নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন ব্রিটিশ সিনেমায় ‘ফোর ওয়েডিংস অ্যান্ড আ ফিউনারেল’ ধরনের মুভির জয়জয়কার চলছিল, তখন ড্যানি বয়েলের ‘ট্রেইনস্পটিং’ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের মনে স্বস্তির সুবাতাস বয়ে আনে। কারণ এটি কোনো রোমান্টিক কমেডি বা কস্টিউম ড্রামা ছিল না। বয়েল তার সিনেমা ভরিয়ে দিয়েছিলেন দৌড়ঝাঁপ, মারামারি, গালাগালি আর ভুরি ভুরি ব্রিটপপ গানে। কোথাও কোনো সামাজিক বার্তার ইয়ত্তাও ছিল না। আর যেহেতু এখানকার চরিত্ররা ছিল স্কটল্যান্ডের লিথ শহরের ‘স্ক্যাগবয়’; সেহেতু এদের হেরোইন আসক্তি নিয়ে হিমশিম খাওয়ার ব্যাপারটি নিয়েও কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। উল্লেখ্য, হেরোইনের স্ল্যাং টার্ম হিসেবে ‘স্ক্যাগ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বরং আলোচিত হয়েছে এখানকার চরিত্রদের বিড়বিড় করে বলা কথা, পাগলের মতো সর্বশক্তিতে ধ্বংসের পথে ধাবিত হওয়া এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবাধ্যতা।
ফিল্থের ব্যাপারে লিখতে গিয়ে বয়েল আর তার ‘ট্রেইনস্পটিং’কে কেন টানছি? কারণ স্কটিশ লেখক আরভিন ওয়েলশের উত্তেজক উপন্যাসসমূহকে সিনেমায় রূপান্তরিত করার যে প্রবণতা আমরা বর্তমানে দেখি, তার চল শুরু হয়েছিলো বয়েলের হাত ধরেই। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ওয়েলশের একই নামের প্রথম উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা ‘ট্রেইনস্পটিং’-এর সাফল্য আর রেন্টন চরিত্রে ইউয়ান ম্যাকগ্রেগরের অনবদ্য অভিনয়ের ফলেই অন্যান্য পরিচালকরা ওয়েলশের উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা বানাতে ব্রতী হয়েছেন। ওয়েলশ ‘ট্রেইনস্পটিং’-এর সিক্যুয়েল ‘পর্নো’ প্রকাশ করেছেন ২০০২ সালে। ২০১৭ সালে এটি অবলম্বনে ‘টিটু ট্রেইনস্পটিং’ও বানিয়ে ফেলেছেন বয়েল।
যা-ই হোক, এবার আজকের আলোচ্য সিনেমা- ‘ফিল্থ’-এর দিকে ফেরা যাক। এর চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনায় ছিলেন জন এস বেয়ার্ড। তার আগের দু’টি ফিচার ফিল্ম ছিলো ‘গ্রিন স্ট্রিট হুলিগানস’ এবং ‘ক্যাস’। ‘ট্রেইনস্পটিং’-এর মতো নতুনত্ব বা উদ্ভাবনী কিছু না করলেও এটির সাথে ঐ সিনেমার বিষয়বস্তুগত দিক থেকে অনেকটা মিল খুঁজে পাবেন দর্শক। এটাও মনুষ্য চরিত্রকে পাখির চোখে অবলোকন করে। নব্বই দশকের প্রেক্ষাপটে স্থাপিত এই ক্রাইম-ড্রামা বা কমেডি ফিল্ম নোংরা, অশ্লীল এবং বিদ্বেষপূর্ণ; কিন্তু ঠিক এখানেই এই সিনেমার সার্থকতা। এ ধরনের বিদঘুটে একটি প্রজেক্টের জন্য অর্থের যোগান পেতে প্রযোজকদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সকল সমস্যা কাটিয়ে মুভিটি যখন প্রেক্ষাগৃহে এলো, তখন জেমস ম্যাকঅ্যাভয়ের অসাধারণ অভিনয়ে দর্শক এমন একটি ধাক্কা খেল, যেটির জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না।
‘ফিল্থ’ আমাদেরকে এমন একটি প্রধান চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, যাকে পছন্দ করা বা তার প্রতি সহানুভূতি অনুভব করা এককথায় দুঃসাধ্য। এই চরিত্রের নাম ব্রুস রবার্টসন (জেমস ম্যাকঅ্যাভয়); যিনি পেশায় একজন ডিটেকটিভ সার্জেন্ট। ‘ফিল্থ’ শব্দের অর্থ ময়লা বা কলুষতা, আর সিনেমার নামে যে কলুষতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে; দুর্নীতিগ্রস্ত রবার্টসনের চরিত্রে তার সর্বব্যাপীতা পরিলক্ষিত হয়৷ আইনের লোক হিসেবে সমাজে আইন-শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখার ব্যাপারটি তার কাছে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু এটি নিয়ে তাকে তেমন একটা মাথা ঘামাতে দেখা যায় না। উল্টো তিনি হৃদয় গভীরে লালন করেন স্বজাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা।
এই ঘৃণার স্বরূপ আমরা দেখতে পাই তার চলন-বলন আর আচার-আচরণে। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ম্যানিপুলেশনেও তিনি অদ্বিতীয়। মোদ্দাকথা হলো ইংরেজিতে ‘অক্সিমোরন’ বলে যে বিশেষণটি রয়েছে, তার যোগ্য দাবিদার আমাদের এই রবার্টসন। কিন্তু, কিছুদিনের জন্য তাকে সহজাত প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরতে হবে। কারণ কর্মক্ষেত্রে একটি উচ্চপদ খালি হয়েছে। আর তার মতে, এ পদের জন্য তার চেয়ে ‘যোগ্য’ কেউ নেই। তাই এমনিতে সহকর্মীদের সবসময় বিপদে ফেলার ছক আঁকলেও আমরা তাকে তাদের সাথে মানিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিতে দেখি।
পদোন্নতি পাওয়ার ব্যাপারটি অনেকাংশে নির্ভর করছে একটি হত্যা রহস্যের মীমাংসার উপর। জাতিগত বিদ্বেষের কারণে কিছুদিন আগে স্কটল্যান্ডে পড়তে আসা এক জাপানি শিক্ষার্থীকে খুন করা হয়েছে। এখন যদি নিজেকে উচ্চপদে আসীন করতে হয়, তাহলে রবার্টসনকে অবশ্যই এ রহস্যের কিনারা করতে হবে। পাশাপাশি তিনি সহকর্মীদের প্রতি সহমর্মী, এ ধরনের একটি ইমেজ তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ববের (জন সেশনস) সাথেও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
রবার্টসনের পক্ষে সহকর্মীদের সাথে ভালো মানুষের অভিনয় করা এমনিতেই কষ্টকর, ঝামেলা আরো বাড়িয়ে দিতে প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হন আমান্ডা ড্রামন্ড (ইমোজেন পুটস)। আমান্ডা পুলিশে যোগ দিয়েছেন, খুব বেশিদিন হয়নি। এর মাঝেই তিনি উচ্চপদে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন এবং তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলে জায়গা করে নিয়েছেন। এটি রবার্টসনের পছন্দ হয় না। তার মতে, এ দলে জায়গা পাওয়ার মত কিছুই করেননি আমান্ডা, কেবল নারী হওয়ার বদৌলতেই তিনি এ দলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
চিরাচরিত ওয়েলশীয় স্টাইলে ‘ফিল্থ’ মানব চরিত্রের সবচেয়ে অন্ধকার দিকগুলোকে তুলে ধরে। এটি আমাদেরকে এমন কিছু ব্যাপারের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, যেগুলো নিয়ে আমরা কথা বলি না বা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। রবার্টসনের চরিত্রের খারাপ দিকের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এই সিনেমা দেখতে বসলে আসলে দর্শক বুঝতে পারবেন, একজন মানুষ কতটা খারাপ হতে পারেন। ম্যানিপুলেশন, ঘৃণা, মাদকাসক্তি তো আছেই, নৈতিক চরিত্রের দিক থেকেও চরমভাবে অধঃপতিত ব্রুস রবার্টসন। সারাদিন ওপেন ম্যারেজের সুফল বর্ণনা করে অবসর সময়ে বিকৃত সব যৌনাচারে লিপ্ত হন তিনি।
রবার্টসনের যে মানব বিদ্বেষ, তার দৃশ্যায়নের ফাঁকে ফাঁকে সুচারুভাবে কমেডিক মোমেন্টের ব্যবহার করেছেন বেয়ার্ড। তাই সিনেমায় সর্বগ্রাসী ঘৃণার যে ভাব, তার বাইরেও বেশ কিছু ব্যাপারে উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারবেন উৎসুক দর্শক। কারো কারো মতে, গল্প বলার মুন্সিয়ানায় মূল উপন্যাসকেও ছাড়িয়ে গেছে ‘ফিল্থ’। একটি দৃশ্যের কথা উল্লেখ করা যায় এক্ষেত্রে। রবার্টসন হেঁটে যাচ্ছেন এডিনবার্গের রাস্তা ধরে। চারপাশের মানুষজনকে কোনো রাখঢাক না রেখেই মনে মনে বিচার করে চলেছেন তিনি, যা ফোর্থ ওয়াল ব্রেকিংয়ের ফলে শুনতে পাচ্ছে দর্শক। একসময় তিনি গর্বভরে বলে ওঠেন, “স্কটল্যান্ড, আমাদের মতো জাতি কি আর আছে!”
তিনি যখন একথা বলেন, ঠিক তখনই বেয়ার্ড কাট করে দেখান এক স্থূলকায়, অধোগামী পরিবারকে। যারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে টেইকওয়ের ফাস্টফুড গপাগপ গিলে চলেছে। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে এই সিনেমায় সমাজের প্রতি এ ধরনের বেশ কিছু সূক্ষ্ম খোঁচার দেখা পাবেন দর্শকরা।
সিনেমার কাস্টিং বেশ ভালো। রবার্টসনের সার্বক্ষণিক সহচর রে লেনক্স চরিত্রে অভিনয় করেছেন জেমি বেল। এ ধরনের চরিত্রে তাকে আগে দেখা যায়নি এবং এখানে তার পারফর্ম্যান্স দুর্দান্ত ছিল। নোংরা অভ্যাসের দিক থেকে তিনিও কম যান না। ব্রুসের বন্ধু এবং ম্যাসনিক লজের সভ্য ক্লিফোর্ড ব্লেডস চরিত্রে দেখা গেছে এডি মারসানকে। ব্লেডসকে ম্যানিপুলেট করার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করেন না রবার্টসন, তার স্ত্রীকেও কামনা করেন এবং বন্ধুর স্ত্রীর কাছে ফোন করে অশ্লীল কথাবার্তা বলেন। তথাপি ব্লেডস সবসময় তাকে সন্তুষ্ট করতে চান, চশমার ভেতর থেকে টলমল চোখে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। অভিনেতা হিসেবে এই চরিত্রের যেসকল চাহিদা ছিল, তার সবগুলোই পূরণ করেছেন এডি।
তারপরও জেমস ম্যাকঅ্যাভয়ের রবার্টসনই ‘ফিল্থ’-এর মূল চালিকাশক্তি। জাঙ্কি, মাস্টার ম্যানিপুলেটর হিসেবে এখন পর্যন্ত নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তিনি। নিজের অভিনয় দক্ষতার প্রমাণস্বরূপ এমন অপছন্দনীয় এবং জটিল একটি চরিত্রেও তিনি ক্যারিশমা বা ব্যাড বয় চার্ম নিয়ে এসেছেন।
শেষের দিকে গিয়ে আমরা বুঝতে পারি, রবার্টসনকে আমরা যতটা খারাপ ভেবেছিলাম, তিনি আসলে ততটা খারাপ নন। বেয়ার্ডের নিখুঁত চিত্রনাট্য তাকেও কিছু মানবিক গুণাবলি প্রদান করেছে। সময়ে সময়ে বা কোণঠাসা হয়ে গেলে তিনিও কিছু ভালো কাজ করেন। যেমন- হার্ট অ্যাটাক করা এক লোককে বাঁচাতে তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করেন। পরে ঐ লোকের পরিবারের সাথেও সদয় আচরণ করতে দেখা যায় তাকে।
‘ফিল্থ’-এ ভালো স্ক্রিপ্টের পাশাপাশি বেয়ার্ডের তুরুপের তাস ছিল প্লট ডিভাইসের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার। সিনেমায় কিছুক্ষণ পরপর দেখা গেছে অদ্ভূতুড়ে হ্যালুসিনেশনের দৃশ্যায়ন৷ এই হ্যালুসিনেশন ট্রিগার করে দুটি চরিত্র। একটি হলো রবার্টসনের স্ত্রী ক্যারল (শওনা ম্যাকডোনাল্ড) এবং অন্যটি হলো তার সাইকিয়াট্রিস্ট (জিম ব্রডবেন্ট)। এই দুটি চরিত্রের আগমণে ক্ষণে ক্ষণে সিনেমার ন্যারেটিভ স্টাইলের গতি কমে যায়। প্রথমদিকে এই চরিত্রদ্বয় এবং হ্যালুসিনেশনের দৃশ্যগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। কিন্তু যত সময় এগোয় এবং আমরা ব্রুসের অতল মনের গভীরে প্রবেশ করি, ততই এই দৃশ্যাবলী এবং চরিত্রসমূহের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই।
এ সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ক্লিন্ট ম্যানসেল, যা পুরো মুভি জুড়ে দর্শকের দেখার অনুভূতিকে বর্ধিত করেছে বহুগুণ। এক্ষেত্রে ম্যানসেলের সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্ত সম্ভবত রেডিওহেডের ‘ক্রিপ’ গানের কাভার সংযুক্ত করা। যেটি পওলিনা সামারের সাথে গেয়েছেন তিনি নিজে। ব্যাকগ্রাউন্ডে গানটি বাজছে, এমন একটি দৃশ্যে রবার্টসন ফোর্থ ওয়াল ভেঙে দর্শকের চোখে চোখ রেখে বলে ওঠেন তার ক্যাচফ্রেইজ,
“সেইম রুলস অ্যাপ্লাই, মাই সুইট সুইট ফ্রেন্ড।”
গান আর ক্যাচফ্রেইজের সাথে এখানে ম্যাকঅ্যাভয়ের হৃদয়মথিত অভিব্যক্তি এই দৃশ্যটিকে করেছে অনিন্দ্য। তার মুখে যেন ফুটে উঠেছে রবার্টসনের সমস্ত কষ্টের চিহ্ন, যার রেশ দর্শকের সাথে থেকে যাবে বহুদিন।
দৃশ্যায়নের দিক থেকে অনেকটা খেয়ালী হলেও, ‘ফিল্থ’ অনেক মানুষের দুর্বিষহ জীবন এবং সংগ্রামের সত্যিকারের চিত্র তুলে ধরে। এই সংগ্রাম মানসিক সমস্যা এবং বিভিন্ন আসক্তির সাথে লড়ে টিকে থাকার সংগ্রাম। হয়তো বেয়ার্ড এসব সমস্যা এবং তার মূল চরিত্রকে বিদ্রূপাত্মক বা অনান্তরিকভাবে দেখিয়েছেন, কিন্তু সিনেমাশেষে রবার্টসনের সমস্যার তীব্রতা বেশ ভালোভাবে অনুভব করতে পারবেন দর্শক। তাই তার অভব্য, অসভ্য, লঘুচিত্ত স্বগতোক্তির সাথে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগলেও দর্শকের সময়ের কোনো অপচয় হবে না।
চরিত্রটির সাথে উন্মত্ততার কিনারা থেকে ঘুরে এলে দর্শকরা অনুভূতি এবং মানসিক দিক থেকে হয়তো একটু ক্লান্ত বোধ করবেন। হয়তো তারা মানসিক রোগ বা সমস্যার স্বরূপ অনুধাবন করতে পারবেন এবং যারা এসব সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি সহৃদয়তা দেখাবেন। তাই যদি ডার্ক কমেডিক ব্যাপার-স্যাপার পছন্দ হয় এবং প্রাপ্তবয়স্ক হন, তাহলে দেখতে পারেন ‘ফিল্থ’ আর আর ঘুরে আসতে পারেন ওয়েলশের কল্পনার কদর্য ডিটেকটিভ সার্জেন্টের কালো দুনিয়া থেকে।