আইয়ুব, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর ক্ষমতালিপ্সা, আওয়ামী লীগের ৬ দফা, ছাত্র জনতার ১১ দফা, ‘৭০ এর নির্বাচন ও পরবর্তী রাজনৈতিক টানাপোড়েন, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা ও প্রবাসী সরকার গঠন ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ আছে ‘দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ’ বইটিতে।
২৫ তারিখ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের কাপুরুষোচিত পলায়নের নাটকীয় উপস্থাপনার মাধ্যমে লেখক বইটি শুরু করেন। প্রথম অধ্যায়ে লেখক বাংলাদেশের স্বাধীকার কেন অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল সেই কারণগুলো খুঁজে বের করেন। এই অধ্যায়ে উঠে আসে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনা, শিক্ষা, চাকুরী, শিল্পায়ন, বৈদেশিক ত্রাণের বণ্টনসহ সকল ক্ষেত্রে বাঙালির প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের ভয়াবহ চিত্র।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক তুলে আনেন ‘৪৭ থেকে ‘৫৮ পর্যন্ত এই এগারো বছরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সাতজন প্রধানমন্ত্রীর পালাবদল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে পাঞ্জাবকেন্দ্রিক মিলিটারি ব্যুরোক্রেটিক এলিট শ্রেণীর ক্ষমতার কাছে আসা এবং ১৯৫৮-তে আইয়ুব খানের মার্শাল ল জারিসহ নানা ঘটনা।
তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে আইয়ুব খানের কথিত মৌলিক গণতন্ত্র, নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা, সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের উপর ধরপাকড়, জেল-জুলুম ও নির্যাতনের চিত্র। চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে আছে ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা দখল, নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি প্রদান, আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলন ও ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন পূর্ববর্তী সাইক্লোন, দুর্যোগ কবলিত অসহায় মানুষদের প্রতি পাকিস্তানী শাসকদের নিষ্ঠুর আচরণ এবং আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়।
ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায়ে লেখক একই সাথে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক টানাপোড়েন তুলে ধরেছেন। একদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলছে আপামর জনতার অসহযোগ আন্দোলন, পতাকা উত্তোলন, ৭ই মার্চের ভাষণ, ৬ দফা থেকে একচুল না সরে সংবিধান সংশোধন করে সরকার গঠনসহ আরো অনেক কিছু। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মাঝে চলছে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। মার্চের ১ থেকে ২৫ তারিখের মধ্যে ইতিহাস যেন এগিয়ে যায় এক যুগেরও বেশি। ঘটনাবহুল এ সময়টিতেই নেওয়া হয় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার সিদ্ধান্তটি।
অষ্টম ও নবম অধ্যায়ে অঙ্কিত হয়েছে নিরীহ বাঙ্গালীর উপর বর্বর পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, হত্যা-লুণ্ঠনের পৈশাচিক চিত্র। শুধু তা-ই নয়, গণহত্যার পর পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পূর্ণ ‘স্বাভাবিক’ এই প্রোপাগান্ডা চালাতে থাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ‘সম্পূর্ণ স্বাভাবিক’ তা দেখাতেই বেশ কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে কয়েকটি নির্ধারিত স্থান সরেজমিনে দেখার সুযোগ করে দেয়। সেই সকল সাংবাদিকদের মাঝে ছিলেন যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমসে কাজ করা লেখক এন্থনি মাসকারেনহাস। তিনি বাংলাদেশে এসে আবিষ্কার করলেন চেপে রাখা এক নির্মম সত্য, যা তিনি দেশে ফেরার পর প্রথমে প্রতিবেদন তারপর বই আকারে প্রকাশ করেন। তার ‘জেনোসাইড’ আর্টিকেলের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম পৃথিবী জানতে পারে কী ঘটছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সাথে।
দশম ও একাদশ অধ্যায়ে লেখক ৮ মিলিয়ন (প্রকৃত অর্থে ১০ মিলিয়ন) লোকের দেশান্তর, ১৯৭০-এর ভয়াবহ সাইক্লোনে ৫ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু এবং যথারীতি শাসকদের উদাসীনতা, প্রবাসী সরকার ও মুক্তিবাহিনী গঠনসহ সর্বোপরি কী কী উপায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। যেহেতু বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭১-এর অক্টোবর মাসে, তাই সঙ্গত কারণেই এই বইয়ে অক্টোবর পরবর্তী ঘটনাবলী স্থান পায়নি।
এছাড়াও আরো আছে চারটি পরিশিষ্ট। প্রথম ও দ্বিতীয় পরিশিষ্টে ৬ দফা ও তার ব্যাখ্যা। তৃতীয় পরিশিষ্টে ১১ দফার বর্ণনা। এবং চতুর্থ পরিশিষ্টে ‘৪৭ এর দেশভাগ থেকে ‘৭১ এর ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ঘটনাপঞ্জি রয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, সাবলীল ও নিরপেক্ষ উপস্থাপনা, মানবতাবোধ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে এন্থনি মাসকারেনহাসের ‘দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ’ বইটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য স্থান দখল করে রেখেছে।