সমুদ্রের বুকে জনারণ্য এক স্বর্গ দ্বীপ, নাম তার ‘থেমিস্কিরা’। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, পুরো দ্বীপে নেই একটিও পুরুষ! সবাই এখানে নারী! এ কেমন কথা?
এরা সবাই হলো যোদ্ধা ‘আমাজন নারী’। অলিম্পাস পর্বতের দেবতারা তাদের বানিয়েছেন মানবজাতিকে রক্ষা করতে। কিন্তু এই পুরো দ্বীপের অসংখ্য প্রাপ্তবয়স্কা নারীর মাঝে শিশু কেবল একটি মেয়ে- ডায়ানা। বড় হলে তার পরিচয় হয়, ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’। কিন্তু কেন সে এই দ্বীপের একমাত্র শিশু? কী এর পেছনের রহস্য?
অসাধারণ অ্যাকশনদৃশ্যে ভরপুর এই ছায়াছবিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইসরায়েলি অভিনেত্রী গাল গাদোত। একজন নারী পরিচালকের পরিচালিত এযাবতকালের সর্বোচ্চ আয় করা মুভি এখন ওয়ান্ডার ওম্যান। তবে সে কথায় আসছি পরে।
বলছিলাম দেবতাদের কথা। দেবরাজ জিউস আর অন্যান্য দেবতাকে আক্রমণ করে বসেন জিউসেরই ছেলে যুদ্ধের দেবতা অ্যারিস। একে একে সকল দেবতার পতন ঘটে, মারা যাবার আগ মুহূর্তে জিউস অ্যারিসকে আহত করেন এবং যোদ্ধা আমাজন নারীদের দিয়ে যান এক মারণাস্ত্র- ‘গডকিলার’ নামের এক জমকালো তলোয়ার। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এ তলোয়ার দিয়ে হত্যা করা যায় দেবতাকেও।
অন্যান্য মেয়ের মতো ডায়ানাকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে দেন না তার মা রানী হিপোলাইটা। কারণ তার বিশ্বাস, অ্যারিস আর কখনোই ফিরবে না, তাই যুদ্ধেরও দরকার নেই। কিন্তু তারপরেও দুর্দান্ত যোদ্ধা জেনারেল অ্যান্টিওপ বোনের কথা অমান্য করে ডায়ানাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় করে তোলেন গোপনে। কে জানতো ডায়ানাই হতে যাচ্ছে সবার সেরা যোদ্ধা?
১৯১৮ সাল। চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, কিন্তু থেমিস্কিরা দ্বীপের কারো এ ব্যাপারে মাথা ব্যথা নেই, কারণ কেউ জানেই না এ কথা। হঠাৎ একদিন দ্বীপের জাদুকরি ব্যূহ ভেদ করে প্রবেশ করে এক জার্মান যুদ্ধ জাহাজ, উদ্দেশ্য মিত্রবাহিনীর এক পলাতক আমেরিকান পাইলট স্টিভ ট্রেভরকে (ক্রিস পাইন) পাকড়াও করা। সবার আগে স্টিভকে দেখতে পায় রাজকন্যা ডায়ানা- জীবনে প্রথমবারের মতো তার পুরুষ দর্শন! কিন্তু এরপরেই যে তুলকালাম যুদ্ধ ঘটে যায়, তাতে মারা পড়ে অনেক আমাজন যোদ্ধা, যার মাঝে তার প্রশিক্ষক জেনারেল অ্যান্টিওপও ছিলেন।
ডায়ানার বিশ্বাস, এ বিশ্বযুদ্ধ আসলে অ্যারিসের চাল। অ্যারিসকে হত্যা করতে পারলেই শান্তি নেমে আসবে পৃথিবী জুড়ে। তাই রাতের আঁধারে ডায়ানা গডকিলার তলোয়ার নিয়ে স্টিভের সাথে বেরিয়ে পড়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে। যেকোনো মূল্যেই হোক, সে থামাবে এই যুদ্ধ। কিন্তু সে যা ভাবছে সেটাই কি ঠিক? তাছাড়া যে সমাজে সে কোনোদিন চলেনি, সেখানে গিয়ে কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নেবে ডায়ানা? আর তার ক্ষমতাগুলোই বা কী?
এরকম দুর্দান্ত এক কাহিনী নিয়েই এগিয়ে গিয়েছে এ মুভির প্লট। যদি এখনো দেখে না থাকেন, তবে অতি অবশ্যই এখুনি দেখে ফেলবেন। গাল গাদোতের অভিনয় যে আপনার হৃদয় কেড়ে নেবে, সেটা হলফ করে বলা যায়।
কিন্তু যতই নজরকাড়া অভিনয় থাকুক না কেন, বিতর্ক কিন্তু পিছু ছাড়েনি এ চলচ্চিত্রের। লেবাননে মুভিটি নিষিদ্ধ করা হয়, কারণ গাল গাদোত এক সময় ইসরায়েলের মিলিটারিতে ছিলেন। ২০১৪ সালে গাজার যুদ্ধে গাল গাদোতের ইসরায়েলকে সমর্থন করা বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তিউনিসিয়ার এক আদালতও এ মুভি থিয়েটারে ছাড়তে বাধা দেয়। জর্ডানও একই পথে হাঁটছিল, কিন্তু পরে ২০১৭ সালের জুনের ১১ তারিখ জানা গেল, জর্ডান সরকার মুভিটি নিষিদ্ধ করবে না।
গাল গাদোত কিন্তু সত্যি সত্যিই ইসরায়েলের মিলিটারিতে ছিলেন। যখন ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে তার ডাক পড়ে, তখন তার বয়স ২০ বছর। এতে অবাক হবার কিছু নেই, সে দেশে সবাইকেই বাধ্যতামূলক যোগদান করতে হয় সেনাবাহিনীতে। এসব ছাড়াও গাল গাদোত আইন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। কসমোপলিটান, গ্ল্যামার, ব্রাইড ম্যাগাজিন, এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি ইত্যাদির প্রচ্ছদে এসেছেন তিনি। যখন তার বয়স ১৮, তখন সুন্দরী গাল গাদোত জিতেছেন ‘মিস ইসরায়েল‘ খেতাব, ২০০৪ সালে তিনি অংশ নেন মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতাতেও।
২০১৭ সালের ৯ জুলাই পর্যন্ত ওয়ান্ডার ওম্যান মুভিটি আয় করে নিয়েছে ৭৪৫.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ মুভির বাজেট ছিল মাত্র ১৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার!
মুভিটি নিয়ে কিছু ব্যতিক্রমী তথ্য জেনে নেয়া যাক এবারে। মুভিটির কিছু অংশের যখন আবার শুটিং চলছে, তখন গাল গাদোত পাঁচ মাসের গর্ভবতী। এ কারণে তার স্ফীত পেট ঢাকবার জন্য একটি গ্রিন স্ক্রিনের সাহায্য নিতে হয় সিনেমা কৌশলীদের, যেন এডিট করবার সময় সেটি ঠিক করে ফেলা যায়। মুভির শুটিংয়ের জন্য গাল গাদোত নয় মাস ব্যায়াম করে ১৭ পাউন্ড পেশী গড়ে তোলেন!
যদিও কমিক্স বইতে ডায়ানা স্টিভের দেখা পেয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, মুভিতে সেটি পরিবর্তন করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রযোজক স্নাইডারকে মুভিতে এক ঝলক দেখাও গিয়েছে একজন সৈন্য হিসেবে।
গাল গাদোতের আগে সেই ২০০৫ সালে আঞ্জেলিনা জোলিকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ওয়ান্ডার ওম্যান হবার, কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এই প্রস্তাব। এমনকি ইভা গ্রিনকে নিয়েও ভাবা হয়েছিল এই চরিত্রের জন্য।
পরিচালক প্যাটি জেনকিন্স-এর এটি যে সফলতম প্রোজেক্ট, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। তবে এর আগে তিনি আরেকটি নামকরা প্রজেক্টের পরিচালক ছিলেন, জনপ্রিয় কমেডি সিরিজ ‘Arrested Development‘।
পুরস্কারের কথা বাদ যাবে কেন! ২০১৭ সালের ৬ জুন, ওয়ান্ডার ওম্যান মুভিটি গোল্ডেন ট্রেইলার এ্যাওয়ার্ডের তিনটি ক্যাটাগরিতে জিতে নেয় পুরস্কার। আর আগস্টের ১৩ তারিখ টিন চয়েস এ্যাওয়ার্ডসেও তিনটি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায় মুভিটি, এর মাঝে সেরা অ্যাকশন অভিনেত্রী ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পান গাল গাদোত, আর সেরা অ্যাকশন অভিনেতায় ক্রিস পাইন।
প্যাটি জেনকিন্স একটিমাত্র মুভির জন্যই চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সিকুয়েল পরিচালনা করার; পরবর্তীতে তিনি ব্যাপারটি নিশ্চিত করেন। যদিও কিছু পরেই আবার জানান যে, এটা এখনো নিশ্চিত না। আপাতত সিকুয়েলের চিত্রনাট্য লেখা চলছে।
ওয়ান্ডার ওম্যান মুভির প্রিমিয়ার হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৫ মে, চীনের সাংহাইতে। ২০১৭ সালের ল্যাঞ্চেস্টার বোমা হামলার কারণে লন্ডনে অনুষ্ঠিতব্য প্রিমিয়ারটি বাতিল করা হয়। আমেরিকার লস এঞ্জেলেসে প্রিমিয়ার হয় ২৫ মে। মুভির প্রচারণার জন্য সিডব্লিউ চ্যানেলের সিরিজ সুপারগার্ল শোয়ের অভিনেত্রী মেলিসা বেনোইস্ট ওয়ান্ডার ওম্যানের বুট জুতা পরিহিত অবস্থায় বিজ্ঞাপন করেন।
উল্লেখ্য, সত্তরের দশকের ওয়ান্ডার ওম্যান অভিনেত্রী লিন্ডা কার্টার বর্তমানে সুপারগার্ল শোতে অভিনয় করছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে। সুইসাইড স্কোয়াডের চেয়েও বেশি (প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার) খরচ হয়েছে ওয়ান্ডার ওম্যানের টিভি বিজ্ঞাপনের জন্য। সুইসাইড স্কোয়াডের ক্ষেত্রে অঙ্কটা ছিল ২.৬ মিলিয়ন ডলার।
এর আগ পর্যন্ত রটেন টমেটোজে কোনো ডিসি মুভির রেটিং ৯০% এর উপরে ওঠেনি। গাল গাদোতকে আবারো দেখা যাবে এ বছরই জাস্টিস লীগ মুভিতে, মুক্তি পাচ্ছে ১৭ নভেম্বর। তবে তার আগে IMDb-তে ৭.৯ আর রটেন টমেটোজে ৯২% রেটিং পাওয়া ২ ঘণ্টা ২১ মিনিট দৈর্ঘ্যের চোখ ধাঁধানো স্পেশাল ইফেক্ট আর চমৎকার সাউন্ড ইফেক্ট সম্বলিত ওয়ান্ডার ওম্যান মুভিটি দেখে নিতে ভুলবেন না যেন!