১৯৫৫ সাল। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করে ছাত্রদেরকে ‘শহীদ দিবস’ পালন করতে দেবে না সরকার। রাস্তায় স্লোগান দেওয়া নিষিদ্ধ। মিছিল, শোভাযাত্রা সবই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, যারা তিন ফাল্গুন আগে ভাষা আন্দোলনে হারানো শহীদদের স্মৃতি গভীর ভালবাসায় লালন করছে, তারা কি এত সহজে ছেড়ে দেবে? যে কোন মূল্যে শহীদ দিবস পালন করতে প্রস্তুত তারা।
সেজন্য আগে থেকেই তারা ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। যেমন, তিনদিন ধরে নগ্ন পায়ে চলা, শহীদদের স্মরণ করে রোজা রাখা, কালো ব্যাজ ধারণ করে ২১ ফেব্রুয়ারিতে কালো পতাকা উত্তোলন করা সহ নানাভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ চলতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের তিন বছর পরে আসা আরেক ফাল্গুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শহীদ দিবস পালনের প্রস্তুতি এবং সরকারি বাধাকে উপেক্ষা করে তাদের অন্যায়কে প্রতিহত করার বলিষ্ঠ দৃঢ়ভঙ্গিকে কেন্দ্র করে জহির রায়হান রচনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক প্রথম উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন।’
বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম জহির রায়হান। স্বল্পায়ুর জীবনে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিকাশের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন, একইসাথে তার কুশলতার ছাপ রেখে গেছেন বাংলা সাহিত্যে। এজন্যই গতানুগতিক কাঠামোকে ভেঙে নিরীক্ষাধর্মী নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা প্রায়শ পরিলক্ষিত হয় তার গল্প-উপন্যাসে। তার ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে।
এই উপন্যাসের কাহিনীর স্থিতিকাল মাত্র তিনদিন দুই রাত। প্রথম দু’দিন এবং দুই রাত ধরে চলেছে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের বিরামহীন প্রস্তুতি। এরপর তৃতীয় দিনে শহীদ দিবস পালনের মিছিলে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ এবং প্রতিবাদী ছাত্রদের গ্রেফতার করে দমিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস চিত্রায়ণের মাধ্যমে জেলগেটের সামনে এ উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।উপন্যাসের শুরুটা বেশ নাটকীয়।
সকালে কুয়াশায় ঢাকা পড়েছিল পুরো আকাশটা। আকাশের অনেক নিচু দিয়ে মন্থর গতিতে ভেসে চলেছিল এক টুকরো মেঘ। উত্তর থেকে দক্ষিণে। রঙ তার অনেকটা জমাট কুয়াশার মতো দেখতে।
ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে ঠিক সেই মেঘের মতো একটি ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখা গেল নবাবপুরের দিকে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে। পরনে তার সদ্য-ধোয়ানো সাদা সার্ট। সাদা প্যান্ট। পা-জোড়া খালি। জুতো নেই।
সিপাহী বিদ্রোহের নির্মম স্মৃতি বিজড়িত ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে এই মেঘের মতো হেঁটে যাওয়া ছেলেটিই ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুনিম। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা। জহির রায়হান সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিময়তার সাথে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিবাদী চেতনার এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটিয়েছেন এ উপন্যাসের সূচনাপর্বে। স্বৈরাচারী সরকারের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে শহীদ দিবসকে যথাযথ মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নে মুনিমের মতো আসাদ, সালমা, নীলা, রানু, বেনু, রাহাত, কবি রসুল দিন-রাত কাজ করে যায়। পোস্টার ও লিফলেট ছাপানো, কালো ব্যাজ বিতরণ, স্লোগান ও অন্যান্য সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সকলেই অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত এবং সক্রিয়। মূলত সবধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ কীভাবে রুখে দাঁড়ায় এবং আপন স্বার্থকে তুচ্ছ করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে, তার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র প্রতিফলিত হয় পুরো উপন্যাস জুড়ে। তবে শুধু আন্দোলনের চিত্র নয়, একইসাথে মানুষের স্মৃতিকাতর মন, প্রিয়জন হারানোর বেদনা, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যকার প্রেম-ভালোবাসা ও হৃদয়ঘটিত দুর্বলতাসহ বিচিত্র অনুভূতির চিত্রায়ণ ঘটেছে এই উপন্যাসে।
শহীদদের স্মৃতিকে বুকের ভেতর দৃঢ়ভাবে ধারণ করে সব পরিস্থিতিতে সততা এবং রাজনৈতিক আদর্শ ও নিষ্ঠা বজায় রাখার উজ্জ্বল নিদর্শন সৃষ্টি করেছে এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুনিম। শহীদ দিবস পালনে বাধার সম্মুখীন হয়ে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে প্রেমিকা ডলির জন্মদিনের উৎসবেও সে হাজির হয় খালি পায়ে। প্রেমিকা ডলি তাকে খালি পায়ে দেখে অস্থির হয়ে বলে,
“আমায় অমন করে অপমান করতে চাও কেন শুনি? …এখানে জুতো পায়ে দিয়ে এলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো না!”
এরপর তাকে ডলির বাবার জুতা পরার পরামর্শ দিলে মুনিম উত্তর দেয়,“জানো তো আমরা তিনদিন খালিপায়ে হাঁটা- চলা করছি। …আমায় তুমি ইমমোরাল হতে বলছো?” ক্রোধান্বিত ডলির সাথে সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটে মুনিমের। মুনিমের মতো আরেকজন আপোসহীন একনিষ্ঠ বিপ্লবী ছাত্রকর্মী আসাদ। কোনো প্রতিকূলতাই তাকে আন্দোলনের মাঠ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে কালো ব্যাজ ও কালো পতাকা বিতরণসহ সব কাজে সে ছিল ক্লান্তিহীন। এজন্য উপন্যাসের শেষের দিকে মুনিমের চেয়ে আসাদ চরিত্রটিই বিশেষ আলো ছড়ায়। অন্যদিকে মেডিকেলের ছাত্রী সালমা কারারুদ্ধ বিপ্লবী রওশনের স্ত্রী। স্বামীর জন্য হৃদয়ে গভীর ভালবাসা লালন করে আন্দোলনে সে অত্যন্ত কঠোর ও দৃঢ়। ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিনগুলো থেকে তার স্বামী রওশন কারারুদ্ধ অবস্থায় আছে। এরপর রাজশাহী জেলে পুলিশ গুলি চালালে রওশন তার হাত দুটি হারায়। স্বামী রওশনের খণ্ডিত হাত আর কখনো স্লোগানে উত্তেজিত হবে না, নিবিড় আলিঙ্গনে সালমাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করবে না, সালমার এমন বেদনা পাঠকদেরকেও সিক্ত করে। এই নিষ্ঠাবান ছাত্রদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামী চেতনার পাশাপাশি উঠে এসেছে সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর প্রকৃত চিত্র। ছাত্রদের মাঝে লুকিয়ে থাকা গুপ্তচর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের মেরুদণ্ডহীন প্রক্টর- সবার নির্লজ্জতা এবং বিবেকহীনতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে এ উপন্যাসে। এমনই একটি চরিত্র বজলের উক্তি এখানে উল্লেখ করা যায়,
“আমরা হলাম সাহিত্যিক। সমাজের আর দশটা লোক মিছিল আর শোভাযাত্রা বের করে পুলিশের লাঠি খেয়ে প্রাণ দিলে কিছু এসে যায় না। কিন্তু আমাদের মৃত্যু মানে দেশের এক একটি প্রতিভার মৃত্যু।”
উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র- নীলা, রানু, বেনু, রাহাত, কবি রসুল প্রমুখও রাজপথে তাদের আন্দোলন নিষিদ্ধ জেনেও ভিন্ন পথ অবলম্বন করে তারা লড়ে যায়। শহীদ দিবসের উন্মাদনায় তারা কেউ কেউ সারারাত জেগে থাকে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিকেল হোস্টেল, মুসলিম হল, চামেলি হাউস, ইডেন হোস্টেল, ফজলুল হক হল ইত্যাদি হলের ছাত্রছাত্রীরা জটলা বেঁধে কোরাস গান ধরে ‘ভুলবো না, ভুলবো না, একুশে ফেব্রুয়ারি।
পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারিতে সকল ভীতিকে উপেক্ষা করে তারা কালো পতাকা উত্তোলিত করে। ছাত্রদের স্লোগান ও ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, এরপর মেডিকেলের ব্যারাক ঘেরাও করে ছাত্রছাত্রীসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর সকাল ১০টার দিকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে যখন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে জমায়েত হতে শুরু করে এবং সেখানে কালো পতাকা উত্তোলন হয়, সেখানেও পুলিশ গুলি চালায়, অনেক ছাত্র-ছাত্রী আহত হয় আবার অনেককে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। প্রিজন ভ্যানে উঠে তারা স্লোগান দিতে থাকে ‘শহীদের খুন ভুলব না, বরকতের খুন ভুলব না’; ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। মূলত সংগ্রামী চেতনার সাথে লেখকের রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির নিবিড় সম্মিলন ঘটেছে এ উপন্যাসে। ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’, ‘অত্যাচারীর বিরুদ্ধে নতুন করে জেগে ওঠা’– উপন্যাসের শেষাংশে ফাল্গুনের এই মহৎ শিক্ষাই আমাদেরকে নতুন করে উজ্জীবিত করে।
“নাম ডেকে ডেকে তখন একজন করে ছেলেমেয়েদের ঢোকানো হচ্ছিল জেলখানার ভেতরে।
নাম ডাকতে ডাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। এক সময় বিরক্তির সঙ্গে বললেন, উহ অত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়? জেলখানাতো এমনি ভর্তি হয়ে আছে।
ওর কথা শুনে কবি রসুল চিৎকার করে উঠল, জেলখানা আরও বাড়ান সাহেব। এত ছোট জেলখানায় হবে না।
আর একজন বলল, এতেই ঘাবড়ে গেলে নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।”
এই ‘আসছে ফাল্গুনে দ্বিগুণ হওয়া’র প্রতিশ্রুতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কোন অন্যায় বা অবিচারই চিরস্থায়ী হতে পারে না। সব ধরনের শোষণ এবং নিপীড়ন বিরুদ্ধে মানুষ বারবার জেগে উঠবে ফাগুনের ডাকে। অত্যাচারে মাথানত না হয়ে অত্যচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এই প্রেরণা উপন্যাস থেকে সঞ্চারিত হয় পাঠকের মাঝেও।
বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-