দক্ষিণ স্পেনের উপকূলীয় উপত্যকা আল বাশারাত। তিনদিক থেকে প্রাকৃতিক প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজের ঢেউ খেলানো আল বাশারাত পর্বতশ্রেণী। সবুজের চাদর বিছানো শালির পর্বতের পাদদেশে কয়েকটি মুসলিম গোত্র স্বাধীনভাবে বসবাস করছিল। ততদিনে স্পেনে মুসলমানদের চূড়ান্ত পরাজয় হয়ে গেছে। গ্রানাডার পতন হয়েছে অনেক আগেই। আন্দালুসিয়ার আলহামরার চাবি এখন স্পেনের সম্রাট চার্লসের হাতে।
স্পেনে মুসলমানদের গৌরবান্বিত দিনগুলো এখন শুধুই অতীত। গ্রানাডার পতনের কয়েক দশকের মধ্যেই সমগ্র স্পেনে মুসলমানদের উপর নেমে আসে নির্যাতনের ভয়াল থাবা। ইনকুইজিশন আদালতের মাধ্যমে মুসলমানদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়। কিছু মুসলমান পালিয়ে আশ্রয় নেয় আফ্রিকায়। সর্বত্রই যখন মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছিল, তখনও আল বাশারাতে মুসলমানরা স্বাধীনভাবেই বসবাস করত।
চাপে পড়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও ভেতরে ভেতরে তারা ছিল কট্টর মুসলিম। এদের মধ্যে আবার অনেক খ্রিস্টান পাদ্রিও ছিল। মূলত তারা পাদ্রির বেশ ধরে মুসলমানদের হয়ে কাজ করত। আল বাশারাতে ফারদিশ নদীর তীর ঘেঁষে ঠিক এমনই একটি রাহিব পল্লী ছিল। এই রাহিবরাই মূলত আল বাশারাতের মুসলিম গোত্রগুলোকে স্বাধীনভাবে টিকিয়ে রেখেছিল।
সমগ্র বইয়ে সমুদ্র ঈগল খাইরুদ্দিন বারবারুসার গৌরবময় বিজয়াভিযান বর্ণিত হলেও কাহিনির পটভূমি বাশারাত। প্রচলিত ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাসের বাইরে গিয়ে লেখক আসলাম রাহি এ বইয়ে প্রাণচঞ্চল এবং জীবন্ত এক কাহিনি তুলে এনেছেন।
সেসময় অটোমান শাসক ছিলেন সুলতান সুলায়মান। তিনি খাইরুদ্দিন বারবারুসাকে ‘পাশা’ এবং ‘আমিরুল বাহার’ খেতাবে ভূষিত করেন। অটোমান সুলতান দুর্ধর্ষ এই নৌ-সেনাপতিকে অর্থ, সৈন্য এবং নৌবহর দিয়ে সমুদ্রের বুকে ইউরোপের জন্য ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছিলেন।
সমগ্র উপন্যাসটি তিনটি প্রেক্ষাপট নিয়ে এগিয়ে গেছে। প্রথমত, আল বাশারাতে খ্রিস্টানদের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে মাটি কামড়ে মুসলমানদের বসবাস। পাদ্রী বেশি মুসলিমদের কার্যক্রম বর্ণিত হয়েছে এই অংশে। দ্বিতীয়ত, উত্তাল তরঙ্গমালায় একের পর এক বিধ্বংসী অভিযানে খাইরুদ্দিন বারবারুসার সামুদ্রিক তৎপরতা বর্ণিত হয়েছে। তৃতীয়ত, সুলতান সুলায়মানের স্থলপথে ইউরোপ আক্রমণ এবং ইউরোপীয়দের করুণ পরিণতি। প্রত্যেকটি প্রেক্ষাপট ছিল একটা অন্যটার সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আর এভাবেই এগিয়ে গেছে উপন্যাসের কাহিনী।
খাইরুদ্দিন বারবারুসার ডানহাত ছিলেন হাসান ক্রুসু। তরুণ হাসান ক্রুসু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আল বাশারাতের মুসলিম গোত্রীয় প্রধান কাব বিন আমিরের কন্যার সাথে। কিন্তু এই সম্পর্ক সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়, কেননা স্পেন সরকার যদি জানতে পারে যে খাইরুদ্দিন বারবারুসার সঙ্গে মুসলিম বসতিগুলোর সম্পর্ক আছে, তাহলে মুসলিমদের উপর নেমে আসবে অকথ্য নির্যাতন। বাশারাতের ঘটনায় ফুটে উঠেছে তৎকালীন স্পেনের মুসলমানদের করুণ অবস্থা।
এদিকে খাইরুদ্দিন বারবারুসা ছিলেন সমুদ্রের ত্রাস। বিশাল সাগরের উত্তাল তরঙ্গ আর উর্মিমালা তার নিত্যসঙ্গী। স্থলে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তার একমাত্র ঠিকানা সমুদ্র। তার একার তৎপরতায় ইউরোপীয় কোনো বাহিনী সাগরে নামতে পারত না। সমগ্র ইউরোপীয় শক্তি তাকে যমদূতের মতো ভয় পেত। ইউরোপের কোনো বাণিজ্যিক জাহাজ, এমনকি সাধারণ মাঝিরাও সমুদ্রের নৌকা নামাতে ভয় পেত।
তৎকালীন নয়া দুনিয়া (নতুন আবিষ্কৃত আমেরিকা) থেকে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ লুটে নিয়ে আসা স্প্যানিশ নৌবহরকে ঘোলাপানি খাওয়ানো ছিল বারবারুসার দৈনন্দিন কাজ। চোখের পলকে ঝটিকা আক্রমণে ইউরোপীয় জাহাজগুলোতে মৃত্যুর বিভীষিকা নামিয়ে আনতেন বারবারুসা। যুদ্ধলব্ধ সমস্ত মালামাল ও রসদ নিয়ে পৌঁছে দিতেন উসমানীয় সুলতানের পদতলে। ব্রিটিশ, স্প্যানিশ কিংবা ফ্রান্সের কোনো রসদবাহী জাহাজই রক্ষা পেত না বারবারুসার বিধ্বংসী আক্রমণ থেকে।
বারবারুসা যে শুধু লুটপাট করেছেন এমনটা নয়। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া এবং মরক্কোর বিশাল এক অঞ্চল স্প্যানিশদের কাছ থেকে তিনি দখল করে নেন। এছাড়া সমুদ্রে অসংখ্য বিধ্বংসী আক্রমণ চালিয়ে শ্মশানে পরিণত করে ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেন অধ্যুষিত দ্বীপসমূহ নিয়ে আসেন উসমানীয় পতাকা তলে। এভাবে একের পর এক বারবারুসার আক্রমণে ইউরোপীয় শক্তি ক্রমশ শঙ্কিত হয়ে উঠল। যেকোনো উপায়ে তাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য স্পেনের সম্রাট চার্লস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন।
স্পেন, জার্মানি, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি এবং ভেনিসের সমগ্র নৌশক্তিকে একত্রিত করে সম্মিলিত বাহিনী গঠন করলেন সম্রাট চার্লস। বিশাল এ বাহিনীর নেতৃত্ব তুলে দিলেন ইউরোপের বিখ্যাত অ্যাডমিরাল আন্দ্রে ডুরিয়ার হাতে। কিন্তু সমুদ্রে নামার কয়েকদিনের মধ্যেই বারবারুসার বিধ্বংসী আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ওঠে তারা। একপর্যায়ে বারবারুসার ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে অর্ধেক জাহাজ হারিয়ে আন্দ্রে ডুরিয়া ধরনা দেন সম্রাট চার্লের কাছে।
এই যুদ্ধে বারবারুসা স্পেনের এ বিশাল বাহিনীর সলিলসমাধি রচনা করেন। পাশাপাশি ইতালি ও ভেনিসের অসংখ্য উপকূলীয় শহরে আক্রমণের তুফান শানিয়ে দেন তিনি। বিপুল পরিমাণে সম্পদ পৌঁছে দেন সুলতান সুলায়মানের কাছে। ঐতিহাসিক তথ্যমতে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ছিল তৎকালীন চার লক্ষ স্বর্ণমুদ্রার চেয়েও বেশি।
এরপরও বারবারুসার বিজয় অভিযান অব্যাহত থাকে। সুলায়মান যেমন স্থলভাগে ইউরোপের ৮০০ মাইল ভেতরে ঢুকে ভেঙে দিয়েছিলেন তাদের শক্তির মেরুদন্ড, তেমনি সাগরে একক অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিলেন খাইরুদ্দিন বারবারুসা। সুলতান যেমন হাঙ্গেরির রণক্ষেত্রে পর্যুদস্ত করেছিলেন ইউরোপের সাত-সাতটি দেশের যৌথবাহিনীর সম্মিলিত শক্তির মেরুদণ্ড, তেমনি বারবারুসা প্রিভিজার নিকটবর্তী কিরতা উপসাগরে মাত্র ১২০টি যুদ্ধজাহাজের বহর নিয়ে, সুলতানের কোনোপ্রকার সাহায্য ব্যতিরেকে, এককভাবে সাগরে সমাধি ঘটান ইউরোপের ইতিহাসের চার শতাধিক যুদ্ধজাহাজের বৃহত্তম নৌবহরের।
বারবারুসার হাতে পর্যুদস্ত হয়ে পালিয়ে যান স্পেনের অধিপতি সম্রাট চার্লস। যে পরাজয়ের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে, সমগ্র নৌবহর হারিয়ে মারা যান ভেনিসের রাজা দুজে। রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন চার্লস। সাগরে এককভাবে কর্তৃত্ব এসে গিয়েছিল বারবারুসার। সাগরে তার আর কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না।
বারবারুসাকে নিয়ে অজানা আতঙ্ক এবং কল্পিত লোককথা ইউরোপের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। ইউরোপের কোনো জাহাজ সাগরে নামত না ভয়ে। জোর করেও মাঝি-মাল্লাদের সাগরে নামানো যেত না। অবস্থা এতটা ভয়াবহ হয়ে গিয়েছিল যে, মায়েরা শিশুদের তার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াত। গুজব রটে গেল যে, বারবারুসার আধ্যাত্মিক কোনো ক্ষমতা আছে, সে সাধারণ মানুষ নয়!
উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটেছে শত ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবেলা করে হাসান ক্রুসু এবং কাব বিন আমিরের কন্যার মিলনের মাধ্যমে। এদিকে বারবারুসা তখন অবস্থান করছিলেন কনস্ট্যান্টিনোপলে। কিছুদিন পরই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পৃথিবীর ইতিহাসে বিস্ময়কর এই নৌ সেনাপতিকে দাফন করা হয় বসফরাসের পাড়ে। দীর্ঘ কয়েক শতক পরেও কোনো যুদ্ধজাহাজে যখন তার কবরের সামনে দিয়ে যেত, তখন আকাশের দিকে ফাঁকা কামানের গোলা ছুড়ে সম্মান প্রদর্শন করত।
ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ার সুবিধা হলো- একদিকে যেমন উপন্যাসের চমৎকার রসায়ন পাঠের সুখ অনুভব করা যায়, অন্যদিকে তৎকালীন বিস্তৃত ইতিহাসের অলিগলি দিয়েও ঘুরে আসা যায়। অনুবাদগ্রন্থ হলেও বইয়ের বর্ণনাভঙ্গি অত্যান্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জল। পড়তে গিয়ে কোথাও আটকে যেতে হয়নি।
উপন্যাসে উঠে এসেছে অসংখ্য শিহরণ জাগানিয়া উসমানীয় বিজয়াভিযান। পরতে পরতে উত্তেজনা আর রোমান্টিকতায় ভরপুর এ এক অনবদ্য রচনা। লেখক আসলাম রাহি পাকিস্তানের একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ। আর বইটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন আবদুর রশীদ তারাপাশী।
বইটি সংগ্রহ করতে
বই: খাইরুদ্দীন বারবারুসা (সমুদ্র ঈগল)
লেখক: আসলাম রাহি
অনুবাদ: আবদুর রশীদ তারাপাশী
প্রকাশনা সংস্থা: কালান্তর
প্রথম প্রকাশ: জুলাই ২০১৭
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৪২৪
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা