ওবায়েদ হক শব্দ দিয়ে নীল পাহাড়ের ছবি এঁকেছেন। যে ছবিরা খেলে, হাসে, কাঁদে, কখনো জীবনের কথা বলে। রক্ত দিয়ে আঁকা পাহাড়ের রং নীল। নীল পাহাড়ে মানুষ থাকে না। সবুজ পাহাড়ে বাঙালি থাকে, পাহাড়িরা থাকে। মানুষে মানুষে মারামারি করে, দেবতার কাছে মানুষ বলি দেয়। কিন্তু কেউ কখনো তুষ্ট হয় না। আমরা সেই মারামারি দেখতে যাই না। আমরা পাহাড় দেখতে যাই, ঘুরতে যাই ঐ নীল পাহাড়ের দেশে।
আমাদের হয়তো ছুটিছাটায় ঘুরে বেড়ানোর খুব শখ। সাজেকের চূড়ায় উঠে নিশ্বাস নিতে ভালো লাগে। কিন্তু সাজেক গড়ে ওঠার রক্তাক্ত ইতিহাস কারো জানতে ইচ্ছে করে না। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে ঐ পাহাড়ের দেশে ছুটে যাওয়া হয়। কিন্তু ঐ নীল পাহাড়ের চূড়ায় কী আছে, তা আজও কেউ জানতে পারল না। আমরা পাহাড়ের নীল বেদনা দেখতে পাই না, আমরা দেখি সবুজ পাহাড়। গল্পের ঐ পাহাড়ের রংটাও তো সবুজ হওয়ার কথা ছিল, লাল-হলুদ ফুলে রাঙার কথা ছিল ঐ পাহাড়ের চূড়া। তাহলে ঐ পাহাড়টা এত নীল কেন? আচ্ছা, আপনি কি ঐ নীল পাহাড় দেখে বিমোহিত হন, নাকি ওর কষ্টের কথা শুনতে পান? কী এমন কষ্ট আছে ঐ পাহাড়ের যে এত বেদনাময় নীল হয়ে রয়েছে?
ওবায়েদ হক ঐ নীল পাহাড়ের গল্প লিখেছেন। গল্পটা ১৯৮৪ সালের, আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। এরশাদ সরকার ক্ষমতায় আসীন, পাহাড়ে চলছে ঝড়। পাহাড়ি-বাঙালি মারামারিতে প্রতিদিনই লাশ হচ্ছে কেউ না কেউ। সেই ঝড় কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন, যে জীবনের মালিক হয়তো কোনো বাঙালি, নতুবা কোনো পাহাড়ি। কিন্তু সেই মৃত্যুর হিসাব রেখে লাভ নেই, কারণ মৃত্যুর পর কেউ বাঙালি বা পাহাড়ি থাকে না। হয়ে যায় লাশ। বাস্তবে সে ঝড় থামানোর কেউ ছিল না, উপন্যাসেও কেউ নেই। সেই তুমুল ঝড়ের মাঝে একজন অভিযাত্রিক ডা. মানিক মিত্র। আর সেই অভিযাত্রিকের অভিজ্ঞতাই ঔপন্যাসিক তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে।
চালচুলো কিংবা পরিচয়হীন এক যুবক বড় হয়ে উঠেছে অনাথ আশ্রমে। যুদ্ধে পরিবার হারানো এক বাবুর সুনজরের দরুন পড়াশোনা করে আজ ডাক্তার হয়েছে। এক উচ্চপদস্থ ডাক্তারের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে পিজি থেকে পোস্টিং হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে। যার কেউ নেই, তার আবার হারানোর ভয় কী! তল্পিতল্পা গুছিয়ে ঐ দূর পাহাড়ের দেশে যায় মানিক। সেখানে বাঙালি আর পাহাড়ির মাঝে মারামারি লেগেই আছে। পাহাড়ের গভীর অরণ্য অতীতের কষ্ট যেন ভুলিয়ে দেয় মানিককে। পাহাড়কে, পাহাড়ের মানুষকে আপন করে নেয় মানিক। পাহাড়কে বুঝতে হয় মন দিয়ে, তাহলে পাহাড়ও দু’হাতে ভরে দেয়। মানিক বুঝেছিল পাহাড়কে। বিনিময়ে পাহাড় তাকে কী দিয়েছিল?
পাহাড় তাকে কিছু দেওয়ার আগে পাহাড়িরা তাকে উপহার দিয়ে দেয়। তারা জিম্মি করে গভীর অরণ্যে নিয়ে যায় মানিককে। অবশ্য জিম্মি দশায় থাকতে হয়নি, পাহাড়ি নেতাকে সুস্থ করে তুলতে হয়েছে। সেখানে থাকতে থাকতে পাহাড়কে খুব কাছ থেকে দেখেছে মানিক, দেখেছে পাহাড়ি মানুষের জীবনকে। যেখানকার পুরুষেরা ঐ নীল পাহাড়ে কাজে যায়। বছরের শেষে পুরুষেরা ঘরে ফিরলে উৎসব হয়। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকে না মানিক। সেখান থেকে পালিয়ে যায় সে, বরাবরের মতোই একা। অরণ্যসংকুল পথ, একা পথিক জীবনের উদ্দেশ্য কী তার? এরপর কী ঘটে তার জীবনে? কী-ই বা ঘটেছিল আশেপাশের পাহাড়িদের জীবনে?
বই জুড়ে উপমার ছড়াছড়ি নেই, পাঠককে বিমোহিত করবে, এমন কোনো লাইন নেই, গল্পে তেমন প্রাণও নেই, গল্পের শেষে অতি নাটকীয়তা এবং অতি সংক্ষিপ্তকরণ। কিন্তু বইটা জুড়ে তবু কী যেন আছে। কী যেন একটা মুগ্ধতা জড়িয়ে ফেলে পাঠকের মরমী হৃদয়। মনে হয়, এত তাড়াহুড়োর মধ্যেও কী যেন একটা কিছু বলতে চেয়েছেন লেখক! হয়তো জীবনের কথা, হয়তো বা পাহাড়ের কথা। যে কথা কেউ শুনতে পায় না, যে কথা পাহাড়েরা বলতে পারে না!
এই বইয়ের কাহিনীর যথার্থতা বিচার করার ক্ষমতা একজন পাহাড়ির আছে। যে জানে পাহাড়কে, যে জানে পাহাড়িদের, সে-ই ভালো বলতে পারবে বইটি কেমন হয়েছে। বস্তুত এই সামাজিক উপন্যাস পাহাড়ের একটা বাস্তব চিত্রকে চিত্রিত করেছে। চিত্রিত করেছে কেন পাহাড় আজ ধ্বংসের মুখে, আর কেনই বা পাহাড়িদের উন্নয়ন এখনও অধরা। পাহাড়ি আর বাঙালিদের মাঝে থাকা বহু বছরের দেয়ালটাই পাহাড়ের বেদনা হয়ে ধরা দিয়েছে বইটিতে।
উপন্যাসের শুরুর দিকে একটা সাবলীল ভাব বজায় থাকলেও যেন ৮০/৯০ পাতা লেখার পরে লেখক একধরনের তাড়া অনুভব করেছেন, আর দুম করে শেষ করে ফেলেছেন। শেষটা এত তাড়াতাড়ি না করে কিছু ব্যাখ্যা, কিছু সাবলীলতার মাধ্যমে আরও এগোনো যেত। কিন্তু তা না হয়ে মনে হয়েছে, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে চলতে গিয়ে লেখক শেষটায় এসে খেই হারিয়ে ফেলেছেন, গতি ঠিক রাখতে পারেননি।
নীল পাহাড় খুব সাদামাটা এক সামাজিক উপন্যাস। কিন্তু উপন্যাসের সাধারণ ভাব অসাধারণ হয়ে উঠেছে লেখকের বর্ণনায়। যারা পাহাড়ে উঠতে ভয় পান বা এখনও পাহাড়ে অবগাহনের সুযোগ হয়নি, যারা ঘরে বসে পাহাড়ে চড়ার স্বাদ আস্বাদন করতে চান, তাদের ‘নীল পাহাড়’ পাঠে স্বাগতম!
অনলাইনে কিনুন- নীল পাহাড়