প্রতিশোধের স্পৃহা মানুষের মজ্জাগত। এই স্পৃহা যখন মানুষের পশু প্রবৃত্তিকে উসকিয়ে দেয়, তখন মানুষটি নিজের উপরের নিয়ন্ত্রণ হারায়। মনের অন্ধকূপে জেগে উঠা প্রতিশোধস্পৃহাকে দমন করতে না পারলে ফলাফল খুবই ভয়ংকর হয়। মাঝে মাঝে এতটাই ভয়ংকর যে তা মানুষের কল্পনার সীমাকেও অতিক্রম করে। এমনই এক প্রতিশোধ স্পৃহার গল্প উঠে এসেছে আঁধারের যাত্রীতে। সাম্ভালা ট্রিলজি-খ্যাত লেখক শরিফুল হাসানের লেখনীতে।
আজমল চৌধুরী, ৩৭-৩৮ বছর বয়সের এই মানুষটি একজন ব্যবসায়ী। তুষার আহমেদ, একজন আমেরিকান প্রবাসী। ইফতেখার উদ্দিন রুবেল, একটি ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর মশিউর, উচ্ছন্নে যাওয়া এক যুবকের নাম। এই চারজন মানুষের মধ্যে কিছু মিল ছিল। তারা পরস্পরের বন্ধু। ছোটবেলায় একসাথে একই স্কুলে পড়েছে। পড়াশোনা শেষে যে যেভাবে পারছে জীবনতরী বেয়ে চলছে।
অনেক বছর পর এসে এই চার বন্ধুর জীবনে আরো একটি ঘটনায় মিল পাওয়া গেল। অদ্ভুত এক ফোন কল। একই নম্বর থেকে চারজনকে ফোন করা হয়েছে। শুধু কি ফোন? দেওয়া হয়েছে রীতিমত হুমকি। বেঁধে দেওয়া হয়েছে সাত দিনের সময়। যে তুষার আহমেদ ১৪ বছর দেশে আসেননি তিনি ঐ একটি ফোন কলেই হনহন করে ছুটে আসলেন বাংলাদেশে। কী এমন ছিল সেই ফোন কলে?
ফোন কলটা কি আসলেই কোনো হুমকি নাকি স্রেফ ভয় দেখানো? মন যখন এই দোলাচলে দুলছে ঠিক তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে খুন হয়ে গেল আজমল চৌধুরী। কেউ কেউ বললো ব্যবসায়িক প্রতিহিংসা। কিন্তু ফোনকলের খবর ঐ তিন বন্ধু ছাড়া কেউই জানলো না।
একেক দিকে ছুটতে লাগল সন্দেহের তীর। একটি ছুটে গেল মশিউরের দিকে। আজমলকে প্রাণে মারার হুমকি যে সে-ই দিয়েছিল। তবে সবচেয়ে জুতসই তীরটা ছুটে গেল আরিফের দিকে। আরিফ দেশসেরা লেখক। কোনো এক সময় সেও এই চারজনের বন্ধু ছিল। কিন্তু আজ আরিফের চোখে এই চার বন্ধুই তার সবচেয়ে বড় শত্রু। ওদের নাম শুনলে এখন তার গা ঘিনঘিন করে। কিন্তু কেন?
পুলিশের নবগঠিত হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের উপর দায়িত্ব পড়ল আজমল চৌধুরীর কেসটা তদন্তের। সেখানকার প্রধান আবু জামসেদ তার দলবল নিয়ে কোমর বেঁধে নামলেন। তিনি চান না তার অধীনে কোনো কেস অমীমাংসিত থাকুক। কিন্তু তিনি বেশি দূর এগোতে পারলেন না। তার আগেই আরো একটা খুন হয়ে গেল। ব্যাংকার ইফতেখার উদ্দিন রুবেলকে কে বা কারা যেন নৃশংসভাবে খুন করেছে। দুটি খুনের ঘটনায় কিছু বিষয়ে মিল পাওয়া গেলেও নেই কোনো ক্লু, কোনো মোটিভ। দিশেহারা হয়ে পড়লেন আবু জামসেদ। এই কেসের উপরই যে নির্ভর করছে তার দীর্ঘদিনের সুনাম আর ডিপার্টমেন্টের ভবিষ্যৎ।
ওদিকে ভয়ে জমে গেল তুষার এবং মশিউর। সেই হুমকি যে আজ হুমকিতে সীমাবদ্ধ নেই। এখন বাকি শুধু তারা দুজন। কার পালা এবার?
এককথায় অসাধারণ একটি বই। আগাগোড়াই রিভেঞ্জ থ্রিলার। পাতা ওল্টানোর সাথে সাথেই গল্পের রস গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। টান টান উত্তেজনা ঘিরে রেখেছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। ছোট ছোট অধ্যায়ে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে লেখা হয়েছে বলে পড়তে কোনোরূপ অসুবিধা হয়নি। শেষ করার পরও ঘোর থেকে গেছে অনেকক্ষণ।
গল্প বলার ধারাবাহিকতা অসাধারণ। পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতা আছে বলতে হবে। কাহিনী বিন্যাস সৃষ্টিতে লেখক মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। এতটাই সাজানো গোছানো যে পাঠকের উঠে যেতে মন সায় দেবে না। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে যে বিষয়টি বইটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে তা এর নামকরণ। কাহিনীর সাথে নামকরণের খুবই সামঞ্জস্য হয়েছে।
বাংলাদেশে মৌলিক থ্রিলার রচনায় যে কয়েক জন প্রশংসিত হয়েছেন, শরিফুল হাসান তাদের মধ্যে একজন। ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণকারী জনপ্রিয় এই লেখকের যাত্রা শুরু অনুবাদ দিয়ে। তারপরই রচনা করেছেন পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগানো বই ‘সাম্ভালা‘। পরে সাম্ভালার আরও দুটি পর্ব প্রকাশিত হয়েছে এবং তিনে মিলে হয়েছে ‘সাম্ভালা ট্রিলজি‘। এছাড়া মেঘ বিষাদের গল্প, ঋভু, ছায়াসময়, রাত্রি শেষের গান প্রতিটি বইতেই রয়েছে লেখকের লেখক সত্ত্বার ছাপ।
যারা রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প পড়তে পছন্দ করেন, বইটি তাদের জন্য সুখপাঠ্য হবে। সন্দেহ, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশোধ- একটি থ্রিলার জমাতে যা লাগে তার সবই পাবেন এতে। ‘বই থাকুক আপনার কাছে, আপনি থাকুন বইয়ের পাশে।’
বইয়ের নাম: আঁধারের যাত্রী || লেখক: শরিফুল হাসান
প্রচ্ছদ: ডিলান || প্রকাশক: বাতিঘর প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৬ || অনলাইনে প্রাপ্তিস্থান: রকমারি