ইতিহাসের কুখ্যাত সব সিরিয়াল কিলারদের কথকতা নিয়ে বই— ‘ক্রমিক খুনি’, লিখেছেন মনোয়ারুল ইসলাম। যারা ক্রাইম ফিকশন অথবা থ্রিলার উপন্যাস নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে বইটি হতে পারে এক ছোটখাট এনসাইক্লোপিডিয়া। বইটিতে লেখক সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে উপস্থাপনের।
‘ক্রমিক খুনি’ বইটি দুটো অংশে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমাংশে উঠে এসেছে কুখ্যাত সব পুরুষ সিরিয়াল কিলারদের কথা। আর দ্বিতীয়াংশে উঠে এসেছে নারী সিরিয়াল কিলারদের কথা। নারী সিরিয়াল কিলার সংখ্যায় কম হলেও তাদের নৃশংসতা পুরুষদের তুলনায় মোটেও কম না। বরং দুই-একজন নারী সিরিয়াল কিলার সম্পর্কে পড়তে গিয়ে মনে হতে পারে তারা পুরুষদের থেকেও বেশি নৃশংসতা দেখিয়েছেন খুনের ক্ষেত্রে।
বইয়ের সাথে মিল রেখে আলোচনাও দু’ভাগে করা যাক।
“To me killing people is like ripping up a duvet. Men, women, old people, children, they are all the same. I have never felt sorry for those I killed. No love, no hatred, just blind indifference.”
– Anatoly Onoprienko
পাঠক হয়তো ভাবছেন, বিজ্ঞানী, অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তাদের রেখে কেন একজন সিরিয়াল কিলারের দেওয়া উক্তি লিখলাম! “The Beast of Ukraine” নামে পরিচিত ৫২টি খুন করা এই সিরিয়াল কিলারের মৃত্যুদণ্ড উঠিয়ে নেওয়া হলে (ইউক্রেনে তখন মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ ছিল) সে নিজের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ব্যাপারে জোর দিয়ে বলে,
“আমাকে ছাড়া হলে আমি আবার হত্যা শুরু করব, যা এখনের চেয়ে ১০ গুণ খারাপ হবে। প্রথমে খুন করব ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে…।”
কী! পিলে চমকে গেল তো? ভেবে দেখেছেন, মানুষ ঠিক কতটা মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে এরকম আচরণ করে! এ তো কেবল একজন সিরিয়াল কিলারের নমুনা। গুনে গুনে মোট ৫১ জন পুরুষ খুনির কুকর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ‘ক্রমিক খুনি’ বইয়ে।
সিরিয়াল কিলারদের কথা চিন্তা করলে প্রাথমিকভাবে সহজ কিছু প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়- মানুষ কেন খুন করে? কেন তারা আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করে না? এই অংশটা নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার।
প্রথমে যদি পুরুষ সিরিয়াল কিলারদের কথা বলা হয়, তাহলে এই ৫১ জন খুনির মধ্যে ৬০-৭০ ভাগ পুরুষের সিরিয়াল কিলারে রূপান্তরিত হওয়ার প্রধান কারণ দেখা গেছে পারিবারিক কলহ। পারিবারিক কলহ বলতে বাবা-মায়ের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বাবার হাতে মায়ের নির্যাতিত হওয়া, স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। তাছাড়াও শিশু অথবা কিশোর বয়সে শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার, স্কুলে বুলিং-এর শিকার মানসিক অবস্থা অবনতির অন্যতম প্রধান কারণ। এসব কারণে তারা ধীরে ধীরে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ, তাদের মধ্যে একধরনের প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ক্রমে এই মনোভাব প্রকট হয়ে ওঠার কারণে তারা একের পর এক খুন করতে থাকে।
হাতেগোনা কয়েকজন খুনি পাওয়া যায়, যারা অর্থের লোভে খুন করেছে। আর বেশিরভাগ খুনি ছিল মানসিক বিকারগ্রস্ত। এর মধ্যে দু-চারজনের আইকিউ (বুদ্ধিমত্তা) ছিল অনেক বেশি। তাই এদেরকে ধরতে বেগ পেতে হয়েছে পুলিশদের। তাছাড়া মৃত শরীরের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন, মৃত মানুষের রক্তপান, মৃত মানুষকে টুকরো টুকরো করে কাটা, এসব এতদিন মুভি-সিরিজের বিষয়বস্তু মনে হলেও বইটি পড়লে পাঠক জানতে পারবেন, মুভি-সিরিজ-গল্পে চলে আসা এই আইডিয়াগুলো ইতিহাস থেকেই লেখকদের মাথায় এসে ভর করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’ সিনেমার ‘হানিবল লেক্টার’, ‘হিটম্যান’ মুভির ‘হিটম্যান’ অথবা ‘এজেন্ট-৪৭’, এসব চরিত্রের সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাসের কুখ্যাত দুই খুনির জীবন নিয়ে। তাছাড়াও আরো অনেক মুভি বানানো হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সিরিয়াল কিলারদের জীবনী নিয়ে। কোন কিলারকে নিয়ে কোন মুভি বা বই লেখা হয়েছে সেই তথ্য পেয়ে যাবেন সেই কিলারের শর্টকাট বায়োগ্রাফির শেষ অংশে।
কখনো শুনেছেন যে খুনির নাম এবং খুনের ধরনের উপর সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক তত্ত্ব? কুখ্যাত খুনি ‘জ্যাক দ্য রিপার’ এর হত্যাকাণ্ডগুলো অধ্যয়ন এবং বিশ্লেষণের জন্য ‘রিপারোলজি’ (Ripperology) নামের এক শব্দের প্রচলন ঘটে। এর ভিত্তিতে রয়েছে বহু তত্ত্বও। তাছাড়াও ২০১৫ সালে পূর্ব লন্ডনে এই কুখ্যাত খুনির নামে খোলা হয় ‘জ্যাক দ্য রিপার মিউজিয়াম’। মজার বিষয় হচ্ছে, আজ পর্যন্ত কেউ জানে না এই ‘জ্যাক দ্য রিপার’ আসলে কে, কী তার পরিচয়।
ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে উঠে এসেছে বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষ থেকেও কয়েকজন কুখ্যাত খুনির নাম। তার মধ্যে রসু খাঁ, ঠগ বাহরাম, রমন রাঘব অন্যতম। কী! ভাবছেন, এতগুলো করে খুন করা খুনিরা নিশ্চয়ই মৃত্যুদণ্ড দণ্ডিত হয়ে মারা গেছে? মৃত্যুদণ্ড দিতে গিয়েও সৃষ্টি হয়েছে নানা বিভ্রান্তি। কিছু দেশের সংবিধানে মৃত্যুদণ্ডের রীতি চালু না থাকায় তাদের হয়েছে সর্বোচ্চ সময়ের জন্য কারাবাস। কারো হয়েছে ২০ বছর, কারো ৩০, কারো ৪০। কিছু খুনিকে মেরে ফেলা হয়েছে ইঞ্জেকশন দিয়ে, কিছু খুনিকে গুলি করে। আর বাকি যারা মারা গেছে তাদের হয়েছে স্বাভাবিক মৃত্যু। আবার কিছু খুনি এখনও বেঁচে আছে। তারা এখন কারাগারের চার দেয়ালে বন্দী। কারো কারো সময় আর খুব বেশি নেই, হয়তো বের হয়ে আসবে জেল থেকে। কিন্তু বের হবার পরে তারা ঠিক কী করবে সেটাও এক চিন্তার বিষয়।
এবার আসা যাক নারী সিরিয়াল কিলারদের আলাপে। ২০১৫ সাল, গভীর রাতে প্লাস্টিক ব্যাগে করে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাইরে ফেলতে যায় এক মহিলা। টহলরত পুলিশের কাছে ব্যাপারটা সন্দেহজনক মনে হলে তারা ব্যাগ সার্চ করে মানবদেহের অংশবিশেষ পায়। তখন সেই মহিলা ফেঁসে যায় এবং গ্রেপ্তার হয়। বলছি ‘তামারা স্যামসোনোভা’র কথা। সেদিন তার বান্ধবী উলানোভাকে হ্যাক্সোব্লেড দিয়ে টুকরো টুকরো করে প্লাস্টিকের ব্যাগে তুলে ফেলতে গিয়েছিল সে।
আমরা যারা অনলাইনে একটু বেশি সক্রিয় তারা কমবেশি ‘এলিজাবেথ বাথরি’র নাম শুনে থাকার কথা। হাঙ্গেরিয়ান এই নারী ১৫৯০ থেকে ১৬১০ পর্যন্ত, মাত্র ২০ বছরে প্রায় ৬৫০ জন মানুষকে খুন করেছেন। কুমারীদের গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাদের হত্যা করে রক্ত দিয়ে গোসল করতেন বাথরি। তার এমন নৃশংসতার পেছনে ছিল তার অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা— এতে তিনি নিজের যৌবন লাভ করবেন!
সর্বমোট ১৪ জন নারী সিরিয়াল কিলারের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। যৌন নির্যাতন, পারিবারিক কলহ, অবহেলা, শারীরিক নির্যাতন, কম বয়সে বাবা-মায়ের মৃত্যু ইত্যাদি কারণে মমতাময়ী নারীর মাঝেও পাওয়া গেছে সিরিয়াল কিলারের হিংস্র ও নৃশংস মনোভাব।
ক্রমিক খুনি বইটি প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে যেন কোনো ভুল-ভ্রান্তির সৃষ্টি না হয় সেজন্য লেখক মনোয়ারুল ইসলাম ভূমিকায় স্পষ্ট করেছেন,
বইটিতে কোনোভাবেই অপরাধকর্মকে উৎসাহিত করা হয়নি। আশা করছি বইটি ক্রমিক হত্যাকারীদের আচরণ বোঝার ও তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ন্যূনতম হলেও ধারণা দিবে এবং তাতে সাধারণ মানুষ সতর্ক হতে পারবে। শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এই বই। দুর্বল চিত্তের মানুষকে বইটি পড়তে অনুৎসাহিত করছি।
বইয়ের নাম: ক্রমিক খুনি
লেখক: মনোয়ারুল ইসলাম
প্রকাশনী: প্রজন্ম
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১২০
মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা (USD $ 11)