বিশ্বের সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’। ইতালিয়ান ভাষার এই চলচ্চিত্রটির পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকা। ১৯৪৮ সালে তিনি এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্রটির কাহিনী নেয়া হয়েছে লুইজি বার্তোলিনির ‘বাইসাইকেল থিভস’ উপন্যাস থেকে।
ভিত্তোরিও ডি সিকার অমর সৃষ্টি এই “দ্য বাইসাইকেল থিফ” মূলত নিও-রিয়্যালিস্ট চলচ্চিত্র। নিও-রিয়্যালিস্ট চলচ্চিত্রগুলো দর্শকদের কাছে যেসব মুহূর্ত উপস্থাপন করে তা যেন মনে হয় বাস্তব জীবন থেকে নেয়া, বাস্তব ঘটনা ও মানুষের চিত্রায়ন। এসব চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলো বাস্তব মানুষের মতোই এবং এ ধরনের সিনেমাতে দৃশ্যায়িত হয় বাস্তবে দেখা প্রাকৃতিক ও অভ্যন্তরীণ দৃশ্যাবলী।
নিও রিয়ালিজম চলচ্চিত্রের সূচনার ইতিহাস ঘাটতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে অনেক বছর আগে। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চল্লিশের দশকের শেষে জন্ম নেয় এই শিল্পধারা। শিল্প মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের বয়স তখন ৫০ ছাড়িয়েছে, একটি প্রভাবশালী মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র যখন প্রতিষ্ঠিত, ঠিক সেই সময় ইতালিতে জন্ম নিয়েছে চলচ্চিত্রের এই নতুন শিল্পমন্ত্র নিও-রিয়্যালিজম।
ইতালিয়ান নিও-রিয়্যালিস্ট চলচ্চিত্রে ফুটে উঠেছে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালির প্রতিকূল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আদর্শিক প্রেক্ষাপটের দৃশ্য। এই নিও-রিয়্যালিজম শিল্পধারার মূল শ্লোগান ছিল ‘Take the camera out into the streets’। অর্থাৎ স্টুডিওর মেকি এবং কৃত্রিম পরিবেশ ছেড়ে ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ো। মানুষের সাধারণ জীবনে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলো তুলে ধরো ক্যমেরায়। জীবন যেখানে যেমন তাকে সেখানে তেমন করেই তুলে ধরো রুপালী পর্দায়। এরকম নতুন কিছু সৃষ্টির আহবান প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিলো কয়েকজন ইতালীয় পরিচালককে, যারা স্টুডিওর সাজানো মেকি পরিবেশ ছেড়ে নেমে এসেছিলেন পথের ধুলোয়। তাদেরই একজন ভিত্তোরিও ডি সিকা।
ইতালি তথা বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম প্রধান এই চলচ্চিত্রকার ১৯০২ সালের ৭ জুলাই রোমের নিকটবর্তী সোরায় জন্মগ্রহণ করেন। মঞ্চের সার্থক কমেডিয়ান ভিত্তোরিও ছিলেন নারী সমাজের প্রিয় তারকা, ম্যাটিনি আইডল। তারপর এলেন চলচ্চিত্রে। পরিচালনায় হাতেখড়ি হয় ১৯৪০ এ। কিন্তু চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু নির্বাক যুগ থেকে। প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ১৯১৭ সালে। তিনি ১৫০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালনা করেছেন ৪০টির মতো ছবি। পরিচালক ও অভিনেতার বাইরে তিনি একজন চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক। প্রায় ২৫টি ছবির চিত্রনাট্য তৈরি ও ৫টির মতো ছবি প্রযোজনা করেন। তবে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন পরিচালনায় এবং বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, থাকবেন পরিচালক হিসেবেই।
চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশের বছর দেড়েক পর বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার জাভাত্তিনির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। এ ঘনিষ্ঠতা আর বন্ধুত্বই ডি সিকার ধ্যানধারণা বদলে দেয়। জাভাত্তিনির সান্নিধ্যে ডি সিকার মাঝে জাগ্রত হয় মানবতা আর রাজনৈতিক চেতনার গভীর স্পন্দন। ডি সিকা মুখ ফিরিয়ে নেন সস্তা সেন্টিমেন্টের বানানো গল্প থেকে। তার জন্য চিত্রনাট্য লিখতে বসেন জাভাত্তিনি। ছবির নাম ‘দ্য চিলড্রেন আর ওয়াচিং আস’ (১৯৪৪)। কিন্তু মুক্তি পেলো না, আপত্তি জানালো সরকার। শেষপর্যন্ত ১৯৪৪ সালে করা এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তা-ও স্বদেশে নয়, ফ্রান্সে।
১৯৪৫ সালে রবার্তো রোজেলিন নির্মাণ করলেন ‘রোম, ওপেন সিটি’। এ ছবি হয়ে উঠলো নিও-রিয়ালিজমের আদর্শ। এ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে ডি সিকা নির্মাণ করলেন ‘শু-সাইন’ (১৯৪৬)। ‘শু-সাইন’ ও ‘রোম, ওপেন সিটি’ একসঙ্গে প্রদর্শিত হলো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ‘শু-সাইন’ জিতে নিলো সম্মানসূচক অস্কার। বিশ্বের সম্মান মাথায় নিয়ে দুজনই হয়ে উঠলেন ইতালি চলচ্চিত্রের নেতা। কিন্তু তাতেও সরকার নমনীয় হলো না। ফলে ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ এর জন্য প্রযোজক পাচ্ছিলেন না পরিচালক ডি সিকা। মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি জোগাড় করলেন ছবি নির্মাণের রসদ। নির্মিত হলো বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসের অনন্য সৃষ্টি ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’।
‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ চলচ্চিত্রের দৃশ্যপটে উঠে এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতালি। ফুটে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতালির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার চিত্র।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে কয়েক বছর হলো। পরাজিত শক্তি ইতালি তখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বেশ দুর্বল। চারদিকে বেকারত্ব। কাজের সন্ধানে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক ছোটাছুটি করছে এদিক-সেদিক। এন্টোনিও রিকিও তাদের মতো একজন। তাকে ঘিরেই পুরো চলচ্চিত্রের কাহিনী।
স্ত্রী ও দুই পুত্র নিয়ে তার পরিবার। হতাশায় নিমজ্জিত বেকার এন্টনিও রিকি একদিন হঠাৎ করে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার লাগানোর একটি চাকরি পেয়ে যায়। কিন্তু এই কাজের জন্য প্রয়োজন একটি বাইসাইকেল। চাকরিদাতাদের কঠিন শর্ত- বাইসাইকেল জোগাড় করতে না পারলে চাকরি হবে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যেখানে হাজার হাজার লোক একটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে, সেখানে এরকম একটি চাকরি পাওয়া বিশাল ব্যাপার। কাজেই চাকরি হাতছাড়া করা যাবে না। কিন্তু বাধ সাধলো বাইসাইকেল। অবশেষে ‘সাইকেল জোগাড় করা যাবে’ এই শর্তে সে চাকরিটি নিয়ে নেয় সে। কিন্তু তাকে ঘিরে ধরে আরেক চিন্তা; কথা তো দিলো, কিন্তু সাইকেল পাবে কোথায়? এ সময় এগিয়ে আসে রিকির স্ত্রী মারিয়া। বিয়েতে পাওয়া দামি চাদরগুলো বিক্রি করে সাইকেল কেনা হয়।
সাইকেল কেনার পর থেকেই বাবা ছেলের মাঝে অন্যরকম এক উদ্দীপনা। কাজের প্রথমদিন সকালে রিকি তার ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ওই দিনই সাইকেলটি চুরি যায়। এরপর ছবির কাহিনি আবর্তিত হয়েছে সাইকেলটি পাওয়া আর না পাওয়ার দোলাচলের মধ্যে। ছয়-সাত বছরের শিশুপুত্র নিয়ে সে রোমের রাস্তায় রাস্তায় সাইকেলটা খোঁজে। কিন্তু পায় না। এদিকে সংসার চালানো খুব কষ্ট। সাইকেল হারানোর বেদনায় রিকির স্ত্রী যখন ক্রন্দনরত তখন এগিয়ে আসে রিকির এক বন্ধু। সে রিকিকে আর তার ছেলেকে নিয়ে সাইকেল উদ্ধারের চেষ্টায় বেরিয়ে সাইকেলটির খোঁজ পায়, কিন্তু প্রমাণের অভাবে উদ্ধার করতে পারে না। নদীর ঘাট, খেলার মাঠের বাইরে সে তার চুরি যাওয়া বাইসাইকেল খুঁজতে থাকে। একসময় এক চোরের পিছনে কিছুটা পথ ধাওয়া করে তার হারিয়া যাওয়া সাইকেলের তথ্য পাওয়ার জন্য। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হয়, হারিয়ে ফেলে সেই চোরকে।
সাইকেল ফিরে পাবার সকল সম্ভাবনাই উবে যায়। কিন্তু পরদিন যে তাকে কাজে যেতে হবে। রাস্তায় রাখা অন্য একটি সাইকেলের দিকে নজর পড়ে রিকির। অনেক দোলাচলের পর মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় এই বাইসাইকেল সে চুরি করবে। স্টেডিয়ামের বাইরে অনেক সাইকেল রাখা। ভেতরে খেলা চলছে। ছেলেকে বাসে করে চলে যাওয়ার কথা বলে সুযোগ বুঝে সে একটা সাইকেল চুরি করে পালাতে চেষ্টা করে।
কিন্তু চুরি করবার দক্ষতা যে তার নেই। প্রাণপণে সাইকেল নিয়ে ছুটতে গিয়ে একসময় সে ধরা পড়ে যায়। জনগণের কাছে মার খায়। এদিকে বাসটিতে উঠতে না পেরে ব্রুনো (রিকির ছেলে) যখন পেছনে ফিরে তাকায়, তখন তার বাবাকে আবিষ্কার করে জনরোষের কবলে। শিশুপুত্রের চোখের সামনে গরীব শ্রমিককে মারছে তারা। অথচ এই শ্রমিকের একমাত্র সাইকেল চুরি হয়ে গেছে, যার আর কোনো সম্বল নেই, যাকে এই চাকরিটা করতেই হবে, সেই বাবাকে ছোট্ট ছেলের চোখের সামনে মারছে জনগণ।
ব্রুনো “বাবা, বাবা” বলে কাঁদছে। অসহায় বাবা তার সন্তানের সামনে অপমানিত হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। বাবার সেই অসহায় চাহনি, আর শিশুর সেই বিস্মিত চোখ পরিচালক ডি সিকা যেন একেবারে জলজ্যান্ত তুলে এনেছেন রুপালী পর্দায়। দুর্ভাগ্যপীড়িত রিকির আসল অবস্থা বুঝতে পেরে সাইকেলের মালিক তাকে ছেড়ে দেয়। লজ্জিত ও অপমানিত রিকি এবং তার ছেলে ব্রুনো জনবহুল রাস্তায় হেঁটে বাড়ি ফিরতে থাকে। এমন দৃশ্যের মধ্যে দিয়েই শেষ হয়ে যায় ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’।
এখানে সমাজ বাস্তবতা উঠে এসেছে হুবহু, সত্যিকারভাবে। আরোপিত বা অতি নাটকীয় কোনো গল্প না। পিতা-পুত্রের অসহায়ত্ব, বিচ্ছিন্নতা, অর্থনৈতিক কারণে বিষাদের মধ্য দিয়ে এক বিশ্বাসযোগ্য পটভূমি উঠে এসেছে ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ চলচ্চিত্রে।
জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায় তার ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ‘পথের পাঁচালী’ তৈরিতে। ডি সিকা যে সত্যজিৎ রায়ের গুরু ছিলেন তা-ও অকপটে বলেছেন সত্যজিৎ।
সত্যজিত রায়ের ভাষ্যমতে,
“ইতালীয় ফিল্ম এত আলোড়ন তুলেছে কেন ভেবে দেখতে গেলে কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। হলিউড এতকাল ধরে তিলে তিলে যেসমস্ত অবাস্তব রীতি প্রতিষ্ঠা করেছে, একমাত্র ইতালি পেরেছে সেই আজগুবি রীতিকে ফুঁ দিয়ে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতে। অভিনয়ের জন্য তারকারাজি সম্মেলন করার রীতি যে কত বড় বিরাট মূর্খতা, ইতালীয়রা তা হাতে হাতে প্রমাণ করে দিয়েছে। তাঁরা দেখিয়েছে যে ছবি তুলতে কুবের ভাণ্ডার উজাড় করার কিংবা চটুল চাকচিক্যের জৌলুস দেওয়ার এবং সেই ছবি কাটতির জন্য বিশ্বব্যাপী হই হই রই রই আওয়াজ তোলার কোনোই প্রয়োজন নেই।
বলতে গেলে প্রায় সূচনা থেকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়েছে বলে ইতালীয়রা চলচ্চিত্রের মূল ভিত্তির সন্ধান রাখেন। ব্যাপারটা বড় সহজ হয়নি। চলচ্চিত্র নির্মাণের পদ্ধতিটাই তো জটিল, কিন্তু তার মধ্যেই ইতালীয়রা সারল্যে, সততায়, বাস্তবিকতায় সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করে এসেছেন। নতুন পদ্ধতির এই নতুন পাঠশালায় রসেলিনি, ডি সিকা, ভিসকন্তি, লাতুয়াদা– এরাই হচ্ছেন গুরু।” (সত্যজিৎ রায়, প্রবন্ধ সংগ্রহ)
‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ এর ঝুলিতে এসেছে অনেক পুরস্কার। ১৯৪৯ সালে সেরা চিত্রনাট্যের জন্য সিজেয়ার জাভাত্তিনি অস্কার মনোনয়ন লাভ করেন। সম্মানসূচক অস্কার পেয়েছেন ১৯৫০ সালে। ১৯৪৯ সালে গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার জিতে নিয়েছে সেরা বিদেশি চলচ্চিত্র বিভাগে। বাফটা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ১৯৫০ এ। এরকম আরও অসংখ্য পুরস্কার আছে।
পুরস্কার দিয়ে কখনো মাপা যাবে না ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ চলচ্চিত্রের মাহাত্ম্য। দেড় ঘন্টা দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রে তৎকালীন সমাজ ও মানব জীবনের গল্প, সেই জীবনে অর্থনীতির প্রভাব, পিতা-পুত্রের সম্পর্কের এক গভীর রুপ, একজন সৎ মানুষের হাহাকার, পরোক্ষভাবে সমাজে যুদ্ধের কুফল- কী নেই এই ছবিতে! নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিশ্বসেরা দশটি ছবির মধ্যে এটি একটি।
ফিচার ইমেজ: হলিউড রিপোর্টার