সায়কার সাথে মাহবুবের ঘুমাতে চাওয়ার একটা ‘কারণ’ আছে। না, সে ‘কারণে’ কোনো গোপন অভিসন্ধি নেই। কোনো গোপন কাম-ইচ্ছা নেই। সেই কারণে লুকিয়ে আছে শুধুই প্রশান্তিময় ঘুম!
মাহবুব, পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী একজন ভদ্রলোক। ইউনিক ট্রেডার্স কোম্পানির সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার। তুরস্ক থেকে সকল রকমের প্রসাধন সামগ্রী আমদানি করে তাদের এই কোম্পানি। কিন্তু সেসকল বাহারি প্রসাধন সামগ্রীর মাতোয়ারা সুঘ্রাণ কিছুতেই দূর করতে পারে না ক্লান্তির ভারে ন্যুব্জ মাহবুবের ঘর্মাক্ত দেহের ভেতরে হাসফাঁস করতে থাকা আরো ঘর্মাক্ত, ক্লেদিত আত্মার অস্বস্তির গন্ধ। অস্তিত্বের স্বাদ ভুলতে বসা ওই দেহ কাজ শেষে যখন প্রতিদিন টেনে টেনে মালিবাগের দক্ষিণ অংশের ওই জীর্ণ দোতলা বাড়িটায় নিয়ে যায় মাহবুব, গ্লানিতে শরীর ভেঙে আসে তখন তার।
বসার ঘরের খুপরিটায় অমনোযোগী ভঙ্গীতে টেলিভিশন দেখা, বারান্দায় মড়মড়ে শব্দ তোলা কাঠের চেয়ারে বসে সিগারেটের ধোঁয়ায় একঘেয়েমি উড়িয়ে দিতে চায় মাহবুব। কিন্তু ব্যর্থ হয় বার বার। নৈঃশব্দ্যের মাঝেই মায়ের সাথে দুই-এক কথা চালাচালি। আর ডাটা অন করে ফেসবুকে উদ্দেশ্যহীন ব্রাউজিং, এ নিয়েই চলছিল মাহবুবের জীবন। ওই রাতে ফকিরাপুল এস.এন. ট্রাভেলের রিসেপশনিস্ট সায়কা ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠানোর আগ অব্দি।
সায়কার সাথে সেদিন দুপুরেই পরিচয়। কাঠফাটা গরমে একফোঁটা জলের চাইতেও মধুর কন্ঠে সায়কা তাকে পানীয় খেতে অনুরোধ করেছিল। ফেলতে পারেনি। মাহবুবের অস্তিত্বহীন, গ্লানিময় রাতগুলো আর জীবনটা, উভয়েই একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছিল সেদিন।
সায়কার সাথে দিন বাড়ার সাথে সাথে সখ্যতা বাড়তে থাকে মাহবুবের। দুজনে দুজনার অতীতের তিক্ততা বিনিময় করে একান্ত আলাপনে। মাহবুবের প্রাক্তন স্ত্রী যাবার আগে সম্পূর্ণ বিষিয়ে দিয়ে গিয়েছে জীবনটা। অন্যদিকে, সায়কা বিনিময় করে পুরুষশাসিত এই সমাজে একজন নারী হবার যন্ত্রণাময়, ক্রোধে অন্ধ হয়ে যাবার জ্বালা। তারা দুজনেই ভোগে মারাত্মক ইনসোমনিয়ায়। গাদা গাদা ওষুধেও লাভ হয় না। কিন্তু সায়কা আর মাহবুব যখনই একে অপরের কাছে আসে, তখনই তাদের শরীর ভেঙে ঘুম আসে! তারা রমনা পার্কের গাছের ছায়ায় কথা বলতে বলতে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চায়। সম্ভব হয় না। তারা বুঝতে পারে- একসাথে থাকা ছাড়া তাদের ঘুম আসবে না। কিন্তু সমাজ তো তা মানবে না। কী করবে তারা!
ফন্দি আঁটে তারা; তারা কক্সবাজার যাবে পাশাপাশি শুয়ে শুধুই ঘুমাতে! তারা যায়ও। সকাল-সন্ধ্যা শুধুই প্রশান্তিময় চিত্তে ঘুমায় তারা। গভীর ঘুম। কিন্তু নির্ঘুম, কোলাহলে ক্লিষ্ট শহরে যে তাদের আবার ফিরতে হবে। আদৌ ফিরবে তারা?
‘ঘুমতৃষ্ণা’ গল্পগ্রন্থের নামকাহিনি এটি। এই গল্প ঘুমহীন, অস্থিরচিত্ত, ক্লান্ত এক শহরের দুটো মানুষের গল্প বলে। শরীর এখানে আছে, কিন্তু প্রয়োজনীয়ভাবে সেটা শরীরের গল্প হয়ে যায়নি। বরং তারও উর্ধ্বে উঠে মনোসংযোগ দেখেছে। শান্তি দেখেছে। ও যে শান্তিরই ঘুম! আপাতদৃষ্টিতে নারী-পুরুষের যে সাধারণ জৈবিক রসায়ন, সেই রসায়নে থাকা নানা জটিলতাকে ভিন্ন এক কোণ থেকে বয়ান করেছে এই গল্প। আর এই জটিল রসায়নে মিশে থাকা মানব-মানবীর নানা বিচিত্র মনস্তত্ত্বের উপরই আলো ফেলেছে গল্পটি।
‘ঘুমতৃষ্ণা’ গল্পগ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প ‘মাছরাঙা’। “আমার বাল্যবন্ধু নাহরিন রেদওয়ানি মাছরাঙা হতে চেয়েছিল“- গল্পের প্রথম বাক্যটিই পাঠকের মনোযোগ কেড়ে নেয়। এবং সেই আকর্ষণ অমোঘ হয়ে থাকে শেষ অব্দি। নাহরিনের এই মাছরাঙা হতে চাওয়ার পেছনে গ্রীক পুরাণের এক মর্মস্পর্শী গল্প জড়িয়ে আছে।
এজিয়ান সাগরে রাজা সিক্সের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর স্ত্রী আলচিওনি শোকে ঝাঁপ দেয় সেই সাগরে। মরে গিয়ে প্রিয়কে পাবার বাসনায়। এই ঘটনায় দেবতাদের মনে অপরাধবোধ জাগে। আর সেটা মোচনের বাসনা থেকেই তারা আলচিওনিকে রূপান্তর করেন মাছরাঙায়, এবং মৃতদের ভূমি থেকে সিক্সকে পুনরুত্থিত করে তাকেও রূপান্তর করেন মাছরাঙায়! পুরাণের সেই গল্প ভীষণ আশা জাগায় নাহরিনের মনে। সে-ও যে তার প্রিয়কে হারিয়েছে! তাই পুরাণের আলচিওনির মতো নাহরিনও হতে চায় মাছরাঙা, ফিরে পেতে চায় প্রিয়কে!
একইসাথে মনোহর বয়ান আর বিষাদে ভারী এই গল্প। পুরাণের সাথে অতীত সময়, তার সাথে মুক্তিযুদ্ধ, ব্যক্তিগত বেদনা, বন্ধুত্ব, স্মৃতিচারণ; অনেক কিছু জড়ো করে এগোয় এই গল্প। কিন্তু কী সাবলীল, সুন্দর এবং একইসাথে জটিলতা বয়ানে ধরে এই গল্প!
তৃতীয় গল্প ‘লয়ে যাও আমায়’ প্রাইমেট অর্ডারের দুই সদস্যের একসাথে থাকার গল্প। একজন রিজাস মাকাক (বানরদের একটি প্রজাতি), আর আরেকজন হোমো স্যাপিয়েন্স। হাসিনুরের ঘরেই অকস্মাৎ একদিন এক বানর ঢুকে পড়ে। এরপর একা হাসিনুরের সাথে সেই বানরের সখ্যতা গড়ে ওঠার অন্যরকম গল্প এটি। যে বিচ্ছিন্নতা হাসিনুর তার মুহতারমা খোরগোশ স্ত্রীর সাথে থেকে অনুভব করেছে, তার বিপরীতে হাসিনুরের মাঝে একাত্মবোধ জাগায় এই রিজাস মাকাক।
হাসিনুর আর বানরের মাঝে মৈত্রীভাব, যোগাযোগ গড়ে উঠবার পাশাপাশি ইন্টেরিয়র মনোলগে খুব কাব্যিকভাবে হাসিনুর আর তার স্ত্রীর গল্প বয়ান করা হয়। সাধারণ গল্পও কী আশ্চর্য সুন্দর রূপ পায় ভাষার সৌকর্যে, বয়ানের সৌন্দর্যে!
চতুর্থ গল্প ‘বেইজক্যাম্পের দিনগুলি’ বইয়ের পাঁচটি গল্পের মাঝে সবচেয়ে হালকা, আমুদে ভাবমেশানো গল্প। তাই বলে খারাপ ভাববার কোনো কারণ নেই। ঢাকার এক জীর্ণশীর্ণ বারোয়ারি মেসে থাকা মোতাহেরের কথা বলে এটি। এখানেই একটা সূক্ষ্ম রসবোধের টের পাওয়া যায়। যুদ্ধ তো এখানে আছে, তবে সেটা জীবন ও অস্তিত্বকে টেকানোর পাশাপাশি যৌবনের তাড়নাকে লাগামে আনার যুদ্ধ, ভালোবাসা খুঁজে পাবার যুদ্ধ। এই সমস্ত বিষয় মোতাহেরের রোজকার সংগ্রাম ও এফডিসির এক এক্সট্রার সাথে প্রেম আর যৌনতার নিবেদনের গল্পে যেভাবে বাঁধা হয়েছে, তা নতুন কোনো তথ্য দেয় না। অতি চেনাজানা প্রকৃতিরই। তবে লেখার গুণে আমুদে হয়ে উঠবার বিপরীতে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না।
পঞ্চম এবং শেষগল্প, ‘যৌবনের জন্য শোকগাথা’ বইয়ের সবচেয়ে নিগূঢ় গল্প। এবং বিষয়াদির বিবেচনায় কন্ট্রোভার্সাল হবার মতো গল্প। কিন্তু অশ্লীল বা বিকৃত ট্যাগ এর উপর লাগানো যায় না। কারণ লেখক তার বয়ানের প্রতি, তার চরিত্রের প্রতি সৎ ছিলেন।
এই গল্প পঞ্চাশের কোঠায পেরোনো আবদুল জলিলকে নিয়ে। শেষ বয়সে যৌবন তার মধ্যে আবার উথলে উঠেছে। তার যৌনাকাঙ্ক্ষা তাকে তার যুবক বয়সের মতোই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। স্ত্রীর সাথে তার একসময় খুব বর্ণাঢ্য যৌনজীবন কেটেছিল। কিন্তু স্ত্রীর শরীরে রোগ ধরে যাওয়ায় সেই সাড়া, সেই আকাঙ্ক্ষা আর কাজ করে না। আবদুল জলিল তাই দিন দিন আরো ব্যাকুল হয়ে ওঠে নারীদেহ পেতে। যুবতীদের দেহ তাকে আন্দোলিত করে। সেই সাথে তার শরীরও গ্লানিতে ধীরে ধীরে ভরে আসায় আরো ক্ষুব্ধ হয় সে।
যৌনকামনায় আরো আগ্রাসী আর ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে আবদুল জলিল। পর্যায়ক্রমিক বয়ানে চলতে থাকে তার যৌবনের কথা। নানা নারীর সাথে তার মিথস্ক্রিয়া। তার ক্ষুধার্ত মনস্তত্ত্বে অবাধ চলাফেরা। একটু রক্ষণাত্মক ভঙ্গী রাখা পাঠকের মনে হতে পারে, এ বড়ই ‘পারভার্টেড’ গল্প। কিন্তু শেষে গিয়ে যে বেদনা আর ব্যর্থতায় পড়ে আবদুল জলিল, সেটার দাগ এড়াবে কে! শুধু যৌনতার জন্যই যৌবনের শোকগাথা নয়, যৌবনের সেই অদম্য উচ্ছ্বাস হারানোও কি ট্র্যাজেডি নয়?
লেখক এই গল্পে রাখঢাক রাখেননি। হয়েছেন স্পষ্টভাষী। তিনি তো ভূমিকাতেই বলেছেন, “নারী-পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক গতিশীল বলেই এর নির্দিষ্ট কোনো রূপ নেই। এর পেছনে ন্যায়-অন্যায় খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন।” এ যে সমাজেরই এক পুরুষের মনোবাসনার গল্প। যৌনচাহিদা থাকা যেমন স্বাভাবিক, সেই যৌনচাহিদা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক জ্যামিতিক কোণ ধরে জায়গা পাওয়াও স্বাভাবিক। আবদুল জলিলও তো চেপে রাখে। আমরা জেনেছি জলিলকে আমরা খুলে পড়তে পেরেছি বিধায়। ভ্রুকটি না কেটে চিন্তাকে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ, দৃষ্টিকে প্রসারিত করলে আরো অনেককিছুই আমাদের নজরে পড়বে।
লেখক ফয়জুল ইসলামের এই গল্পগ্রন্থ নিয়ে শুরুতেই বলতে হয়, ভাবনা উদ্রেককারী এক গ্রন্থ এটি। বইয়ের প্রারম্ভিকায় ‘গল্পের জন্ম’ অংশে লেখক বলেছেন, “গল্পের কাঠামো আদতে একটা চলরাশি, যা নির্ভর করে গল্পের বিষয় এবং চরিত্রগুলোর মিথস্ক্রিয়ার উপর।” এখান থেকেই লেখকের গোটা আঙ্গিক সম্পর্কে একটা ধারণা দাঁড়িয়ে যায়, যা পড়তে পড়তে স্বচ্ছ প্রতিফলনে নিজেকে আবিষ্কারের সুযোগ দেয় তার পাঠকদের। ‘ঘুমতৃষ্ণা’ নামের স্বার্থক রূপ কখনো অগোচরে, কখনো সূক্ষ্মরূপে জড়িয়ে থাকে প্রতিটি গল্পে। সেই তৃষ্ণা মিটবে হয়তো মাছরাঙা হবার মধ্য দিয়ে কিংবা হয়তো সঙ্গিনীর গরম নিঃশ্বাসের নিয়ত ওঠানামার মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে। এই ‘হয়তো’র মাঝেই যে সব খেলা করে। নারী-পুরুষের নানামুখী আন্তঃসম্পর্কের মাঝ দিয়েই জীবনের নানা মাত্রা সৃষ্টি হয়। ওই সীমাহীন দ্বন্দ্বের মাঝ দিয়েই তো জীবন নানা গল্প পায়, রূপ পায়। যৌনতা বিনিময়, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, প্রেম-প্রত্যাখান- এসবের ঘূর্ণাবর্তেই গল্পগুলো ঘোরে। সাহস আছে, স্পষ্টতা আছে এর ভাষায়।
ফয়জুল ইসলামের গদ্যভাষার মাঝে স্বকীয় ব্যাপার হলো- একেক গল্পের ক্ষেত্রে গল্পের বিষয় এবং চরিত্রগুলোর রূপরেখা বিবেচনা একেক ধরনের আঙ্গিক আর ভাষা ব্যবহার করেছেন। ওই শুরুতে যা নিজেই বলেছিলেন। সফলতার সাথেই তা করতে পেরেছেন। তবে, প্রতিটি গল্পের ভাষার ক্ষেত্রেই তিনি কোনো রাখঢাক রাখেননি। এবং সেটা বজায় রেখেই ভাষা কবিতার ছন্দ পেয়েছে। অযাচিতভাবে নয়, সাবলীল চলন-বলনেই কাব্যিক হয়ে উঠেছে। উপমার ভারে ভারাক্রান্ত হয়নি, পেয়েছে সুষম গতি। তাতে জীবনঘেঁষা গল্পগুলো জীবনঘেঁষা কাব্য হয়েই আরো বেশি অনুনাদ তুলেছে পাঠকমনে।
অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা নেই, কারণ লেখকের গদ্যভাষা যে বৈষয়িক নয়, বরং বস্তুনিষ্ঠ। ইন্টেরিয়র মনোলগের যত্নশীল ব্যবহারে চরিত্রের মনস্তত্ত্বে লেখক যেভাবে বিচরণ করেছেন, ফলত যে প্রগাঢ়তা গল্পগুলো পেয়েছে, অবজেক্টিভ ভাষায় সেটা দূরবর্তীই থাকতো। ওতে বর্ণনা পাওয়া হতো, কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি নয়।
বই: ঘুমতৃষ্ণা
লেখক: ফয়জুল ইসলাম
বইয়ের ধরন: গল্পগ্রন্থ
প্রকাশনী: কথাপ্রকাশ