নিজেকে বরাবরই কল্পবিজ্ঞানের ভক্ত বলে দাবি করতেন হুমায়ূন আহমেদ। রবীন্দ্রসঙ্গীত কিংবা লালনগীতির দর্শন আর দূর মহাশূন্যের ব্ল্যাকহোলের রহস্য দু’টোই তাকে সমানভাবে টানতো। কল্পনা আর বিজ্ঞানের মিশেলে কতটা যত্ন নিয়ে এই সায়েন্স ফিকশনগুলো লেখা হয়েছে, তা পড়ামাত্রই টের পাওয়া যায়। মুনীর হাসান একবার দুঃখ করেই বলেছিলেন,
স্যার যদি স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকগুলো লিখতেন, তাহলে নিশ্চয়ই এক দশক ধরে আমাদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে পড়ার আগ্রহ ৩৩ শতাংশ কমে যেতো না।
সায়েন্স ফিকশনের গ্র্যান্ডমাস্টার আইজাক আসিমভ থেকে শুরু করে এইচ জি ওয়েলস, আর্থার সি ক্লার্ক, রবার্ট লুই স্টিভেনসন, জুল ভার্ন কিংবা ফিলিপ কে ডিকের মতো খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের উপন্যাসগুলো পড়তে আগ্রহ সৃষ্টি করার পেছনে তার অবদান অনেক।
তারা তিনজন
বইটির কাহিনী শুরু হয় তিনটি প্রাণী- লী, অয়ু আর নীমকে কেন্দ্র করে। মানুষের মাপকাঠিতে তারা কিম্ভুতকিমাকার। তবে তাদের চিন্তাশক্তি দারুণ প্রখর। মহাকাশযানে চড়ে একদল অভিযাত্রী অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জের এক মৃত গ্রহে তাদেরকে আবিষ্কার করে। নিজেদের গ্রহ থেকে হারিয়ে যাওয়া অসহায় প্রাণী তিনটি দেখতে কদাকার হলেও কিন্তু মানুষের শত্রু নয়। নিজেদের সমন্বিত ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা বিশ্বজগতের অনেক রহস্যই সমাধান করে ফেলেছে। নিজেদের মধ্যেও ভালোবাসার কোনো কমতি নেই তাদের।
মানুষের সাথে যোগাযোগ করে তারা নিজেদের জ্ঞান বিস্তারের চেষ্টা করে। কিন্তু জন্মগতভাবেই হয়তো বা মানুষের প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম কোনোকিছুকে মেনে নেবার ক্ষমতা মানুষের নেই। অসামান্য বুদ্ধিমান প্রাণীগুলোর কর্মকাণ্ড, মহাকাশযানের যাত্রীদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর ঐ গ্রহে একটি রহস্যজনক সভ্যতা পাওয়ার সম্ভাবনা মিলিয়ে ভিন্নধর্মী একটি কল্পকাহিনীর স্বাদ দিতে পারে উপন্যাসটি। ভিনগ্রহবাসীদের এই গল্পের আড়ালে লেখক এখানে জেনোফোবিয়া তথা জাতিবিদ্বেষের দারুণ একটি মেটাফোর উপস্থাপন করেছেন। তার সেরা কল্পকাহিনীগুলোর মধ্যে এটা শীর্ষের দিকেই থাকবে।
ফিহা সমীকরণ
ভবিষ্যতের ডিস্টোপিয়ান পৃথিবী। মানুষের কাছে থেকে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে মেন্টালিস্টদের কাছে। তারা ভিনগ্রহবাসী কিংবা রোবট নয়, জেনেটিকভাবে উন্নত মানুষ। নিজেদের ডিএনএর বিশেষ গঠনের কারণে তারা যেকারো সাথে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে, নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যেকোনো মানুষের চিন্তাচেতনাকে। মানুষের স্বভাব-চরিত্র নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে অবশ্য তারা ভালোই শাসন করছে পৃথিবীকে, কোনো বিশৃঙ্খলা হচ্ছে না কোথাও।
মেন্টালিস্টদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পুষে রেখেই সেই পৃথিবীতে বসবাস করছেন খ্যাতনামা গণিতবিদ ফিহা। গণিতকে অস্ত্র করে তিনি চেষ্টা করছেন মেন্টালিস্টদেরকে ঠেকানোর। তবে রহস্যজনক কোনো কারণে মেন্টালিস্টেরা তাকে কোনো বাধা দিচ্ছে না। আর বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হলেও মেন্টালিস্টদের রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। ফিলিপ কে ডিকের ‘দ্য হুডমেকার’ ছোটগল্পের টেলিপ্যাথিক ‘টিপ’দের মতো মেন্টালিস্টরাও নানাভাবে বৈষম্যের শিকার পর্যন্ত হচ্ছে। পরিসরে ছোট হলেও কাহিনীর মোড়ে মোড়ে চমক পাঠককে বইটি শেষ করার আগে উঠতে দেবে না। আর এত সাবলীলভাবে টাইম প্যারাডক্সের মতো একটি মাথাঘোরানো বিষয়কে ফুটিয়ে তোলা কেবলমাত্র হুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই সম্ভব।
ইরিনা
এটিও ভবিষ্যতের ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীর কাহিনী। মানবসৃষ্ট এক মহাদুর্যোগে পৃথিবী প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেছেন মহাজ্ঞানী কিছু মানুষ, যাদের অমরত্ব নিয়ে নানা মিথ প্রচলিত আছে। শৃঙ্খলা আনার জন্য পৃথিবীকে তিন স্তরে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথম স্তরের নগরের মানুষজন নিম্নমানের জীবনযাপন করতে করতে প্রাণপণে চেষ্টা করে দ্বিতীয় স্তরে যাবার। দ্বিতীয় নগরে বিলাসবহুল ব্যবস্থার মাঝেও যারা আদর্শভাবে জীবনযাপন করতে চান তাদের জন্য হলো তৃতীয় নগর, যাকে মর্ত্যের মধ্যে ‘স্বর্গ’ বলে বিবেচনা করা হয়। তারও উপরে আছে নিষিদ্ধ নগরী, যেখানে মহাজ্ঞানী মানুষেরা বসবাস করেন।
কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করার, কৌতূহল প্রদর্শনের কিংবা নিয়ম ভঙ্গের কোনো সুযোগ নেই। সার্বক্ষণিক নজর রেখে চলেছে মহাশক্তিশালী কম্পিউটার সিডিসির তত্ত্বাবধানে হাজারো রোবট। প্রথম নগরের বাসিন্দা ইরিনা সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যবশত সুযোগ পেয়ে যায় নিষিদ্ধ নগরীতে যাবার। সেখানে যাবার সময়ে তার সাথে পরিচয় হয় কিছুটা বিদ্রোহী এবং নির্বিকার গোছের অখুন মীরের সাথে।
একের পর এক সমস্যা সমাধান করে ইরিনাকে কিছুটা বিরক্তই করে দেয় সে। এদিকে গ্যালাকটিক ইন্টেলিজেন্স প্রধান অরচ লীয়ন কিংবা সুপার কম্পিউটার সিডিসির উদ্দেশ্যও পরিষ্কার না। অমরত্ব লাভ করে কিংবা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও নিষিদ্ধ নগরীর মানুষেরা কি আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃতির কাছে অসহায়?
অনন্ত নক্ষত্রবিথী
একজন সাধারণ মানুষকে তার বিশেষ একটি ক্ষমতার কারণে কিছুটা জোর করেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় অনিশ্চিত এক অভিযানে। মহাশূন্য গবেষণা প্রকল্প থেকে পাঠানো হাইপারডাইভ ক্ষমতাসম্পন্ন সেই মহাকাশযানে তার সঙ্গী হিসেবে আছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ, ক্রু এবং বিস্ময়কর ক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকটি রোবট। অনেকের কাছে একে স্বপ্ন সত্য হবার মতো ব্যাপার মনে হলেও এই মানুষটির কাছে ঘটনাটি একটি অবিচার বলে মনে হয়।
কিন্তু হাইপারডাইভের মাধ্যমে অকল্পনীয় দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব হলেও একটি বিশাল সমস্যা হয়ে যায়। সময় সংকোচনের কারণে মহাকাশযাত্রীরা মহাশূন্যে যে সময় পার করে, তার বহুগুণ বেশি সময় পার হয়ে যায় পৃথিবীতে। নিজের এই দুর্ভাগ্যকে কোনোভাবেই মেনে নিতে না পারা মানুষটি তার পৃথিবীর সাদামাটা জীবনে ফিরে আসার জন্য অসাধ্য সাধন করতেও রাজি। রোমাঞ্চকর কোনো কিছুই তাকে আকৃষ্ট করে না। কাছের মানুষের সাথে আরেকবার দেখা করবার জন্য সে অনেক বড় একটি ঝুঁকি নিয়ে ফেলে। হাইপারডাইভ, ব্ল্যাকহোল, টাইম লুপ আর মহাকাশযানের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক মিলিয়ে একটি নিখুঁত সায়েন্স ফিকশন।
অন্য ভুবন
বরকতউল্লাহ একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। তার একমাত্র সন্তান তিন্নির বেশ কিছু রহস্যজনক আচরণের কোনো সমাধান করতে না পেরে অবশেষে মিসির আলীর শরণাপন্ন হলেন তিনি। রহস্যপিপাসু মিসির আলী সাথে সাথেই প্রত্যন্ত এলাকার রাজকীয় সেই বাড়িতে উপস্থিত হলেন। একবার দেখা করার পরই মিসির আলী বুঝলেন, তিন্নির অতিমানবীয় ক্ষমতা সম্পর্কে একবর্ণও বাড়িয়ে বলেননি তার বাবা।
পৃথিবীর নিয়ম হলো ক্ষমতাবানকে ভয় করা। নয় বছরের ফুটফুটে মেয়েটির ক্ষেত্রেও এই নিয়ম খাটে। টেলিপ্যাথি, প্রকৃতিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা, মানুষের ওপর প্রভাব খাটানো কিংবা কষ্ট দেবার ক্ষমতা থাকার পরও মা মরা মেয়েটি দারুণ নিঃসঙ্গ। আশেপাশের মানুষদেরকে নিজের আয়ত্তে রাখতে পারলেও তাদের কাছে নিজের অবস্থা বোঝাতে ব্যর্থ সে।
অন্য ভুবনের কারো দ্বারা পরিচালিত তিন্নিকে সুস্থ করার জন্য অবশ্য মিসির আলী কোনো চেষ্টার কমতি রাখেন না। সাধারণ পটভূমিতে হালকাভাবে লেখা কাহিনী হলেও উপন্যাসটি মনের ওপর দারুণ চাপ ফেলে। সায়েন্স ফিকশনের পাশাপাশি একে মিসির আলীর অন্য উপন্যাসগুলোর মতো সাইকোলজিকাল থ্রিলার হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।
শূন্য
মনসুর সাহেব নেত্রকোণা শহরের এক সাধারণ স্কুলশিক্ষক। গণিতের শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি অবসর সময়ে অঙ্ক কষতে ভারী পছন্দ করেন। এগারো বছর ধরে তার পৃথিবী থেমে আছে এক বিশেষ অঙ্ক নিয়ে। মানুষের সঙ্গের চেয়ে তাকে বেশি আকৃষ্ট করে মৌলিক সংখ্যা কিংবা ফিবোনাক্কির সিরিজ। লেখক বলেননি বটে, তবে মনসুর সাহেবের সাথে উপমহাদেশের খ্যাতিমান গণিতবিদ রামানুজনের ভালোই মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
একদিন ঘোর বৃষ্টির মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হয় এক তরুণের। সে মজা করে বলে তার নাম হলো ফিবোনাক্কি। এরপর মনসুর সাহেবের সাথে ঘটতে থাকে বিভিন্ন অদ্ভুত ঘটনা। আস্তে আস্তে পাঠকের কাছে খোলাসা হয় মনসুর সাহেব কোনো সাধারণ মানুষ নন। তার এই অঙ্কের ওপর নির্ভর করছে ভিন্ন এক জগতের অস্তিত্ব থাকা কিংবা না থাকা। হুমায়ূন আহমেদ বইয়ের এই কনসেপ্ট পেয়েছেন অনিদ্রায় রাত জাগতে জাগতে। বইয়ের ফ্ল্যাপে বলেছেন,
আমাদের এই শরীরের ভেতর আছে আরেকটি শরীর, আমাদের এই জগতের ভেতরে আছে আরেকটি জগৎ। সেই জগৎ সম্পর্কে লিখলে কেমন হয়?
কুহক
ষাটোর্ধ্ব নিশানাথ বাবু সাইনাসের সমস্যার জন্য এক্সরে করাতে এক হাসপাতালে গেলেন। সেখানকার এক্সরে মেশিন ম্যালফাংশন হয়ে তার শরীরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভয়াবহ মাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। কিন্তু পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবার বদলে নিশানাথ বাবু পেয়ে গেলেন আশ্চর্য কিছু ক্ষমতা। বলতে গেলে কমিক বইয়ের গল্পের মতো সুপার পাওয়ারই যেন পেয়ে গেলেন তিনি।
সাদা মনের এই মানুষটি তার এই অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা দিয়ে মানুষের মনের কলুষতাগুলো দূর করে দিতে চেষ্টা করতে থাকলেন। তবে এই অতিপ্রাকৃ্তিক ক্ষমতার জন্য অবশ্য অনেক বড় খেসারতও দিতে হলো তাকে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, সাইকোলজিকাল থ্রিলার কিংবা ফ্যান্টাসি যেকোনো জনরাতেই ফেলা যায় একে। আমাদের আশেপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার সাথে মিল রেখে অসাধারণ একটি কাহিনী সাজিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। মনে দাগ কেটে দেওয়া দারুণ একটি উপন্যাস উপহার দিয়েছেন পাঠকদেরকে।
এছাড়া হুমায়ূন আহমেদ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ছোটগল্পও লিখেছেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তাহারা, পরেশের ‘হইলদা’ বড়ি, আয়না, নিউটনের ভুল সূত্র, যন্ত্র, নিমধ্যমা, অঁহক, জাদুকর, কুদ্দুসের একদিন, সম্পর্ক।
অন্য ভুবনে চলে যাওয়া হুমায়ূন আহমেদের এই কল্পকাহিনীগুলো যেমন রোমাঞ্চ জাগায়, তেমনি আক্ষেপের জন্ম দেয়। উন্নত বিশ্বের কোনো লেখকের লেখা হলে হয়তো এতদিন এই কাহিনীগুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী সাড়া পড়ে যেত। তারপরও এই সায়েন্স ফিকশন এবং সাইকোলজিকাল থ্রিলারগুলোর মাধ্যমে তিনি যেভাবে দেশের তরুণ পাঠক আর লেখকদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন এবং করছেন, তার কোনো তুলনা নেই।
আরো জানতে পড়তে পারেন
হুমায়ূন আহমেদের কল্পবিজ্ঞানের জগত (প্রথম পর্ব)