গত ১৭ই সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে টিভি সিরিজের সবথেকে বড় মহোৎসব ‘প্রাইম টাইম এমি অ্যাওয়ার্ড’ এর ৭০তম আসর বসেছিল। ২০১৭ সালের ১লা জুন থেকে শুরু করে এ বছরের ৩১শে মে পর্যন্ত যে সকল সিরিজ দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য টিভি পর্দায় আবির্ভূত হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে থেকে সেরাগুলোকে নানা শাখায় পুরস্কৃত করাই ছিল এই আসরের মুখ্য উদ্দেশ্য।
অন্যান্য অনেক ছোট ছোট শাখার পাশাপাশি প্রতিবছর পাঁচটি সিরিজকে পাঁচ রকমের ক্যাটাগরিতে সেরা সিরিজ হিসেবে ভূষিত করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি হলো ‘আউটস্ট্যান্ডিং লিমিটেড সিরিজ’ ক্যাটাগরি। সাধারণত যদি কোনো সিরিজের শুধু একটি সিজন হয়ে থাকে অথবা সিরিজটি অ্যান্থোলজি ঘরানার হয়ে থাকে, তবেই এ শাখার জন্য মনোনয়নপ্রাপ্ত হয়। আর এ বছর ‘গডলেস’, ‘জিনিয়াস: পিকাসো’, ‘প্যাট্রিক মেলরোস’ এর মতো বিগত আট-নয় মাসের অন্যতম জনপ্রিয় সিরিজগুলো এ শাখায় মনোনয়ন পায়। তবে এদেরকে পেছনে ফেলে জিতে নেয় এই একই শাখায় মনোনীত সিরিজ ‘দ্য অ্যাসাসিনেশন অব গিয়ানি ভার্সাসে: আমেরিকাম ক্রাইম স্টোরি’।
ট্রু ক্রাইম অ্যান্থোলজি ঘরানার এই সিরিজটি ‘আমেরিকাম ক্রাইম স্টোরি’ সিরিজের দ্বিতীয় সিজন হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। এর আগে আমেরিকান ক্রাইম স্টোরি সিরিজের প্রথম সিজন ‘দ্য পিপল ভার্সেস ও. জে. সিম্পসন’ নিয়ে বিস্তারিত রিভিউ দেওয়া হয়েছিল৷ আর আজ তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সিরিজের দ্বিতীয় সিজন ও সদ্য এমি জয়ী ‘দ্য অ্যাসাসিনেশন অব গিয়ানি ভার্সাসে’ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করা হবে। তবে বলে রাখা ভালো, এই দুই সিজনের প্রেক্ষাপট, চিত্রনাট্য ও চরিত্র পুরোপুরি ভিন্ন ও স্বতন্ত্র।
২০১৬ সালে প্রথম সিজন মুক্তি পাবার পর প্রায় দেড় বছরের বিরতির পর এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় সিজন নিয়ে দর্শকদের সামনে আসে আমেরিকান ক্রাইম স্টোরি। প্রথম সিরিজে সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে খুঁতখুঁতে সমালোকচকদের প্রশংসা কুড়িয়ে নেওয়ার পর এ সিজন আরও চমকপ্রদ কিছু নিয়েই উপস্থিত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নামকরা ক্রোড়পত্র ‘ভ্যানিটি ফেয়ার ম্যাগাজিন’ এর বিশেষ সংবাদদাতা মারিন ওর্থের ‘ভালগার ফেভার্স: অ্যান্ডু কুনানান, গিয়ানি ভার্সাসে অ্যান্ড দ্য লার্জেস্ট ফেল্ড ম্যানহান্ট ইন ইউ.এস. হিস্ট্রি’ উপন্যাসকেই সেক্ষেত্রে মূলগল্প হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। টেলিভিশন চ্যানেল ফক্সে ব্রডকাস্ট হওয়া এ সিরিজের এ সিজনের প্রেক্ষাপট গড়ে উঠেছিল বিখ্যাত ইতালিয়ান ফ্যাশন ডিজাইনার গিয়ানি ভার্সাসের হত্যাকান্ড ও তার পেছনে জড়িত এক পাগলাটে ক্রমিক খুনির গল্পকে ঘিরে।
সিরিজের প্লটে প্রবেশ করার আগে বাস্তব জীবনের গিয়ানি ভার্সাসে ও তার জীবন সম্পর্কে খানিকটা ধারণা নিয়ে আসা যাক।
গত শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝিতে ভার্সাসে ইতালির রেজিও ক্যালাব্রিয়া শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন৷ ড্রেসমেকার মা ফ্রান্সেসকা ছাড়াও তার পরিবারে বাবা, বড় ভাই স্যান্তো ও ছোট বোন ডলাটেলা ছিল। তার বড় বোন টিনা মাত্র বারো বছর বয়সে ভুল চিকিৎসার ফলে অকালে প্রাণ হারায়। ছোটকাল থেকে গিয়ানিকে প্রাচীন গ্রিক ইতিহাস টানতো বলে তিনি এর উপর পড়াশোনা শুরু করলেও বেশি দূর এগোতে পারেননি। কারণ ছোটকাল থেকে মায়ের হাতে সুঁই-সুতা দেখে অভ্যস্ত থাকা গিয়ানি কখন যে এসবের প্রেমে জড়িয়ে গিয়েছিলেন তা নিজেও টের পাননি। আর তাই ২৬ বছর বয়সে ফ্যাশন ডিজাইনার হবার স্বপ্ন চোখে ধারণ করে তিনি মিলান শহরে পাড়ি জমান। এরপর মাত্র কয়েক বছর সাধনার পর ও অল্প অল্প সফলতা দিয়ে নিজের ঝুলি পরিপূর্ণ করার পর ১৯৭৮ সালে তার প্রথম বুটিক শপের উদ্বোধন ঘটে।
এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার বুটিকশপের নতুনত্ব ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় নকশা করা অসাধারণ সব ড্রেস তাকে আন্তর্জাতিক বাজারে এনে দিয়েছিল আকাশচুম্বী খ্যাতি৷ সেই যুগে গিয়ানি ভার্সেসের ডিজাইন করা ড্রেস মানেই ছিল অভিজাত ও বিত্তশালী নারীদের জন্য বিলাসিতার বস্তু। ধীরে ধীরে ভাই স্যান্তো ও বোন ডলাটেলার সহযোগিতায় ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করে তোলেন গিয়ানি। ড্রেসের পাশাপাশি সুগন্ধি, গয়না ও ঘরোয়া জিনিসপত্রও পাওয়া যেতে শুরু করে ‘ভার্সাসে’ প্রতিষ্ঠানের অধীনে। এ সময় ভাই ও বোন ছাড়াও তার পাশে ছায়ার মতো ছিলেন অ্যান্টোনিও ডি’ অ্যামিকো নামের একজন মডেল ও ফ্যাশন ডিজাইনার। মূলত সমকামী পুরুষ গিয়ানির প্রেমিক ছিলেন তিনি। অর্থ, যশ, খ্যাতি, সম্মান ও ভালোবাসায় সিক্ত গিয়ানি ১৯৪৬ সালের ১৫ই জুলাই মিয়ামিতে নিজ বাসভবনের সামনে অতর্কিত গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। পরে মার্কিন আইন সংস্থাগুলোর দীর্ঘমেয়াদী ও জটিল তদন্তের মাধ্যমে তার খুনের পেছনের গল্প ও খুনি বেরিয়ে এলেও, গিয়ানির হত্যাকান্ডের পরিণতিটা কেমন যেন অপূর্ণই থেকে যায়। আর সেই গল্পটাই তুলে ধরা হয়েছে ‘দ্য অ্যাসাসিনেশন অব গিয়ানি ভার্সাসে’ সিরিজটিতে।
তাহলে চলুন, এবার প্লট থেকে ঘুরে আসা যাক। সিরিজের শুরুটাই হয় গিয়ানি ভার্সাসের হত্যাকান্ডের ঘটনার চিত্রপ্রবাহের মাধ্যমে। ১৯৯৭ সালের ১৫ই জুলাই গিয়ানি আট-দশটা সাধারণ দিনের মতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে জগিংয়ে বের হন। জগিং শেষ করে নিজের ম্যানশনের গেট দিয়ে ঢোকার সময় একজন দুর্বৃত্ত তাকে নিশানা করে গুলি ছোড়ে। গুলির শব্দ শুনে বাসার ভেতর থেকে তার বন্ধু অ্যান্টোনিও দৌড়ে আসলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। গুলি খেয়ে গিয়ানি গেটের সামনের রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। অ্যান্টোনিও দুর্বৃত্তের এক ঝলক দেখলেও তাকে ধরার আগেই সে পালিয়ে যায়। তিনি তড়িঘড়ি করে গিয়ানিকে হাসপাতালে নিলেও তাকে শেষমেশ আর বাঁচানো যায়নি। এই গল্পপ্রবাহই সিরিজের প্রথম পর্বের চিত্রনাট্যে রূপায়িত হয়েছে। এছাড়া এ পর্বে সাত বছর আগে অ্যান্ড্রু কুনানান নামে একজন তরুণের সাথে গিয়ানির কোথায় ও কীভাবে পরিচয় ঘটেছিল, তা-ও দেখানো হয়। দর্শক খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন, এই সেই লোক যে কি না গিয়ানিকে খুন করেছে। কিন্তু কেন? সাত বছর আগে তো তাদের দুজনের মোটামুটি ভালো একটা পরিচয় উঠেছিল। এই সাত বছরের ব্যবধানে, তাদের জীবনে এমন কী ঘটলো যার কারণে কুনানানের খুনির খাতায় নিজের নাম লেখাতে হলো?
সেই গল্প তুলে ধরতে হলে ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই সাত বছর গিয়ানি ও কুনানান দুজনের জীবনে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনার উপর আলোকপাত করা আবশ্যক। দর্শক যত সিরিজের গভীরে যেতে থাকবেন, তত বেশি গিয়ানি ও কুনানান সম্পর্কে অল্প অল্প ধারণা পেতে শুরু করবেন। এ সিরিজটির চিত্রনাট্য এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে অতীত ও বর্তমান অনেকটা মিলেমিশে একাকার হয়ে পুরো কাহিনীকে পূর্ণতা দিতে পারে। কখনো গিয়ানির মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা দেখানো হলে পরের দৃশ্য আবার পেছনের গল্পে ফিরে যেতে পারে। তাই সিরিজটি দেখতে বসার সময় যে ব্যাপারটি প্রতিটি দর্শককে মনে রাখতে হবে, তা হলো, কাহিনীর যোগসূত্রগুলোর দিকে খেয়াল করা ও সেগুলোকে জোড়ায় জোড়ায় মিলিয়ে সিরিজের আসল গল্পের স্বাদ উপভোগ করা। সিরিজের গল্পে যে শুধু গিয়ানির জীবনধারা, তার ব্যক্তিগত জীবনের একঝলক ও তার পারিবারিক জীবনের গল্প চিত্রায়িত হয়েছে, তা কিন্তু নয়। তার খুনি কুনানের আরও কিছু হত্যাকান্ড ও কুনানের ব্যক্তিগত জীবনের উপরও সমানভাবে জোর দেওয়া হয়েছে৷ সত্যি বলতে কি, সিরিজের গিয়ানির থেকে কুনানানই বেশি স্পটলাইটে ছিল।
যেহেতু সিরিজে ও বাস্তবে গিয়ানির হত্যাকান্ডের পেছনে কুনানানের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, সেহেতু বাস্তব জীবনের আলোকে সিরিজের গল্পের সাথে সাদৃশ্য রেখে কুনানান চরিত্রটি একটু বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেওয়া যাক।
১৯৯১ সালে অ্যান্ড্রু কুনানানের গিয়ানির সাথে যখন প্রথমবারের মতো দেখা হয়েছিল, তখন সে ছিল ২১ বছরের টগবগে এক তরুণ। সর্বদা মুখে হাসি লেগে থাকা কুনানান নিজেকে পরিচিত ও অপরিচিত সবার কাছে অনেক বিত্তশালী ও উঁচু বংশীয় বলে জাহির করে আসত। সে নানা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ধনাঢ্য ও অভিজাত পুরুষদের সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টা করে থাকত। গিয়ানির সাথেও সে একই কাজ করেছিল। ছলে-বলে-কৌশলে সেসব স্বনামধন্য পুরুষদের জীবনে ঢুকে পড়া ও তাদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা ছিল কুনানানের মূলমন্ত্র। কিন্তু গিয়ানির জীবনে অ্যান্টোনিওর প্রভাবের সামনে কুনানানের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সুদর্শন বাহ্যিকতা তেমন প্রশ্রয় পেয়ে ওঠেনি। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কুনানান যে কজন পুরুষের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তাদের নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে ও নিজের পৈশাচিক সত্ত্বার ক্ষুধা মেটাতে খুন করেছে, তাদেরকে ঘিরে থাকা ঘটনাগুলো সিরিজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মূলত, কুনানান ছিল হাসিখুশি চেহারার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক সাইকোপ্যাথ। নিজের অতীতের দুঃসহ কিছু স্মৃতি ও অন্ধকায়ময় কিছু অধ্যায় তাকে এমন বিকৃত ও শীতল প্রকৃতির ক্রমিক খুনি হতে বাধ্য করে।
‘সিরিয়াল কিলার’ বা ‘ক্রমিক খুনি’ নিয়ে বিশ্ব জুড়ে সিনেমা অথবা সিরিজের কোনো কমতি নেই। বাস্তব জীবনের ক্রমিক খুনিদের গল্প নিয়ে কম সিনেমা বানানো হয়নি। ‘জ্যাক দ্য রিপার’, ‘দ্য জোডিয়াক’, ‘দ্য মনস্টার’ ইত্যাদি সত্যিকারের ক্রমিক খুনির গল্প ও তাদের খুনের প্রক্রিয়া, খুন সংক্রান্ত ঘটনাবলী নিয়ে গড়ে ওঠা সিনেমাগুলো দর্শক সমাজে ভালোই সাড়া ফেলে থাকে৷ এক শ্রেণীর বিশেষ দর্শক তো আছেই, যাদের কাছে ক্রমিক খুনের উপর নির্মিত সিনেমা সবসময়ই আলাদা আবেদন পেয়ে থাকে। সিরিজের কথা বলতে হলে, কাল্পনিক সিরিয়াল কিলার ভিত্তিক সিরিজ ‘ডেক্সটার’, ও ‘হ্যানিবেল’ এর কথা সবার আগে আসাটাই যুক্তিসংগত। আর সত্যিকারের সিরিয়াল কিলারের কাহিনী নিয়ে গঠিত মাত্র এক সিজনের সিরিজ হিসেবে ‘আমেরিকান ক্রাইম স্টোরি’র সিজন টু যেকোনো দিক থেকে এককথায় চমৎকার। এ সিজনের প্রেক্ষাপট, চিত্রনাট্য, নিদের্শনা, অভিনয়শৈলী ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, সবই অনেকটা শৈল্পিকতার চাদরে মোড়া।
সিরিজের গল্পকে আরেকটু বিস্তারিত তুলে ধরার আগে সিরিজে অভিনীত চরিত্রগুলোর সাথে অল্পবিস্তর পরিচিত হয়ে আসা যাক।
প্রথমেই আসা যাক গিয়ানি চরিত্রটির কথায়। সিরিজে গিয়ানি চরিত্রের ব্যাপ্তিকাল যতটুকুই ছিল, তাতে তার সম্পর্কে বেশ স্বচ্ছ ধারণাই পাওয়া যায়। গিয়ানি ছিলেন স্নেহপরায়ণ, দায়িত্বশীল, কর্মঠ, বন্ধুসুলভ এক ব্যক্তিত্ব। তার কাছে তার পেশাজীবন যদি হয়ে থাকে বেঁচে থাকার একমাত্র প্রেরণা, তাহলে পারিবারিক জীবন ছিল বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। বোন ডলাটেলা তার চোখের মণি হয়ে থাকলে, প্রেমিক অ্যান্টোনিও ছিল চোখের রশ্মি। গিয়ানি তার আশেপাশের গুটিকয়েক মানুষজনকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে ছিলেন। ব্যবসা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবনের উত্থান-পতনে এরা ছিলেন তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। দুনিয়ার তামাম বিখ্যাত লোকের মতো তার গরিমা ছিল না। নাক উঁচু স্বভাব বিবর্জিত গিয়ানি বিলাসিতা পছন্দ করলেও তার মনটা ছিল একদম সাধারণ যেকোনো পুরুষের মতো। তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল, সৌন্দর্যের পূজারি ও ভালোবাসার সন্ধানকারী এক অকৃত্রিম মানব। এডগার রেমিরেজ গিয়ানি চরিত্রে তার সাবলীল অভিনয়ের জন্য ৭০তম এমিতে সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।
এরপর আসে গিয়ানির বোন ডলাটেলা ও পার্টনার অ্যান্টোনিওর কথা। ডলাটেলা চরিত্রে পেনেলোপ ক্রুজের মতো একইসাথে রূপে ও গুণে অতুলনীয়া অভিনেত্রী ছিলেন। ডলাটেলা চরিত্রে নিজেকে পর্দার সামনে এতটাই মানানসইভাবে তুলে ধরেছেন যে, এক মুহূর্তের জন্য দর্শক ভুলে যাবেন তিনি পেনেলোপ ক্রুজ। ডলাটেলাই যেন তার আসল পরিচয়। বাস্তবের গিয়ানির জীবনে বোনের প্রভাব ও স্থানের মাপকাঠি স্পষ্ট পরিদর্শিত হয়েছে। অ্যান্টোনিও চরিত্রটি সিরিজে কতটা ভূমিকা রেখেছে সেটা গিয়ানির জীবনধারা পর্যবেক্ষণ করলেই জানা যাবে। গিয়ানির জীবনে যেহেতু তার স্থান ছিল একদম উত্তমার্ধের মতো, সেহেতু গিয়ানির জীবনের গল্প শোনাতে হলে তাকে তো ফোকাস করতেই হবে। সাদামাটা স্বভাবের ও গিয়ানির প্রতি অগাধ প্রেমময় মানুষটির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রিকি মার্টিন। তিনি ও পেনেলোপ দুজনেই এমিতে পার্শ্ব অভিনেতা-অভিনেত্রীর পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পান।
এবার কুনানানের পালা। কুনানান চরিত্রে ড্যারেন ক্রিসের কোনো বিকল্প পাওয়া যেত নাকি সে ব্যাপারে বাগবিতণ্ডা না করে সেটা দর্শকদের উপর ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয়। আপনি কুনানানকে পছন্দ করেন, ঘৃণা করেন অথবা যা-ই করেন না কেন, ড্যারেনের অভিনয়ে যে বুঁদ না হয়ে পারবেন না, সেটার শতভাগ নিশ্চয়তা দেওয়া যেতে পারে। ডেক্সটার সিরিজটি দেখতে গিয়ে যেমন মাইকেল এইচ. হলের নিখুঁত অভিনয়ের ফলে অনেকে সিরিয়াল কিলারের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলেন, ড্যারেনের অভিনয়শৈলীর নিখুঁততায় ঠিক তেমনি কুনানান নামের জন্য সিরিয়াল কিলারের জন্য মনের ভেতর চরম বিতৃষ্ণা জন্ম নেবে। আর তাই তো, ৭০ তম এমির লিমিটেড সিরিজের সেরা অভিনেত্রার খেতাবটা ড্যারেনের ভাগ্যেই জুটে।
এছাড়া আরও বেশ কিছু চরিত্র ছিল যেগুলো কুনানানের অংশের কাহিনীটা তুলে ধরতে সিরিজে অপরিহার্য উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। তবে সেসব চরিত্রের আসল রূপ ও সিরিজের গল্পে তাদের চরিত্রের ঘটনাপ্রবাহ দর্শকদের স্বচক্ষে দেখে জেনে নেওয়ার আহবান রইল।
এবার সিরিজের প্রতিটি পর্ব নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়ে যাক।
প্রথম পর্ব- ‘দ্য ম্যান হু উড বি ভগ’: রায়ান মার্ফি পরিচালিত এই পর্বটিতে গিয়ানি হত্যাকান্ড, কুনানানের সাথে তার প্রথম পরিচয় ও গিয়ানির হত্যা পরবর্তী সময়কে দেখানো হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্ব- ‘ম্যানহান্ট’: এই পর্বে ১৯৯৪ সালে গিয়ানির এইডস ধরা পড়া, ১৯৯৭ সালে কুনানানের গিয়ানির হত্যার পরিকল্পনার চিত্র তুলে ধরা হয়। এর পরিচালক ছিলেন নেলসন ক্রেগ।
তৃতীয় পর্ব- ‘অ্যা র্যান্ডম কিলিং’: ১৯৯৭ সালের মে মাসে শিকাগোর রিয়েল এস্টেট ডেভলপার লি মিগলিন রহস্যজনকভাবে খুন হন। তার এই খুনের তদন্ত করতে গিয়ে আইন বিভাগের লোকজন কুনানানের পেছনে ধাওয়া করতে থাকে। মূলত কুনানানের পাঁচ শিকারের একজন ছিলেন তিনি। হোর্ডার-পেটন যৌথভাবে পর্বটি নির্মাণ করেন।
চতুর্থ পর্ব- ‘হাউজ বাই দ্য লেক’: ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে জেফ নামের একজন সাবেক মেরিন নিজের প্রাক্তনের সাথে দেখা করতে এসে কুনানানের হাতে খুন হয়। সমকামী জেফের প্রাক্তন ম্যাডিসনকে নিয়ে গা ঢাকা দিতে দেখা যাবে কুনানানকে। এ পর্বের শেষে দারুণ এক চমক অপেক্ষা করছে।
পঞ্চম পর্ব- ‘ডোন্ট আস্ক ডোন্ট টেল’: ১৯৯৫ সালের জুন মাসে ডলাটেলার বারণ উপেক্ষা করেই গিয়ানি নিজের সমকামিতার বিষয়টা গণমাধ্যমে তুলে ধরেন। এ পর্বে কুনানান ও জেফের পরিচয় কীভাবে ঘটেছিল, সেটিও দেখানো হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম পর্বের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ড্যানিয়েল মিনাহান।
ষষ্ঠ পর্ব- ‘ডিসেন্ট’: ১৯৯৬ সালে কুনানান ক্যালিফোর্নিয়ার একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সাথে থাকতো। সেই সময়ের কাহিনী এ পর্বে দেখানো হয়েছে।
সপ্তম পর্ব- ‘এসেন্ট’: ১৯৯২ সালের গিয়ানির জীবনের কিছু কাহিনী এ পর্বে ফুটিয়ে তোলা হয়। একইসাথে সেই পর্বে কুনানান ও ম্যাডিসনের ভেতরে গড়ে উঠতে থাকা সম্পর্কের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। এ দুই পর্বের পরিচালনা করেছেন হোর্ডার-পেটন।
অষ্টম পর্ব- ‘ক্রিয়েটর/ডেস্ট্রয়ার’: ম্যাট বমারের পরিচালিত এ পর্বে গিয়ানি ও কুনানানের শৈশব চিত্রায়িত হয়। বিশেষ করে, কুনানানের বর্তমান অবস্থার জন্য তার অতীত কী পরিমাণ দায়ী, তা দর্শক এ পর্বে জানতে পারবেন।
নবম পর্ব- ‘অ্যালোন’: এ পর্বে কুনানানের শেষ পরিণতির চিত্র অংকন করা হয়েছে। সিজনের শেষ এই পর্ব দর্শকদের খানিকটা হতাশায় হয়তো ফেলে দেবে। কিন্তু সর্বোপরি, দারুণ সমাপ্তি।
৭০তম এমিতে মোট তেরোটি ক্যাটাগরিতে মনোনয়নসহ, আটটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে সিরিজটি। দর্শক ও সমালোচক সমাজে বেশ সাড়া জাগালেও, বাস্তব জীবনের গিয়ানি ভার্সাসের পরিবার প্রথমদিকে সিরিজটি ভালোই সমালোচনার তোপে ফেলে। তবে পরে ৭৫তম গোল্ডেন গ্লোবের আসরে সিরিজটি ডাক পেলে, পেনেলোপ ক্রুজকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন বাস্তবের ডলাটেলা ভার্সাসে। পুরো সিরিজের চিত্রনাট্য লিখেছেন টম রব স্মিথ। তবে, অষ্টম পর্বে তাকে সহযোগিতা করেছেন ম্যাগি কন। সিরিজটি প্রায় দুই মাসব্যাপী ফক্সে সম্প্রচারের পর মার্সের ২১ তারিখ ইতি টানে। সিরিজের শুটিং শুরু হয় গত বছরের মে মাসে ও শেষ হয় নভেম্বরের দিকে৷ শুটিং স্পট হিসেবে মায়ামিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। রটেন টমেটোসে ৯০টি ভোটের ভিত্তিতে ৮৮% ও মেটাক্রিটিকে ৩৫টি ভোটের ভিত্তিতে ৭৪% রেটিং লাভ করতে সমর্থ হয়েছে সিরিজটি।
ফিচার ইমেজ – TV Series Finale